ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থায় রুপান্তরকল্পে বিবেচ্য প্রারম্ভিক বিষয়াবলী

মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেনঃ বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের নির্বাচনী ইসতেহারে বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি অংশের ১১.১ নং অনুচ্ছেদের একাংশে বলা হয়েছে সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রমের বর্তমান ফাইল ব্যবস্থাপনাকে ই-গর্ভমেন্ট বা ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থায় রুপান্তর করা হবে ও জনগণকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবাদান নিশ্চিত করা হবে এবং ১১.৪ নং অনুচ্ছেদের একাংশে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃত্বাধীন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক টাস্কফোর্স সক্রিয় ও কার্যকর করা হবে। সে অনুযায়ী সরকার তার প্রশাসনিক কার্যক্রমও শুরু করেছেন যা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার।

সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের নাগরিক সনদ অনুযায়ী ভোক্তাদের দোরগোড়ায় সরকারের সেবা পৌছে দেয়া আধুনিক বাংলাদেশ (ই-গর্ভমেন্ট বা ডিজিটাল সরকার) বিনির্মানের পূর্বশর্ত। ই-গর্ভমেন্ট বা ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে তার সাথে সম্পৃক্ত যে বিষয়টি এসে যায় তা হলো ই-গর্ভনেন্স। ই-গর্ভমেন্ট ও ই-গর্ভনেন্স শব্দ দুটির সাথে আমরা মোটামোটি অনেকেই পরিচিত রয়েছি। শব্দ দুটি একই রকম মনে হলেও তাদের মধ্যে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পার্থক্য রয়েছে বিস্তর। তাই আলোচনার শুরুতেই শব্দ দুটি বিশ্লেষণ করা বাঞ্চনীয় বলে মনে করছি। সরকার পরিচালনার দায়ীত্বে যারা আছেন (আমরা যাদের সরকারী আমলা বলে অভিহিত করি) তাদের মধ্যকার ইলেক্ট্রনিক আন্ত-যোগাযোগ ব্যবস্থাই হলো ই-গর্ভমেন্ট। আন্ত-যোগাযোগ বলতে সরকারী প্রয়োজনে এক মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তর/জেলা/উপজেলা তথা মাঠ পর্যায়ে স্থাপিত সরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তর/জেলা/উপজেলা তথা মাঠ পর্যায়ে স্থাপিত সরকারী প্রতিষ্ঠানের বা একই  প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ বা বিজ্ঞানের ভাষায়- Sharing information/resources to each other by electronic means. পক্ষান্তরে সরকারের সাথে দেশের আপামর জনসাধারনের যে ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ তাই হলো ই-গর্ভনেন্স। এখন প্রশ্ন হলো ই-গর্ভমেন্ট বা ই-গর্ভনেন্স এর প্রয়োজনটাই বা কি? বর্তমান এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে যেখানে আমরা বাংলাদেশে বসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রকাশিত রিসার্চ পেপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে পারি। সেখানে এই দেশে অবস্থান করে এই দেশেরই তথ্য পেতে দিনের পর দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতে হয়। যা সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিদের দুর্নিতির সাথে সম্পৃক্ত হবার পথ সুগম করে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো ই-গর্ভমেন্ট এবং ই-গর্ভনেন্স বা ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা।

এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার ইলেক্ট্রনিক আন্ত-যোগাযোগ ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের অভ্যন্তরীন প্রয়োজনের উপর ভিত্তিকরে আইসিটি সংশ্লিষ্ট কোন উন্নয়ন (সফটওয়ার/হার্ডওয়ার সংশ্লিষ্ট) করে তবে সে প্রতিষ্ঠান হয়তো তাদের নিজস্ব গন্ডির মধ্যে আন্ত-যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আন্ত-যোগাযোগ দূরহ হবে বইকি। এমনকি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি পৃথক- পৃথক ভাবে নিজস্ব ধ্যান-ধারনায় আইসিটি সংশ্লিষ্ট কোন উন্নয়ন (সফটওয়ার/হার্ডওয়ার সংশ্লিষ্ট) করে তবে সরকারী অর্থের অপচয় হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে হাতে নেওয়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজের মধ্যে এখনো পর্যন্ত কোনো সমন্বয় নেই। একেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ একেকভাবে কাজ করছে। এক মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে জানে না অন্য মন্ত্রণালয়। সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এ জন্য একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার কর্তৃক জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ গৃহীত হয়েছে। একটি মাত্র রুপকল্প, ১০টি উদ্দেশ্য, ৫৬টি কৌশলগত বিষয়বস্তু এবং ৩০৬টি করণীয় বিষয়কে এ নীতিমালায় পিরামিড আকারে ক্রমবিভক্ত করে সাজানো হয়েছে। ৩০৬টি করণীয় বিষয় এর মধ্যে ক্রমিক নম্বর ৯৬তে বলা হয়েছে‍ “সরকারী পর্যায়ের সকল প্রতিষ্ঠানে আইসিটি পেশাজীবী দ্বারা সজ্জিত আইসিটি সেল স্থাপন। এ সেলের জন্য আইসিটি সংশ্লিষ্ট পদ সৃজন করা। সরকারী পর্যায়ের সকল আইসিটি সংশ্লিষ্ট পদকে কারিগরি পদ হিসেবে চিহ্নিতকরণ”। যেহেতু সরকারী পর্যায়ের সকল প্রতিষ্ঠানে আইসিটি পেশাজীবী দ্বারা আইসিটি সেল স্থাপন করা হবে (আমার জানামতে ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে আইসিটি সেল স্থাপন করা হয়েছে) তাই সরকার চাইলে সহজেই আইসিটি সংশ্লিষ্ট কোন উন্নয়ন (সফটওয়ার/হার্ডওয়ার সংশ্লিষ্ট) করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে। সব কাজের মধ্যে থাকতে হবে সমন্বয়। এখানে ছোট একটি বাস্তব উদাহারণ দেয়টা সমীচীন বলে মনেকরছি- সরকারের পক্ষ হতে নতুন কোন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হলে পরবর্তিতে প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ ও ছাড় করার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা হতে একটি কোড নম্বর (প্রকল্পের কোড নম্বর বলে পরিচিত) দেয়া হয়। অন্যদিকে আইএমইডি প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য তাদের কম্পিউটার সেল এর ডাটাবেস-এ প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করে। আমরা জানি প্রতিটি প্রকল্পই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সমাপ্ত হয়। প্রকল্প সম্পাপ্তির পরও সে সংক্রান্ত সরবরাহকৃত সকল তথ্য আইএমইডি’র ডাটাবেস-এ সংরক্ষিত থাকে। পক্ষান্তরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েক বছর পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা হতে নতুন অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের বিপরীতে পূর্বের সমাপ্ত হওয়া প্রকল্পের কোড পুনরায় ব্যবহার করা হয়, এতে করে নতুন প্রকল্পের তথ্য যখন ডাটাবেস-এ এন্ট্রি করা হয়, ডাটাবেস সফটওয়ার সাধারণভাবেই পূর্বের একই কোডের বিপরীতে এন্ট্রি করা প্রকল্পের তথ্যের উপর রিপ্লেস হয়ে যায় বা কনফ্লিক্ট করে অর্থৎ রিপ্লেস করা হলে পূর্বের সমাপ্ত হওয়া প্রকল্পের তথ্য মুছে গিয়ে নতুন এন্ট্রি করা তথ্য সংরক্ষিত হয়, যা কখনোই কাম্য নয়। আর কনফ্লিক্ট এড়ানোর জন্য আইএমইডি কর্তৃক বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পূর্বের সমাপ্ত হওয়া প্রকল্পের তথ্য সংরক্ষণ করার লক্ষে মনগড়া একটি কোড নম্বর দিয়ে সেইভ করে রাখা হয়। এতে করে পরবর্তিতে সমাপ্ত হওয়া প্রকল্প সংক্রান্ত চাহিত প্রয়োজনীয় পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সরবরাহ করা জটিল ও সময় স্বাপেক্ষ হয়ে পরে। এমতাবস্থায়, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, জেলা, উপজেলা তথা মাঠ পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন এবং এতদসংক্রান্ত কার্যক্রমের সমন্বয় সাধণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

তবে আশার কথা এইযে, গত ০৩ আগস্ট ২০১০খ্রি: তারিখে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স এর সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কিত একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে সারাদেশে আইসিটি সম্প্রসারনের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। বর্তমান আইটি বিশ্বে আইসিটি মন্ত্রণালয় থাকার গুরুত্ব অনেক। এর ফলে দেশের আইটি খাত আরও চাঙ্গা হবে। বিদেশের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় আইটি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও বাড়বে বলে আশা করি।

সেমোতাবেক উক্ত মন্ত্রণালয় একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সমন্বয় সাধণের লক্ষ্যে। এছাড়া সকল বা একাধিক সরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহারোপযোগী তথ্য প্রযুক্তি ভিত্তিক কমন সিস্টেম আইসিটি সেলসমূহের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজাইন, উন্নয়ন, বাস্তবায়ন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং কমন সিস্টেমসমূহ পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য প্রযুক্তি অবকাঠামো নির্মাণের কাজও করতে পারে উক্ত মন্ত্রণালয়। যেমন বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তর হয়ত একই সফটওয়ার স্বস্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে সংগ্রহ করছে নিজস্ব ব্যয়ে, কিন্তু সমন্বয় থাকলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এটা নিজেরা তৈরী করে/ক্রয় করে অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করতে পারত, এতে করে আর্থিক সাশ্রয়সহ সময় ক্ষেপণ হতনা ও একই সাথে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাইজ করা সম্ভব। এমনকি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তর/জেলা/ উপজেলা তথা মাঠ পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে সর্বস্তরে বিদ্যমান আইসিটি পেশাজীবিদের নিয়োগ/পদন্নোতি/পদায়ন/বদলী ও সমন্বয় সাধনের কাজ একক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পাদন করা যাবে। এই মন্ত্রণালয় দুই/তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বাস্তবায়নের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। সারাদেশের মানুষ তাকিয়ে দেখবে কিভাবে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। আপাতঃদৃষ্টিতে পরিবর্তণকে বাধা মনে হলেও, যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারলে পরিবর্তণকে আলিঙ্গন করে নেবে সবাই। আমরা সবাই মিলিত হব জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বাস্তবায়নের মহামিছিলে! আর বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ স্থান করে নেবে দুর্নীতিমুক্ত, সভ্য ও আধুনিক ধ্যান ধারনার নব্য সহযাত্রী হিসেবে।

[লেখকঃ প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।]