নারী ধর্ষণ করে এদেশে উত্তারাধিকার রেখে যাওয়ার নীতি নিয়েছিল পাক বাহিনী

তিন. তারা নারীদের ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করে আটকে রাখতো। উদ্দেশ্য ছিল তাদের গর্ভবতী করা। তারা নারীদের কাপড় খুলে উলংগ করে রাখতো। এরপরও কিছূ মেয়ে সিলিংয়ের সঙ্গে মাথার চুল পেচিয়ে আত্মহত্যা করে। পরে কেউ যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে সেজন্য মাথার চুল কামিয়ে দেয়া হতো। যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে বীরঙ্গণা নারী যাদের উদ্ধার করা হয়েছিল তাদের সবার মাথার চুল কামানো ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরও পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙ্কারে আটকে রেখে নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে বাঙালী নারীদের। বিচারপতি কে এম সোবহান প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ‘ ১৮ ডিসেম্বর মিরপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি পাক আর্মিরা মাটির নিচে বাঙ্কার থেকে ২৩ জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথা কামানো নারীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। ’
চার: যুদ্ধের পর রাজধানীতেই অনেকগুলো অ্যাবরেশন সেন্টার খোলা হয়। বীর প্রতীক ডা. সেতার পারভীন একটি সাক্ষাতকারে এ বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। রাজধানীতেই ৫০টির মতো অ্যাবরেশন সেন্টার খোলা হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। ৭২ সালের প্রথম দিকেই ওইসব যুদ্ধ শিশু জন্ম নিতে শুরু করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে এদের জন্ম দেয়ার কাজটি সারতে সারাদেশব্যাপী গড়ে তোলা হয়েছিল বাইশটি সেবাসদন। এতে প্রতিদিন তিনশ’ থেকে চারশ’ শিশু জন্ম নিতো। ক্যানাডিয়ান ইউনিসেফ কমিটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর যুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। রেডক্রস প্রতিনিধি এবং ইউনিসেফের লোকজনের সংগে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অটোয়ার মূল অফিসে জানান যে, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া যুদ্ধ শিশুর সংখ্যা আনুমানিক দশ হাজার। আমাদের নারীরা চিরকালই ধর্ষিত হলে তা লুকিয়ে ছাপিয়ে রাখতে চান। সমাজের প্রকৃতিও এমনই। এজন্য মুক্তিযুদ্ধে কতজন ধর্ষিত হয়েছিলেন এ সংখ্যা হয়ত কোন দিনও জানা যাবেনা। জ্ঞানপাপী শর্মিলা বোস যুদ্ধের ৩৫ বছর পরে যতই ভ্রান্ত গবেষণা উপস্থাপন করুন না কেন। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির পুরোধা এমএ হাসান তার ‘The Rape of 1971: The Dark Phase of History’ এ দাবি করেন, ‘অ্যাবরেশন করানো নারীর সংখ্যা ছিল কমপে ৮৮ হাজার ২ শ’। ’৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার ধর্ষিত নারী এবং আরো ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারা বিলীন হয়ে গিয়েছিল বিশাল জনসমুদ্রে।’ তাদের হদীস তখন সরকারও রাখতে চায়নি। আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস জানান, ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল। যুদ্ধের পরপরই তিনি এসব মা ও তাদের শিশুদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার কাজের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৎকালীন দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার মতে, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রুণ স্থানীয় দাই, কিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে ‘নষ্ট’ করেছে। তবে ধর্ষন নিয়ে গবেষণা করেছেন আমেরিকার সাংবাদিক ব্রাউন মিলার। তিনি Against Our Will: Men, Women and Rape নামের এ গবেষণা কাজ টি ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন গর্ভধারন করেছিলেন বলে জানা যায় (ব্রাউন মিলার, ১৯৭৫ : ৮৪)। পৃথিবীর অন্য কোন যুদ্ধে এত ধর্ষনের শিকার কোন দেশের নারীরা হয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই। পাকিস্থানী কর্তৃপক্ষ একটি হিসাব দেখিয়ে বলেছে, এত কম সংখ্যক সৈনিকরা এত সংখ্যক ধর্ষণ ঘটাতে পারেনা। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ তাদের যুদ্ধের নীতিই ছিল নারীদের ধর্ষণ করা।
পাঁচ: পৃথিবীর অন্যান্য যুদ্ধে নারী ধর্ষণ ছিল সৈনিকদের ভোগের উদ্দেশ্যে। মুক্তিযুদ্ধে তা ছিলনা। তা থাকলে বাসা বাড়িতে গিয়ে নারীদের ধর্ষণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো তারা। কিন্তু তারা তা করেনি। নারীদের ধরে ট্রাক বোঝাই করেই ক্যাম্পে নেয়া হয়েছে। তাদের ট্রাক থেকে নামানোর আগেই অন্য সবার সামনে সৈন্যরা নারীদের ওপর হামলে পড়েছে। কমান্ডারদের জন্যও আলাদা নারী থাকতো। এটি ছিল সৈন্যদের রুটিন ওয়ার্ক। ব্রাউন মিলার লিখেছেন, একাত্তরের ধর্ষণ নিছক সৌন্দর্যবোধে প্রলুব্ধ হওয়া কোন ঘটনা ছিলনা আদতে; আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের নানী-দাদীর বয়সী বৃদ্ধাও শিকার হয়েছিল এই লোলুপতার। পাকসেনারা ঘটনাস্থলেই তাদের পৈচাশিকতা দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ; প্রতি একশ জনের মধ্যে অন্তত দশ জনকে তাদের ক্যাম্প বা ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হতো সৈন্যদের জন্য। রাতে চলতো আরেক দফা নারকীয়তা । কেউ কেউ হয়ত আশিবারেও বেশী সংখ্যক ধর্ষিত হয়েছে ! এই পাশবিক নির্যাতনে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, আর কতজনকে মেরে ফেলা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা হয়ত কল্পনাও করা যাবে না । (ব্রাউন মিলার, p. 83)
ছয়: মাদার তেরেসার একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে রয়েছে। যা পুরান ঢাকায় এখনো কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানটি যুদ্ধ শিশুদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। তাদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দত্তক নিয়ে গেছেন। মাদার তেরেসার সত্যিকার মহীরুহ হওয়ার কারণও এই যুদ্ধ শিশু। এত অ্যাবরশনের পরও অনেক শিশু জন্ম নিয়েছিল। কারণ অনেক মহিলাকে যুদ্ধের প্রথম দিক থেকে ধর্ষন শেষে আটকে রাখা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল যাতে বাচ্চার জন্ম হয়। এরা অ্যাবরশন করতে সুযোগ পাননি। মাদার তেরেসার প্রচেষ্টায় যুদ্ধ শিশুদের প্রথম ব্যাচ ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ক্যানাডায় পৌঁছলে তা মিডিয়ার ব্যাপক মনযোগ আকর্ষণ করে। পরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন এবং অষ্ট্রেলিয়াও যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে এগিয়ে এসেছিল । এখনও ওইসব শিশু বর্তমানে যারা যুবক হয়েছেন নীরবে বাংলাদেশ ঘুরে যান। বাংলাদেশের নারীদের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের সন্ধান করেন। আমার সঙ্গেও কয়েকজনের দেখা হয়েছিল। একটি হোটেলের ম্যানেজার আমার বন্ধূ তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। আমি দেখা করে তাদের সম্পর্কে লিখতে চাইলাম। তারা আত্ম সম্মান বোধ আর জন্ম নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে রাজি হননি।
সাত: পাকিস্থান এ বর্বরতম কাজকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যই হামিদুর রহমান কমিশন করেছিল। এ কমিশন পাকিস্থানী রাজনৈতিক কারণে তৎকালীন কয়েকজন রাজনীতিবিদকে দায়ী করে ধর্ষনের বিষয় স্বীকার করলেও ব্যাপক ধর্ষনকে দায়মুক্তি দিয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকারও ওই সময়ে যুদ্ধ শিশু আর ধর্ষনকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কারণ দেশের সামাজিক অবস্থা কখনোই এর পক্ষে ছিলনা। এ কারণে ওইসব শিশুদের যাতে দত্তক নিতে কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য অধ্যাদেশও জারি করা হয়েছিল। বিদেশী নাগরিকরা যাতে সহজেই যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে পারেন সে জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রজ্ঞাপিত হয় The Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order।
পুনশ্চ: কোন মুক্তিযোদ্ধা ধর্ষন লুটপাটের সঙ্গে জড়িত থাকতেই পারে। তারা প্রকুত মুক্তিযোদ্ধা নয়। একটি যুদ্ধকালীন সময়ে সুযোগসন্ধানী এসব লোকজন সহজেই ঢুকে যেতে পারতো। এক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। এজন্যও দায়ী পাকিস্থানীরা। কারণ যুদ্ধ তারাই বাধিয়েছে। একারণে যুদ্ধে যা হয়েছে তার সব কিছুর জন্যই তারা দায়ী। এর ক্ষতিপূরণও তারা দিতে বাধ্য। যুদ্ধ না বাধালে ওই সুযোগ সন্ধানীরা তো আর ধর্ষণ ও লুটপাটের সঙ্গে জড়াতে পারতোনা।

কয়েকটি লিংক দিলাম। এসব লিংকে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নারী ধর্ষনকে নীতি হিসেবে নিয়েছিল পাকিস্থানীরা।
Click This Link
http://www.sachalayatan.com/faruk_wasif/13453
http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=721
Click This Link
Click This Link

সায়েরার কাহিনী দেখুন যে রিপোর্ট করার সময়ও গর্ভবতী ছিল
http://www.youtube.com/watch?v=xwwPbkyZVJo
আর হ্যা, আমি যে জারজ সন্তানদের কথা বলেছিলাম। তারা এদেশেই রয়েছে। তাদের একজনের লেখা এ লিংকে পড়তে পারেন। এই ব্যাটা বলতে চেয়েছে, ধর্ষন পাক সৈন্যদের নীতি ছিলনা। Click This Link

Writer : সায়েমুজজ্জামান


মানবাধিকার ও সংবাদকর্মী। মত প্রকাশে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করিনা