ওরা অন্ধকারময় গ্রামে আলো ছড়াতে চায়

গ্রামের পরিচিতিঃ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সাবেক মাহিলাড়া ইউনিয়ন ও বর্তমান পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের একটি গ্রাম হচ্ছে দক্ষিন বিজয়পুর। এ গ্রামের লোক সংখ্যা ৮ হাজার ৫১৮ জন। এরমধ্যে ৪ হাজার ৪৩৮ জন পুরুষ ও ৪হাজার ৮০ জন মহিলা। গ্রামটি অতিদরিদ্র অশিক্ষিত গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এখানকার অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর। রিকসা চালিয়ে ও দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালায়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করে। গৌরনদী উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার ননী গোপাল জানান, এ গ্রামে শিক্ষিতর হার খুবই কম। অধিকাংশ লোকই অতিদরিদ্র।

উদ্যোক্তা যারাঃ গ্রামটি থেকে অশিক্ষা দূর করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার শপথ নিয়েছে এমনই একজন হচ্ছে, সরকারি গৌরনদী কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমিরুল ইসলাম। আমিরুল জানায়, দারিদ্রতার কারনে এ গ্রামের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শিশুদের পড়াশুনা শিখাতে এ গ্রামের বাবা মায়েরা তেমন আগ্রহী নন। শিশুরা বুঝে ওঠার সাথে সাথেই তাদের অভিভাবকরা অর্থ উপার্জনের জন্য গ্যারেজ, ওয়ার্কসপ, রিকসা চালক কিংবা দোকানের কাজে নিয়োজিত করে দেয়। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে শিশুদের কি করে পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনা যায়? কি করে শিশুদের পড়াশোনা শেখাতে অভিভাবকদের আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়। এ নিয়ে পরামর্শ করার জন্য একই গ্রামের সরকারি গৌরনদী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র হাসান মাতুববর, স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র পলাশ সরদার, দশম শ্রেনীর ছাত্র শিপন সিকদার, শামীম আহম্মেদ, আসলাম সিকদার ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে এক বৈঠকে বসে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অভিভাবদের বুঝিয়ে শিশুদের পড়াশোনা শিখানোর দায়িত্ব গ্রহন করে। গ্রামের মধ্যে থাকা পরিত্যক্ত একটি দোচালা ঘরে ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০ জন শিশুদের নিয়ে আলোকিত গ্রাম গড়ার যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে শিশু থেকে চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত অর্ধশত শিক্ষার্থী রয়েছে। উদ্যেক্তারা জানান, নিজেদের পড়াশুনা ঠিক রেখে তারা প্রতিদিন বিকেলে নিয়মিতভাবে এসব শিশুদের পাঠদান করিয়ে থাকে। শিক্ষারত শিশুদের বিনামূল্যে সরবারহ করা হয় বই, খাতা, কলম ও পেন্সিল।

বয়স্কদের স্বাক্ষর জ্ঞান দানঃ মোর বাবা দিন মজুরের কাম কইর রা কোন রহম সোংসার চালাইতো, মোগো লেহাপড়া করাইতে পারে নাই, মোরা লেহাপড়া শিহি নাই। যহন বয়স ৮ বছর তহন থেইক্কা রিকসা চালাই। নিজের নাম লেখতে পারতাম না, এহন গ্রামের পোলাপানের উসিলায় নাম লেখতে পারি বেশ খুশি লাগে। স্বাক্ষর শিখে এভাবে নিজের অনূভুতির কথা জানালেন দক্ষিন বিজয়পুর গ্রামের রিকসা চালক ইব্রাহিম সরদার (৫০)। এখানে শিশুদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি অশিক্ষিত বয়স্কদের স্বাক্ষর শেখানো হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দিনমজুর, রিকসা চালক ও কৃষকদের স্বাক্ষর জ্ঞান শিখানো হয়।

অর্থ সংগ্রহঃ আলোকিত গ্রাম গড়ার অন্যতম উদ্যোক্তা কালাম সরদার ও ফিরোজ সিকদার জানান, এখানকার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই, খাতা, পেন্সিল, কলম সরবারহ করার অর্থ সংগ্রহ করার জন্য তারা গ্রামের পরিত্যক্ত জমি, সড়কের দু’পাশ ও জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ করে তা বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। তাছাড়া স্থানীয় উঁচু ভিটা লিজ নিয়ে পেঁপে চাষ করে তা বিক্রি করে আয়কৃত অর্থ শিশুদের পড়াশোনার কাজে ব্যয় করা হয়।

শিক্ষকঃ বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে শিশুদের শিক্ষাদান করছে গ্রামেরই সন্তান আমিরুল ইসলাম, কাওসার খলিফা, আল-আমিন সরদার, মুন সরদার, আনোয়ার সরদার ও আল-আমিন মাতুব্বর। এরা একেকদিন একেক জনে শিশুদের শিক্ষাদান করছে।

লক্ষ্য উদ্দেশ্যঃ অশিক্ষার কারনে আদিকাল থেকে এ গ্রামটি পিছিয়ে রয়েছে। গ্রামটির অধিকাংশ লোকজন অশিক্ষিত ও অতিদরিদ্র। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এ গ্রামের শিশুরা। এসব শিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত গড়ে তোলা। গ্রামে শিক্ষার উন্নয়ন করা। অশিক্ষাকে দূর করে আলোকিত গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা। দারিদ্র মুক্ত গ্রাম গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করা। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোকে শিক্ষার সুযোগ দেয়া। শিক্ষার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গ্রামের অভাব দূর করা। অশিক্ষিত স্বাক্ষরজ্ঞানহীন বয়স্কদের স্বাক্ষর শেখানো। গ্রামের দরিদ্র লোকজনকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা। গ্রাম থেকে নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ, যৌতুক প্রথা প্রতিরোধ করে সুন্দর ও আলোকিত একটি গ্রাম গড়াই হচ্ছে উদ্যোক্তাদের মূল লক্ষ।

সামাজিক কর্মকান্ডঃ শিশুদের পাঠদানের সাথে সাথে উদ্যোক্তারা স্থানীয় ছাত্র, কিশোর-যুবকদের উদ্ধুদ্ধ করতে এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা ঘাট মেরামত করাসহ গ্রামের মানুষের বিপদে তাদের পাশে গিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তারা। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। যেখানে যৌতুক, বাল্য বিবাহ সেখানে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অল্প দিনের মধ্যেই এলাকায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছে এসব ছাত্র-কিশোররা।

স্থানীয়দের কথাঃ দক্ষিন বিজয়পুর গ্রামের ব্যবসায়ী মোঃ ফিরোজ সিকদার (৩৬) জানান, মোগো গ্রাম থেকে অশিক্ষা দূর করতে পোলাপানে যে কাম শুরু করছে তাতে সামনের দিনে গ্রাম আর আন্ধারে থাকবে না। মোরা আলোর মূখ দেখতে পারমু। একইভাবে আনন্দ প্রত্যাশার অনুভূতির কথা জানালেন স্থানীয় মোঃ শাহ আলম সিকদার (৫৫), নুর মোহাম্মদ (৬০), সোমেদ আলী সরদার (৭২), আজাহার হাওলাদার (৬০), মোখলেচুর রহমান (৬৫)। ৭ নং ওয়ার্ডের সাবেক পৌর কাউন্সিলর মোঃ জামাল হোসেন বাচ্চু বলেন, গ্রামের ছাত্র ও কিশোররা গ্রামের ভালোর কথা চিন্তা করে যে কাজ শুরু করেছে তা সত্যিই প্রসংশিত। যা অন্যান্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। তিনি উদ্যোগি এ সকল ছাত্র-কিশোরদের সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য সমাজের মহানুভব সমাজপতি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

Writer : Khokon Ahmed Hira

Gournadi.com