আজ ৮ডিসেম্বর ঝালকাঠি ও নলছিটি পাকহানাদার মুক্ত দিবস

আহমেদ আবু জাফর, ঝালকাঠি ॥ ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা ঝালকাঠি ও নলছিটি থানা পাকহানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করেছিল অধ্যক্ষ এম এ বায়েজীদের নেতৃত্বে ও কমান্ডে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও বহু শহীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ঝালকাঠি ও নলছিটি থানা শক্রমুক্ত হয়। দিবসটি উপলক্ষে ঝালকাঠি ও নলছিটির মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করেছে।

একান্ত সাক্ষাতকারে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ডার অধ্যক্ষ এমএ বায়েজীদ জানান, সারাদেশে ২৫ মার্চ পাকবাহিনী যুদ্ধ ঘোষনা করে। ক্রমান্বয়ে পাকহানাদাররা মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ এপ্রিল ঝালকাঠি শহরের বিভিন্ন ঘর দোকান-পাট পুড়িয়ে লুটতরাজ শুরু করে। আমার এবং অন্যান্য কমান্ডারদের নেতৃত্বে শক্তি সংগ্রহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে প্রতিরোধের উদ্যোগ নেই। নলছিটির বেইজ কমান্ডার সেকেন্দার মিয়া ৮ডিসেম্বর একটি মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমন করেন। ঝালকাঠি থানা বেইজ কমান্ডার সুলতান মাষ্টার ঐদিন বাবুগঞ্জ থানা আক্রমনে ব্যস্ত ছিলেন। অন্যতম সহকারী কমান্ডার হোসেন শরীফ ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আমার সাথে ছিল এবং ৮ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে ঝালকাঠি থানা ও রাত ১১টার দিকে নলছিটি থানা শক্রমুক্ত হয়।

তিনি জানান, ৩০ জুন শহীদ ইউনুসের বড় ভাই ইসরাইলের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা নলছিটি থানা আক্রমন করে। ঐ যুদ্ধে নলছিটি থানা পুলিশ ও পাকবাহিনীর সাথে বাড়ৈয়ারা গ্রামের মেনহাজ উদ্দিনের পুত্র ইউনুস শহীদ হয়েছিলেন। কর্নকাঠির একজন মুক্তিযোদ্ধা আহতাবস্থায় ধরা পড়ায় তাকে গুলি করে হত্যা করে। নলছিটির বেইজ কমান্ডার সেকেন্দার আলী মিয়ার সাথে পাক হানাদারের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

তিনি আরো জানান, ১৭ জুলাই মিলিটারী, রাজাকার ও পুলিশ গুরুধাম এলাকা থেকে কম্বাইন্ড ফোর্স আমাকে বন্ধী করে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে আসে। থানায় এনে আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। তখন পীস কমিটির সভাপতি সলিমউদ্দিন মিঞা ও পুলিশ পরিদর্শক শাহ আলমের প্রচেষ্টায় আমি পাকবাহিনীর কবল থেকে মুক্তি পাই। এর আগে পাকহানাদাররা ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা  মুজিব ও মেহেদীকে পৌরসভা সংলগ্ন এলাকার (বর্তমান বদ্ধভুমিতে) ধরে এনে হত্যা করে।

১৩ নভেম্বর বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের সর্বশ্রেষ্ট যুদ্ধ আমার এলাকা চাচৈরে সংঘঠিত হয়। ঐ যুদ্ধে পাক বাহিনী, পুলিশ ও রাজাকারসহ ১শ ৬৭ জন প্রান হারায়। ক্ষিপ্ত হয়ে চাচৈর এবং অনান্য গ্রামে পাকবাহিনী প্রায় ৪শতাধিক ঘরবাড়িতে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। ঐ যুদ্ধে আউয়াল নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

১৪ নভেম্বর নলছিটি থানা আক্রমন চালালে পুলিশ, রাজাকার ও পাকবাহিনীর আক্রমনে মুক্তিযোদ্ধারা বেশীক্ষন টিকতে পারেনি। এ সময় শীতলপাড়া দরগাবাড়ি এলাকায়  আলাউদ্দিন ও অন্য এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ঐদিন দরগাবাড়িসহ চৌদ্দবুড়িয়া,শীতলপাড়ার প্রায় সাড়ে ৩শ ঘর পুড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী।

তিনি আরো জানান, ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে চাচৈর ক্যাম্পের ১হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে চাঁদকাঠি চৌমাথায় অবস্থান নেই। তখন সিআই শাহ আলমের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অধ্যক্ষ এমএ বায়েজীদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠান। ঐ চিঠিতে রাজাকার, পুলিশ এবং পাকবাহিনীর সকল অস্ত্র মালাগারে জমা করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পন করতে নির্দেশ দেয়া হয়।  কিছুক্ষন পর রাত ৮টার পরে সিআই শাহ আলম মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশমতে অস্ত্র এবং পাকহানাদারদের সমবেত করা হয়েছে বলে এমএ বায়েজীদের কাছে পুনরায় চিঠি পাঠিয়ে থানায় আসার আমন্ত্রন জানান। তখন কমান্ডার বায়েজীদ ও সহকারী কমান্ডার হোসেন শরীফ থানায় এসে অবস্থা পর্যবেক্ষন করে সঠিক দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের আসার নির্দেশ দেন। পাকহানাদার রাজাকার, পুলিশ যারা আত্মসমর্পন করেছিলেন তাদেরকে বিনা নির্যাতনে জেলখানায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। রাত ৪টার সময় ঝালকাঠি ষ্টীমারঘাটে একটি যুদ্ধ বিমান বোমা বিস্ফোরন ঘটায়। আজিজ পাইলটের ভাই রাজাকার কমান্ডার ঝালকাঠির ত্রাস আ: বারেক একটি দল নিয়ে পশ্চিম ঝালকাঠির মধ্যদিয়ে যাবার পথে জনগনের হাতে ধৃত হয়ে গনপিটুনিতে নিহত হয়। রাত ৯টার মধ্যে ঝালকাঠি থানা শক্রমুক্ত হয়।

ঝালকাঠি মুক্ত হবার পর নলছিটির ওসির সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি আমাদের নির্দেশ মতে অস্ত্র এবং তাদের বাহিনী আত্মসমর্পন করায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্র“প সহকারী কমান্ডার  অলিউর রহমানের নেতৃত্বে নলছিটি থানা দখল করেন। সকালে সেকেন্দার মিয়া নলছিটি উপস্থিত হয়ে আত্মসমর্পনকারী পাকহানাদার, পুলিশ ও শান্তি বাহীনীর কতিপয় নেতাকে তালতলা হাইস্কুলে নিয়ে বন্ধী করে রাখে। ঐদিন রাতে পাকবাহিনী বেগতিক অবস্থা দেখে আত্মসমর্পন করে। রাত ১১টার মধ্যে নলছিটি থানাও শক্রমুক্ত হয়।

পরবর্তীতে বরিশালের সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর শাহজাহান ওমর’র নির্দেশে পাকবাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া ১হাজার ৩শ ২৮টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র রহমতপুর রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে জমা করা হয়।

আজকের এই দিনে তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়ন কাজে সহায়তার আহবান জানান। সেই সাথে সরকারের কাছে সকল যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারেরও দাবী করেন।