বরিশালে প্রেমের বলি হলো তিন শিক্ষক

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ এরা কেউ জমির বিরোধ কিংবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকারে খুন হননি। এরা প্রেমের বলি হয়েছেন। গত তিন মাসে বরিশালে প্রেমের Premer Boliকারনেই তিনজন শিক্ষককে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে।

গৌরনদী উপজেলার পিঙ্গলাকাঠী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দার গত ২২ সেপ্টেম্বর খুন হয়েছেন প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে ত্রি-ভূজ প্রেমে জড়িয়ে। আগৈলঝাড়ার গৈলার শিহিপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শারমিন আক্তারকে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে তাকে (শারমিনকে) গত ১২ অক্টোবর খুন করেছে বখাটে আবুল গোমস্তা। প্রেম নিবেদনে ব্যর্থ হয়ে যে আবুল ছুড়ি দিয়ে তার ভালবাসার দেবীকে কুপিয়ে টুকরো করতে পারে সেকি প্রেমিক না জল্লদ তা নিয়ে যখন চারদিকে তোলপাড়, ঠিক তখনই জীবন প্রদীপ নিভে গেল বরিশালের রূপাতলী এ. ওয়াহেদ বালিকা বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের খ্যতিমান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলীর। গত ২৬ নবেম্বর তিনি (জিন্নাত আলী) জল্লদের হাতে জীবন দিয়ে প্রমান করে গেছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় জন্ম নেয়া জল্লদরা পাক হানাদার বাহিনীর চেয়েও বর্বর। জিন্নাত আলী শুধু একজন আর্দশবান স্কুল শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ১৯৭১ সনে মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়েছেন। পাক বাহিনীর কাছ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারলেও আজ তারই গড়া স্বপ্নের দেশে নিজের কন্যার ইজ্জত রক্ষায় জীবন দিতে হয়েছে তাকে। মেয়েকে উত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বখাটে রূপম দে ওরফে রূপা ও তার সহযোগী আরিফুর রহমান মিঠু ছুরিকাঘাত করে শিক্ষক জিন্নাত আলীকে হত্যা করে।

বরিশালের শিক্ষক জিন্নাত আলী :
বরিশাল নগরীর রুপাতলীর এ. ওয়াহেদ বালিকা বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী। তিনি সাগরদীর চান্দুর মার্কেট এলাকায় ঠিকাদার ইউসুব আলীর ভবনে ভাড়া থাকতেন। তার (জিন্নাত আলীর) কন্যা তাজরীন জিন্নাত সুপ্তি (১৭) বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। দীর্ঘদিন থেকে সুপ্তিকে উত্যক্ত করে আসছিলো নগরীর বাজার রোড এলাকার সুলতানী বিড়ি ফ্যাক্টরীর পিছনের বাসিন্দা মৃত কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র বখাটে পুত্র রূপম ওরফে রূপা (২৭)। এ ঘটনায় গত তিনমাস পূর্বে শিক্ষক জিন্নাত আলী কাউনিয়া থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রূপম ও তার সহযোগী আরিফুর রহমান মিঠু গত ২৫ নবেম্বর রাতে বাসার সম্মুখে বসে শিক্ষক জিন্নাত আলীকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর জখম করে। আহত শিক্ষক জিন্নাত আলীকে তাৎক্ষনিক বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২৬ নবেম্বর দুপুরে ঢাকা হাসপাতালে নেয়ার পথিমধ্যে সে মৃত্যু বরন করেন। পুলিশ তাৎক্ষনিক অভিযান চালিয়ে বখাটে রূপমের সহযোগী আরিফুর রহমান মিঠু, রিফাত, বিশ্বজিৎ কুমার রায়, রিমন, রাজন ও রিফতিকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় গত ২৭ নবেম্বর বিকেলে নিহত জিন্নাত আলীর স্ত্রী কাজী শিরিন আক্তার বাদি হয়ে বখাটে রূপম ওরফে রূপা ও তার একান্ত সহযোগী গ্রেফতারকৃত আরিফুর রহমান মিঠুকে আসামি করে কোতয়ালী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

আগৈলঝাড়ার শিক্ষিকা শারমিন আক্তার :
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গৈলার শিহিপাশা (এতিমখানা) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা ও গৈলা কালুপাড়া গ্রামের শাহজাহান সরদারের কন্যা শারমিন আক্তার (২২)। দীর্ঘদিন থেকে শারমিনকে উত্যক্ত করে আসছিলো পাশ্ববর্তী উত্তর শিহিপাশা গ্রামের আবু গোমস্তার বখাটে পুত্র আবুল গোমস্তা (৩০)। গত এক বছর পূর্বে একই উপজেলার মাগুড়া গ্রামের সেনা সদস্য সোহেল তালুকদারের সাথে সামাজিক ভাবে শারমিনের বিয়ে হয়। এতে বখাটে আবুল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কর্মস্থলের পার্শ্বে গৈলা বাজারের প্রভাতী ভবনের বাবার ফ্লাটেই শিক্ষিকা শারমিন বসবাস করে আসছিলো। গত ১২ অক্টোবর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে স্কুল ছুটির পর শিক্ষিকা শারমিন বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গৈলা বাদ্যকার বাড়ির সন্নিকটের ব্রিজের কাছে পৌঁছলে বখাটে আবুল শিক্ষিকা শারমিনের পথরোধ করে উপর্যপুরী ছুরিকাঘাত করে বীরদর্পে স্থান ত্যাগ করে। এ সময় শারমিনের আত্মচিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে আগৈলঝাড়া হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন বিকেল ৫ টার দিকে শিক্ষিকা শারমিন আক্তার মারা যায়। পুলিশ তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে অভিযান চালিয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় হত্যকারী বখাটে আবুল গোমস্তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

গৌরনদীর শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দার :
পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের জনৈক সৌদি প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে একই গ্রামের আবুল কালাম ওরফে কালু সরদার দীর্ঘদিন পূর্বে পরকীয়ায় জড়িয়ে পরে। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে প্রবাসীর পরিবারের চাপের মুখে তাদের সম্পর্কের ফাঁটল ধরে। প্রবাসীর শিশু পুত্র পিঙ্গলাকাঠী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে পড়াশুনা করতো। শিশু পুত্রকে নিয়ে প্রবাসীর স্ত্রী স্কুলে যাতায়াতের সুবাধে তার সাথে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারের পরিচয় হয়। একপর্যায়ে প্রবাসীর বাড়িতে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারের যাতায়াতের সুবাধে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে কালুর সন্দেহ হয়। তাই সে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারকে প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে কথা না বলা ও তার সাথে কোন সর্ম্পক না রাখার জন্য বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়ে আসছিলো। তার হুমকিতে কোন কাজ না হওয়া শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারকে কালু হত্যার পরিকল্পনা করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দার (২৮) স্কুলে যাওয়ার পথিমধ্যে পিঙ্গলাকাঠীর কর্মকার বাড়ির নির্জনস্থানে পৌঁছলে সন্ত্রাসী কালু সরদার ঠান্ডা মাথায় একাই ছুরিকাঘাত করে ফরিদকে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পর পরই খুনী কালু সরদার এলাকা থেকে আত্মগোপন করলেও পুলিশ মোবাইল ফোনের কললিষ্টের সূত্রধরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এলাকার গোদা বাজার এলাকা থেকে কালুকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে কালুর স্বীকারোক্তি ও তার উপস্থিতিতে পুলিশ হত্যার কাজে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।