আজ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ৪০তম শাহাদাৎ বার্ষিকী

খোকন আহম্মেদ হীরা ও উম্মে রুম্মান ॥ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ  অবদানের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব প্রাপ্ত বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ৪০তম শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ ১৪ই ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে তিনি শহীদ হন। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের রক্তে লাল হয়ে যায় চাপাই নবাবগঞ্জের মাটি। বাংলা মায়ের এই অমিত ত্যাজি সন্তানকে তার ইচ্ছানুযায়ী দাফন করা হয় চাপাই নবাবগঞ্জের ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ চত্বরে। বীরশ্রেষ্ঠের শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বরিশালের বাবুগঞ্জের আগরপুর (জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের) রহিমগঞ্জ গ্রামে তারই নামে প্রতিষ্ঠিত বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার মিলায়নাতনে স্মরন সভা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে জীবনের ঝুকি নিয়ে শিয়ালকোট থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বীর সেনানী ক্যাপ্টেন মহিউদ্দন জাহাঙ্গীর। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। পেয়েছেন বীর শ্রেষ্ঠ উপাধি কিন্তু এ উপাধিতে পেট ভরেরি তার পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদের । অসহনীয় দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করছেন দেশের শ্রেষ্ঠ এ সন্তানের ভাই ও অন্যান্য স্বজনরা। বৃদ্ধা মাতা স্বাধীনতার তিন যুগ ধরে স্বপ্ন দেখেছেন এলাকার দুঃস্থ মানুষের সেবায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার। সব সরকারের কাছে ধরনা দিয়েও স্বপ্ন পূরণ  করতে পারেনি তিনি।  এ কষ্ট নিয়েই ২০০৮ সালের জুলাই মাসে চির বিদায় নিয়েছেন বীর শ্রেষ্ঠের মাতা সাফিয়া খাতুন।

পরনে লুঙ্গী গায়ে গেঞ্জি মাথায় বাঁধা লাল গামছা পায়ে ক্যানভাসের জুতো এই ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তিনি ১৯৪৯ সালের ৮ই মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়ন বর্তমান নাম জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের করকোরাম এলাকায় ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে ক্যাপ্টেন হিসাবে যোগ দেন। একই বছরের ৩ জুলাই শিয়ালকোর্টের সিমান্ত দিয়ে পালিয়ে এসে যোগদেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে লেঃ কর্ণেল নুরুজ্জামান এর নেতৃত্বাধীন ৭ নং সেক্টরের মোহদিপুর সাব সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। বীর শ্রেষ্ঠ এই সন্তানের শেষ অভিযান ছিল চাপাই নবাবগঞ্জের বারঘরিয়ায়। ১২ই ডিসেম্বর শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অবস্থান নেন মহানন্দা নদীর ওপারে বারঘরিয়ায়। ১৩ই ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ৩ থেকে ৪টি নৌকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মাহানন্দা নদী পাড়  হয়ে সম্মুখ যুদ্ধে একের পর এক পরাস্থ করেন শত্র“ বাহীনিকে। স্বাধীনতার ২ দিন আগে ১৪ই ডিসেম্বর সকালে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শুরু করে যুদ্ধ। উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে ট্রেজ দখল করে ও এগিয়ে যেতে থাকেন বিজয়ের দিকে। বীরদর্পে এগিয়ে গিয়ে এ যুদ্ধে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করে পাকবাহিনীদের। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে শত্র“ পক্ষের একটি বুলেট তার কপালে বিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এই সাহসী সৈনিক। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তার সহকর্মীদের সে বলেছিলেন, মৃত্যু হলে আমাকে এ এলাকাতেই কবর দিও। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাকে ঐ স্থানে সমায়িত করা হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ এর পরিবারে একমাত্র জীবিত ছোটভাই মঞ্জুর রহমান বাচ্চু জানান, স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালে তার ভাইয়ের নামে তাদেরই দান করা জমিতে বাড়ির সামনে জাদুঘর নির্মিত হওয়ায় তারা খুশি কিন্তু এ জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের দর্শনার্থীদের জন্য যে সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকা দরকার তা নেই এখানে।  ২০০৮ সালের জুলাই মাসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশাল শেরে-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান বীরশ্রেষ্ঠের মা সাফিয়া খাতুন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যতদিন বেঁচে রয়েছিলেন তার মা ততদিন তার দাবিও স্বপ্ন ছিল নিজ গ্রামে হতদরিদ্র ও খেটে খাওয়া অবহেলিত মানুষগুলোর জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার। দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের কাছে এ দাবী জানিয়ে এলেও বীরশ্রেষ্ঠের মা তার স্বপ্ন নিয়েই অবশেষে মারা যান। তবুও তাই সে দাবী আজ শহীদ পরিবারসহ এলাকাবাসীর। স্থানীয় এলাকাবাসী মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জানান, বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরের সাথে আগরপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এখান থেকে অনেক দুরে অবস্থিত। তাই এই রহিমগঞ্জে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। জানা যায়, বীর শ্রেষ্ঠ এ পরিবারে এখন আর্থিক সংকট চলছে। সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনে তাদের অনেক পৈত্রিক সম্পত্তি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। বর্তমানে তাদের বাড়িটি ছাড়া যে সম্পত্তি আছে তা দিয়ে তাদের সারা বছর কাটে না। দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়া মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বাবা মায়ের প্রথম সন্তান ছিলেন। ২০০৪ সালের ৭ ফেব্র“য়ারী বীর শ্রেষ্ঠের বাবা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার মারা যান। বর্তমানে শহীদ পরিবারের জীবিত আছেন তার ছোট ভাই মঞ্জুর রহমান বাচ্চু (৫৯)। বড়বোন আলেয়া বেগম (৭২) ও ছোট বোন  মোসাঃ খালিদা রেবা বেগম (৫১)। তারা মোট তিন ভাই ও চার বোন ছিলেন। এদের মধ্যে এখন এ দুই বোন ও এক ভাই জীবিত রয়েছেন। একমাত্র ভাই মঞ্জুর রহমান বাচ্চু সেনানিবাসে ছোটখাট ঠিকাদারি করেন। তার সামান্য আয়েই চলে তাদের সংসার।

বীরশ্রেষ্ঠের জন্মভূমি রহিমগঞ্জ দেশের একটি মডেল গ্রাম হিসাবে গড়ে উঠবে যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা কোন কিছুরই অভাব থাকবেনা এ প্রত্যাশা ছিল এলাকাবাসীর। এলাকাবাসীর ভাবনা ছিল এ সব কিছুই করতে পারবেন বীরশ্রেষ্ঠের মা কিন্তু তিনিও এ সকল দাবী এবং স্বপ্ন নিয়ে মারা যান। তবুও তারা আশায় রয়েছেন যে কোন সরকার এক সময় না এক সময় এগিয়ে আসবেন বীরশ্রেষ্ঠের জন্মভূমি রহিমগঞ্জকে একটি মডেল গ্রাম হিসাবে গড়ে তুলতে।