স্বাধীনতার ৪০ বছরেও ওঁরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি – কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সেই তিন বীরাঙ্গনার খবর আজ কেউ রাখে না

সিরাজ প্রামাণিকঃ চেতনা-চৈতন্যে তাঁরা বীরাঙ্গনা। তাঁরা যোদ্ধা নারী, মুক্তিযোদ্ধা। জীবন সন্ধিক্ষণে এসেও উপহাস আর অবহেলার শিকারে পরিণত হয়ে বেঁচে Birongonaআছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী পদ্মা তীরের হাসিমপুর ও দয়রামপুর গ্রামের এলেজান, মাসুদা ও দুলজান নামের তিন বীরাঙ্গনা। স্বাধীনতা পরবর্তী এ দীর্ঘ সময়ে তাদের যাপিত জীবন যেমন মানবেতর তেমনি সামাজিক ভাবে নিগৃহীতও বটে। না পেয়েছে গৌরবোজ্জল মর্যাদা, না মিলেছে শান্তিপূর্ণ আশ্রয়, পূনর্বাসন। রোগে ভূগে মৃত্যু শয্যায় এই তিন বীরঙ্গনার খবর এখন কেউ রাখে না। কী এনজিও, কী সরকারী সংস্থা সবাই তাদেরকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৯২ সালে ২৬শে মার্চ ঢাকায় ৭১ এর যোদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আয়োজিত গণ আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে ঘরে ফিরলে তারা হয়ে যান সমাজচ্যুত। সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করে গ্রামের লোকজন। তালাক দিয়ে তাদের মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাবার বাড়ীতে। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আর স্থানীয় সচেতন মহলের উদ্যোগে পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই তিন বীরাঙ্গনাকে দেওয়া হয় বিশেষ সংবর্ধনা। তাঁরা স্বীকৃতি পান মুক্তিযুদ্ধের নন্দিত নারী হিসেবে। তারপর আর কেউ খবর রাখেনি। সরেজমিন তিন বীরাঙ্গনার অজানা কাহিনী তুলে ধরেছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক-

বুভুক্ষু পদ্মার ভাঙ্গাগড়া সয়ে এখনও টিকে আছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দয়রামপুর ও হাসিমপুর গ্রাম। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন এ অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় রাজাকাররা। পাঞ্জাবীদের জ্বালাও পোড়াও আর লুটপাটের সঙ্গে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল দয়রামপুরের দুলজান ও হাসিমপুরের গ্রামের এলেজান ও মাসুদা। দেশ স্বাধীনের পর তাদের নির্যাতনের কাহিনী চাপা থাকলেও গণ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তাদের উপর শুরু হয় মানষিক নির্যাতন। স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও কতিপয় হুজুর মিলে তাদের উপর জারি করে ফতোয়া। সেই সুযোগে তাদের ছেলেমেয়েকে এলাকার অনেকেই ডাকতে শুরু করে খানের বেটা-বেটি। বন্ধ করে দেওয়া হয় কুয়া আর কলের পানি ছোয়া। তাদের ছেলেমেয়েরা বাধ্য হয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। প্রতিবেশীরা কথা বলা বন্ধ করে দেয় বড়দের সঙ্গে। ভয়ালো দিনের দুঃসহ যন্ত্রনা বুকে নিয়ে অসহায় দিন যাপন করতে থাকে এই তিন বীরাঙ্গনা নারী। প্রতিবেশীদের কারসাজিতে ভেঙ্গে যায় তাদের ছেলেমেয়ে ও নিকটাত্ত্ব¡ীয়ের বিয়ে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার-আলবদরদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীতে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূল জাতীয় সমম্বয় কমিটি” আন্দোলনের শুরু করলে এই তিন বীরাঙ্গনা গণ আদালতে সাক্ষ্য দিতে ঢাকায় যান। তাদের পারিবারিক সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া জেলার তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহমেদ তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ অনুষ্ঠিত গণ আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে গ্রামে ফিরেই তাঁরা বিরোধীদের রোষানলে পড়েন। আর তাদের স্বামীরা হাট-বাজারে ঠাট্টা মসকরার শিকার হয়। নানা উপহাস সয়তে হয় তাদের ছেলে-মেয়েদের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই তিন বীরাঙ্গনাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নেওয়া হয়। তাঁদের মুখে শোনেন সেই দিনের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী। চিকিৎসার জন্য তাঁদের সবাইকে শেখ হাসিনা পঞ্চাশ হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেন। সেই থেকে এলাকায় কিছুটা মর্যাদা পান তাঁরা। কিন্তু এরপরও নিন্দা উপহাস কমেনি। ঘোচেনি চির দারিদ্র দুঃখ-কষ্ট।

এলেজানের সুখ-দুঃখঃ
এলেজানকে অসতী আখ্যা দিয়ে তাঁর বড় মেয়েকে তালাক দিয়েছে শ্বশুর বাড়ির লোকজন। সেই থেকে মেয়ে বাবার বাড়ীতে। দুই ছেলে স্কুলে যেত নিয়মিত। অন্যরা উপহাস করত বলে বাদ দিয়েছে। ওদের বসয় এখন ১৫/২০। তাঁর স্বামী আকবর শেখ এখন অসুস্থ্য। তবুও কাজ করেন। ছেলেরা বেকার সংসারে দারুন টানাপড়েন। মুত্রাশয় রোগের আক্রান্ত এলেজান নিজেই। অন্য মেয়েদের একজন পরের বাড়ীতে কাজ করে। আর দু’জন শ্বশুর বাড়ীতে কোন রকমে টিকে আছে। এলেজান বলেন আমার বুকির ব্যারাম। ধরপড় করে সব সময়। ঔষুধ নাই তাই বুকি ত্যাল ঘসি। আকবর শেকের অনুমান একাত্তরের নির্যাতনের পর থেকে তার স্ত্রী অসুস্থ, বুকে ব্যাথা। ব্যাথা বাড়লে গ্রামের ডাক্তার বিষ বড়ি দেয় তাতেই উপশম হয়। এভাবেই চলছে নির্যাতিত নারীর সুচিকিৎসা। এতো কিছুর পরও এলেজানের বড়ো দুঃখ- তার “খোটা” বড় মেয়েকে “তালাক” দেওয়া। বিভিন্ন সময়ে এমন নানামুখী সমস্যায় এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা তাকে কোনোই সহযোগিতা করেনি বলে জানা যায়। একাত্তরের সে সব ঘটনা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে এলেজানের। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল।
 
মাসুদার ক্ষোভঃ
হাশিমপুরের আরেক বীরাঙ্গনা মাসুদা সঠিক জানে না তার কী হয়েছে। তার চিকিৎসক গোবিন্দ ঘোষ জানিয়েছেন, আলসার সহ গোপন রোগ। স্বামী মোফেল উদ্দিনের ধারনা, তার ক্যান্সার হয়েছে। কিছু খেতে পারে না। গত আট বছর শক্ত কিছু খান না তিনি। চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে তার স্বামী বিক্রি করেছেন সংসারের অনেক কিছু। মোফেল উদ্দিন উদ্বিগ্ন বউয়ের বেঁচে থাকা নিয়ে। তাদের তিন ছেলে দুই মেয়ে। ছোট ছেলে পড়াশুনা করে এবং অন্যরা কাজ করে চলে। একটি মাত্র ঘরেই সবার বসবাস। বেড়া নেই বলে পদ্মার চরের শীত কাপুনি দিয়ে প্রবেশ করে মাসুদার ঘরে। শীত এলে তাই কষ্ট বাড়ে। শরীরে রক্ত সংকট তার। মাঝে মধ্যেই তাকে রক্ত দিতে হয়। কেউ না দিলে হাসপাতাল থেকে রক্ত কিনে দিতে হয়। শেখ হাসিনার দেওয়া ৫০ হাজার টাকা ব্যাংকে রেখেছিল মাসুদার স্বামী। কিন্তু বিভিন্ন কাজে ব্যয় করেছেন মোফেল উদ্দিন। স্ত্রী চিকিৎসা তিনি করতে পারছেন না। আবার ভ্যান চালক ছেলের আয়ও সীমিত। মোফেল উদ্দিনের ধারনা, ভালো কোন চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করালে তার স্ত্রী ভালো হয়ে উঠতো। কিন্তু তার জন্য চাই টাকা। গ্রাম্য ডাক্তারের বাকিটাই গত হালখাতায় শোধ দিতে পারেনি তিনি। অথচ আবারো হালখাতা এসে গেলো। গভীর দুঃখের সঙ্গে গামছা ব্যবসায়ী যুদ্ধ দিনের নানা স্মৃতির বর্ণনা করেন। একই সঙ্গে তিনি তাদের বিয়ের কাহিনীও বলেন। তার ভাষায়, গন্ডগোলের ১০ বছর আগে শখ করে মাসুদাকে বিয়ে করেছিলাম। ও তখন খুব ছোট ছিল। তাই ওকে এখনো খুব ভালো জানি।

দুলজানের উপহাসঃ
মৃত তেজের আলী মন্ডল ছিলেন নদীভাঙ্গা কবলিত মানুষ। পদ্মা সব কিছু গ্রাস করলে চর থেকে তিনি এসে ঘর তোলেন পার্শ্ববর্তী দয়রামপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের তিন বছর আগে দুলজানকে বিয়ে করেন তেছের মন্ডল। একাত্তরে অন্য দুই নারীর মত তিনিও হন নির্যাতিত। পাকসেনারা রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করেছিল তার বুকে-পিঠে। সেই থেকে চিরস্থায়ী বুকের ব্যথা নিয়ে মূমুর্ষ অবস্থায় বেঁচে আছেন দুলজান। বয়স বাড়ছে ক্রমশ তাই শারীরিক উপসর্গও দিন দিন বড় আকার ধারন করছে। বুকের ব্যাথার কারণে সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়াতে পারেননি দুলজান। রাতে মাঝে মধ্যেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। তাদের দুই মেয়ে পাঁচ ছেলে। ছোটে মেয়ে পড়াশুনা করে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ৫০ হাজার টাকা ব্যাংকে রেখে প্রাপ্ত সুদ আর স্বামীর সামান্য আয় দিয়ে চলে সংসার। তার কষ্ট হয় তখন যখন কেউ তাকে “বীরাঙ্গনা” বলে উপহাস করে।

সম্প্রতি স্থানীয় হাসিমপুর বাজারে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় মাসুদার স্বামী মোফেল উদ্দিন ও এলেজানের স্বামী আকবর শেষের সঙ্গে। তাদের যৌথ অভিমত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া আমাদের ৫০ হাজার টাকা করে সাহায্য দিয়েছিলেন বলে এলাকার বিশেষ একটি মহল হিংসা করে। আর গণ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকে স্থানীয রাজাকাররা তাদের বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল করে। বীরাঙ্গনা এই তিন নারী আগে বিভিন্ন লোকজনের কথোপকথনে লজ্জা পেত, নিজেদের হীত ভাবত। এখন তাঁরা ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেপথ্যে তাঁদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবসে তাঁদের কেউ কোন দিন শ্রদ্ধা জানাতে যায়নি। এমনকি সাধারন মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে এই সব বীরাঙ্গনার ভূমিকার বিষয়টিও সেইভাবে প্রচার করা হয়নি। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও সংগঠনের কেউ কেউ তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে শুধু ছবি তুলে নিয়ে যায়। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন কিন্তু কোন দিনই কেউ আর ফিরে আসেনি বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা খরচ নিয়ে। ভারতের মেয়ে নয়মিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের ভূমিকা নিয়ে উচ্চতর গবেষণার কাজ করতে এদের সংস্পর্শে ছিল বেশ কয়েকদিন। এ সময় তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেছিলেন বীরাঙ্গনাদের নির্মম নির্যাতনের কাহিনী। পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তিনি আহবান জানিয়েছিলেন এলাকার বিশিষ্ট জনদের। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি……… ৪০ বছর কেটে গেলো।

লেখক: সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, পিএইচডি গবেষক ও অ্যাডভোকেট জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া।