বরিশালের ৩৪ টি গণকবরের খোঁজ নেয়নি কেউ

খোকন আহম্মেদ হীরা, গৌরনদীঃ স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বর্বর নির্যাতনে নিহত শহীদদের ৩৪টি গণকবরের স্মৃতি রক্ষার্থে এখনো বরিশালের অধিকাংশস্থানে নির্মিত হয়নি স্মৃতি স্তম্ভ। যে সবস্থানে সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে তাও অযন্ত অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে দীর্ঘ ৪০ বছরে গণকবর গুলো সনাক্ত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান না করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে এতদাঞ্চলের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী তাবিজ বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির দাবি করেছেন রনাঙ্গন কাঁপানো মুক্তিযোদ্ধারা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল অঞ্চলের বধ্যভূমির সম্ভাব্য তালিকার মধ্যে রয়েছে বরিশাল সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন কীর্তনখোলা তীরে সরকারিভাবে স্তম্ভ নির্মিত বধ্যভূমি (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ১ থেকে দেড় হাজার লোক, তালতলী বধ্যভূমি বেসরকারিভাবে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় অর্ধ শতাধিক। চরকাউয়া মোসলেম মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন খালের পাড় বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ৩০ থেকে ৪০ জনকে। বরিশাল নগরীর ১ নং সিএন্ডবি পুল বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যার শিকার হয় ৮ থেকে ১০ জন।

গৌরনদীর বাটাজোর হরহর মৌজার মরার ভিটার বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় দেড় থেকে দু’শ জনকে, গৌরনদী নদীর তীরে সহকারী পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ২ থেকে ৩ শতাধিক, গৌরনদী গয়নাঘাটা পুল বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ২ থেকে ৩ শতাধিক, গৌরনদী কলেজ সংলগ্ন হাতেম পিয়নের বাড়ির ঘাটলা বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ৪ থেকে ৫ শতাধিক।

আগৈলঝাড়ার কাঠিরা ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ সংলগ্ন বধ্যভূমি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক, রাংতা বিল রাজিহার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) হত্যা করা হয় ৫ শতাধিক। কেতনার বিল রাজিহার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৬ থেকে ৭ শতাধিক। রাজিহার ফ্রান্সিস হালদারের বাড়ির বধ্যভূমি ব্যক্তিগতভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ৮ জনকে। পতিহার গ্রাম বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০ জন। দক্ষিন শিহিপাশা গ্রাম বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয়েছিলো ২০ থেকে ৩০ জনকে।

বাকেরগঞ্জের কলসকাঠী বধ্যভূমি ব্যক্তিগতভাবে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ৪ শতাধিক। বেবাজ বধ্যভূমি এখানে গণহত্যা করা হয় দু’শতাধিক (অচিহ্নিত)। শ্যামপুর বধ্যভূমিতে গণহত্যা করা হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ জনকে (অচিহ্নিত)। বানারীপাড়ার দক্ষিন গাভা নরেরকাঠী বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৭৫ থেকে ১’শ জনকে। গাভা বাজার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ জনকে। গাভা বিল্ব বাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৫ থেকে ৭ জনকে। গাভা পূর্ববেড় মহল বাওনের হাট বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ২৫ থেকে ৪০ জনকে। গাভা রাম চন্দ্রপুর মহল (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে। বাবুগঞ্জের ক্যাডেট কলেজ বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক। উজিরপুর বড়াকোঠা দরগাবাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় শতাধিক লোককে। উত্তর বড়াকোঠা মল্লিক বাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৮ থেকে ১০ জনকে। বড়াকোঠা মুক্তিযুদ্ধের মিলন কেন্দ্র সংলগ্ন বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয়েছিলো অর্ধশত ব্যক্তিকে। খাটিয়াল পাড়া বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০ জনকে। বড়াকোঠা চন্দ্র কান্ত হালদার বাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১০ জনকে। উজিরপুরের নারায়নপুর বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় প্রায় অর্ধশতাধিক লোককে। মুলাদীর পাতারচর গ্রাম বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৪০ থেকে ৫০ জনকে। মুলাদী নদীর দক্ষিন পাড় বেলতলা বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০ জনকে। মেহেন্দিগঞ্জ থানা সংলগ্ন বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় আড়াই থেকে ৩ শতাধিক। পাতারহাট গার্লস স্কুলের দক্ষিন পাড়ের খলিল মোল্লার বাড়ির বধ্যভূমিতে (চিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ১২ জন ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাকে। পাতারহাট গার্লস স্কুল সংলগ্ন ব্রীজের গোড়ার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে।

ঝালকাঠী জেলার নলছিটি সুগন্ধা নদীর তীরের বধ্যভূমি (অচিহ্নিত) এখানে গণহত্যা করা হয় ১৩ জনকে। নলছিটি মানপাশা ঋৃষিপাড়া বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক গ্রামবাসীকে। স্বরূপকাঠি কুড়িয়ানা খালের বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় প্রায় ১ হাজার জনকে। কুড়িয়ানা জয়দেব হালদার বাড়ির বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ৪ থেকে ৫ শতাধিক। পূর্বজল্লাবাড়ি খালপাড় বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গণহত্যা করা হয় ২ শতাধিক ব্যক্তিকে।

বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মানিক বীর প্রতিক বলেন, জাতির প্রত্যাশা পুরনের চেয়ে গ্লানি বেশী। যে গ্লানি নিয়ে আজো আমরা লড়াই করি। কি বিচিত্র এ দেশ! যারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে, যারা এ দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে মা-বোনদের ইজ্জত লুন্ঠনের সাথে জড়িত ছিলো, তারা বেঁচে গিয়ে আমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে। আমরা অনতিবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।

উল্লেখ্য, ঝালকাঠী জেলার নলছিটি, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী ও কুড়িয়ানা ১৯৭১ সনে বরিশাল জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ছারছিনা মাদ্রাসার তৎকালীন ছাত্র ও তাবিজ বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এ অঞ্চলের প্রতিটি ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ, বসত ভিটায় অগ্নিসংযোগের নায়কের ভূমিকায় ছিলেন। পাক বাহীনির প্রতিটি অপারেশন তার দেয়া ছক অনুযায়ী হয়েছে বলেও তদন্তে প্রমান মিলেছে। এতদাঞ্চলের রনাঙ্গন কাঁপানো বীর মুক্তিযোদ্ধারা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের অনতিবিলম্বে ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন।