বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা ‘গৌরনদী’ জেলায় উন্নীত হবে কবে? আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ মন্ত্রী না হওয়ায় এবারো ভেস্তে গেছে এলাকাবাসীর স্বপ্ন

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা, দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্মৃদ্ধ ও রাজনৈতিক সচেতন বলেখ্যাত বরিশালের গৌরনদী জেলায় উন্নীত হবে কবে? এমনই নানাপ্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে গৌরনদীবাসীর মধ্যে। গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করনের নানা যৌক্তিকতা থাকা সত্বেও রহস্যজনক কারনে আজও তা Gournadiবাস্তবায়িত হয়নি। ফলে গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরিত করার দাবি এলাকাবাসির স্বপ্ন সে স্বপ্নই রয়ে গেছে। গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করণের স্বপ্ন দেখেছিলেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালো রাতে ঘাতকদের নির্মম বুলেটে তিনি শহীদ হন। এরপর থেকেই স্থিমিত হয়ে যায় এ স্বপ্ন।
 
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর থেকে অদ্যবর্ধি শুধু আশ্বাসের বাণী শুনতে শুনতে গৌরনদীবাসীর সময় অতিক্রান্ত হলেও গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরিত করার স্বপ্ন আজো পূরণ হয়নি। এতদাঞ্চলের জনগনের শেষ স্বপ্ন ছিলো আওয়ামীলীগ সরকার পূণ:রায় ক্ষমতায় আসলে দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামীলীগের কর্ণধর ও শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ মন্ত্রী হবেন। তার মাধ্যমেই জনগনের দীর্ঘদিনের এ দাবি পূরন হবে। কিন্তু ২০০৯ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলেও আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ মন্ত্রীত্ব না পাওয়ায় এলাকাবাসীর স্বপ্ন আজও স্বপ্নই রয়ে গেছে।

সূত্রমতে, ভৌগলিক দিক থেকে গোপালগঞ্জ জেলার পূর্ব সীমান্তে, মাদারীপুর জেলার দক্ষিণ, বরিশাল বিভাগীয় শহরের উত্তর সীমান্তে ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার মুখে ১৪৭.৮৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনে গৌরনদী উপজেলার অবস্থান। বরিশালের বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, মুলাদী, আগৈলঝাড়া ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার মধ্যবর্তীস্থানে গৌরনদী অবস্থিত। অতি প্রাচীণকাল থেকেই শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, ইতিহাস-ঐতিহ্যে গৌরনদীর সুনাম-সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পরে। এখনো তা বিদ্যামান রয়েছে। এখানে গড়ে উঠেছিলো উন্নত জনপদ। তাই মোগল যুগে ইসলাম প্রচারক খানজাহান আলী ও ইয়েমেনের বাদশার পুত্র হযরত মল্লিক দূত কুমার পীর সাহেব বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসে গৌরনদীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা এ অঞ্চলে স্থাপন করেছেন বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, দীঘি ও সরাইখানা। এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আল্লাহর মসজিদ, কমলাপুর মসজিদ, হিন্দু ধর্মাবোলম্বিদের তীর্থস্থান বার্থী তাঁরা মায়ের কালী মন্দির, মাহিলাড়ার সরকার মঠ, সমাজ সেবক ছবি খাঁর হুজরা, পলাশীর যুদ্ধের দূর্গ ও কামান, শতিদাহ মঠসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন।

গৌরনদীর নলচিড়া, মাহিলাড়া ও বাটাজোর নিয়ে নিম নবদ্বিপ গঠিত হয়েছিলো। ওইসব স্থানে প্রায় ৩০জন পন্ডিত লোক বসবাস করতেন। গৈলা, ফুল্লশ্রী এলাকা ছিলো উপ-মহাদেশের সবচেয়ে অধিক শিক্ষিত লোকের বসবাস। মধ্যযুগের মহাকবি বিজয় গুপ্তের জন্মস্থান এই এলাকায়। বৃট্রিশ যুগে সংস্কৃতি ভাষা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে গৈলার কবিন্দ্র বাড়িতে এবং নলচিড়ায় দুটি টোল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিলো। ওইসময় গৈলাতে ৩৬০ ঘর তালুকদার ও একজন জমিদারের বসতি ছিলো। গৌরনদী উপজেলার পাশ্ববর্তী আশোকাঠী গ্রামে মোহন লাল সাহা এবং চাঁদশী গ্রামে কেদারনাথ বসু, অন্মিকা চরন গুহ ও অন্নদা বসু নামের তিনজন জমিদারের বাড়ি ছিলো। বরিশালের শিক্ষা ও সংস্কৃতির রূপকার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বসত বাড়ি গৌরনদীর বাটাজোরে। অভিবক্ত ভারত বর্ষের একাধিকবার নির্বাচিত এমএলএ ও আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জন্মস্থানও হচ্ছে গৌরনদী। বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধি পর পর দু’বার এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের সংঙ্গে বৈঠক করার জন্য গৌরনদীতে এসেছিলেন। ওই আন্দোলনে নিহত হয়েছিলেন গৈলার তারক সেন নামক এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। তৎকালীন সময়ে গৈলা গ্রামে শতাধিক এমএ পাশ এবং ৪০ জন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী লোক বসবাস করতেন। দ্বিতীয় কোলকাতা বলেখ্যাত গৌরনদীতে তখন সরাসরি কোলকাতা থেকে ষ্টীমার নিয়মিত আসা যাওয়া করতো। সারাদেশের সাথে নদী ও সড়ক পথে রয়েছে গৌরনদীর সুষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থা। বরিশাল সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত গৌরনদী উপজেলা। গৌরনদীর ওপর দিয়েই বয়ে গেছে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক। স্বাধীনতা যুদ্ধেও গৌরনদীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছিলো অসামান্য অবদান। ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর গৌরনদী পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিলো। দেশের মধ্যে সর্বশেষ বিজয় পতাকা উড়েছিলো গৌরনদী। ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহবায়ক ভাষা সৈনিক মরহুম কাজী গোলাম মাহবুবের জন্মস্থানও এই গৌরনদী।

স্বাধীনতা উত্তর আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করণের লক্ষে জেলা সদরে যেসব অফিস থাকা প্রয়োজন তা গৌরনদীতে স্থাপন করেছেন। ৫ থানা পুলিশের হেডকোয়ার্টার সহকারি পুলিশ সুপারের অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় অফিস, বন বিভাগের উপ-বিভাগীয় অফিস, বিদ্যুত বোর্ডের অফিস, তাঁত বোর্ড অফিস তিনি এখানে স্থাপন করেছেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালো রাতে তিনি নিহত হবার পর গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরিত করার উদ্যোগ স্থিমিত হয়ে যায়। থেমে যায় সব কার্যক্রম।

১৯৮১ সনে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করণের পদক্ষেপ গ্রহন করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারনে তারও উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহনের পর মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দেশের সবকটি মহাকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করলেও দুরভাগ্যক্রমে বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা গৌরনদী তৃতীয়বারের মতো বাদ পরে যায়। জেলার জন্য চতুর্থবারের মতো দাবি ওঠে ১৯৯১ সনে। কিন্তু সে বারও আর আলোর মুখ দেখেনি।

১৯৯৬ সনে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নির্বাচিত হন। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর তিনি গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করনের প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ গৌরনদী পৌরসভা গঠন করেন। তিনি তার পিতা শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষে গৌরনদীতে ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন, পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিস, ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিভাগীয় বেবী হোমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। ২০০০সনে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরিশাল সফর উপলক্ষে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, মন্ত্রনালয়, জেলার বিভিন্ন অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই গুঞ্জন উঠেছিলো গৌরনদী জেলা হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করে সে গুঞ্জনও থেমে যায়। তখন শোনা গিয়েছিলো অর্থ সংকটের কারনে গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করা হয়নি।

২০০১ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী এম.জহির উদ্দিন স্বপনের নির্বাচনী জনসভায় (সরকারি গৌরনদী কলেজ মাঠে) প্রধান অতিথির ভাষনে বেগম খালেদা জিয়া গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরিত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ওই জনসভায় সাবেক মন্ত্রী সুনীল গুপ্ত জেলার দাবি তুললে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আপনারা আমাকে এমপি উপহার দিন, আমি আপনাদের জেলা উপহার দিবো। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার জনগন ওইসময় খালেদা জিয়াকে এমপি উপহার দিলেও ক্ষমতায় গিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) জনগনের দাবি পূরন করেননি। এম.জহির উদ্দিন স্বপনও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা গৌরনদী কি জেলায় উন্নীত হবে? নাকি স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে?

রিপোর্টটি তৈরী করেছেন : জামাল উদ্দিন ও খোকন আহম্মেদ হীরা