স’মিল কেড়ে নিয়েছে করাতিদের সুখ

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কালের স্রোতে আজ হারিয়ে যাচ্ছে করাতিরা। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা স’মিল তাদের সুখ কেড়ে নিয়েছে। এক সময় গাছের গুড়ি চেরাইয়ের জন্য করাতিরা ছিলেন প্রধান ভরসা। তখন তাদের প্রায়ই দেখা যেতো গাঁয়ের পথে। করাতিরা চলতেন দল বেঁধে। একেকটা দলে থাকেন পাঁচ থেকে সাতজন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দল বেঁধে চলা করাতিদের সাথে থাকতো লম্বা করাত, কাঠ কাটার কুড়াল, সুলির রোল, কাঠের খিলি, হাতুড়ি, কাঁচি ও দড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। গ্রামে কাঠ চেরাই করার জন্য তারা বেঁছে নিত উন্মুক্ত জায়গা। গুড়ি ওপরে তুলে করাত চালানোর জন্য তৈরি করত কাঠ, বাঁশ বা শালবল্লির মাচা। গুড়িতে সাইজ অনুযায়ী সুতলি টেনে দাগ দিয়ে চালাতো করাত। লম্বা এই করাত চালানোর জন্য সাধারনত ৩-৪ জনের দরকার হতো। একজন ওপরে ও ২ থেকে ৩ জন থাকতো নিচে। ওপরে যিনি থাকেন করাত চালানোয় মুখ্য ভূমিকা থাকে তার। বাকি ২-৩ জন যারা নিচে থেকে করাত টানেন তাদের কাজ এ ক্ষেত্রে কিছুটা গৌণ। গাছের গুড়ি মোটা হলে নিচ থেকে ২ জনের বেশি লোকও করাত টানে। করাত যখন চলতে থাকে তখন দূর থেকে শোনা যায় ক্যারাত ক্যারাত শব্দ। করাতিরা প্রধানত মাচা বানাতো পুকুর বা খালের পাড়ে অথবা উন্মুক্ত জায়গায়। যাতে করাত টানতে অসুবিধা না হয়। আবার প্রয়োজনে বসে বিশ্রাম নেয়ারও জায়গা পাওয়া যেত। কালের বিবর্তনে করাতিরা আজ হারিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এখন দেখাই যায় না।
বিলাঞ্চল বলেখ্যাত বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সহস্রাধীক করাতিরা কাজ না থাকায় ঋণগ্রস্ত হয়ে এ পেশা পরিবর্তন করেছেন। একবিংশ শতাব্দীতে গ্রামগঞ্জে বিদ্যুতের ছোঁয়ায় স’মিল গড়ে ওঠায় অনেক করাতি পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, পাশ্ববর্তী কালকিনি, কোটালীপাড়া, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, মুলাদীসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের গৃহ, আসবাবপত্র, ঘরের দরজা-জানালা, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কাঠের জন্য করাতিরা ছিলেন প্রধান সহায়ক। তারা গাছ কেটে উপযুক্ত সাইজের কাঠ বানিয়ে দিতেন কাঠ মিস্ত্রিদের।

করাতির পেশা পরিবর্তনকারী আগৈলঝাড়া উপজেলার বারপাইকা গ্রামের জগদীশ চন্দ্র মিস্ত্রি বলেন, গ্রামে স’মিল গড়ে ওঠায় প্রায় এক যুগ আগে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। তিনি আরো বলেন, এখন আর করাতিদের কাঠ কাটতে হয় না। একই উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামের হরেন মধূ বলেন, গাছ কাটার সরঞ্জামাদির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সঠিক মজুরি না পাওয়ায় এ পেশা ছেড়ে দিয়েছি।

অপরদিকে এসব উপজেলায় অনেকে করাতির পেশা ছেড়ে দেয়ায় সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলের কিছু সংখ্যক করাতিদের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় দেখা মিলছে। এরা এ দু’উপজেলার হাটের দিনে তাদের সরঞ্জামাদি নিয়ে মক্কেলের আসায় অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে এসব উপজেলার স’মিলের বড় গাছ চেরানোর কাজেই এখন তাদের বেশি দেখা মেলে। সাতক্ষীরা জেলার করাতি আব্দুর রব শেখ জানান, এসব উপজেলার করাতিরা তাদের পেশা ছেড়ে দেয়ায় প্রতি বছর ৬ মাস তারা এ অঞ্চলে দল বেঁধে এসে গৃহস্ত ও স’মিলের বড় গাছ চেরানোর কাজ করছেন।