কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে মহাজোট সরকার

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তিন বছর পেরিয়ে ৪র্থ বছরে পা রাখলো। প্রথম ৩ বছর ভালোয় ভালোয় পেরিয়ে এলেও মেয়াদের শেষ দুটি বছরে সরকারকে অনেকগুলো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। এরমধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, যুদ্ধাপরাধ বিচার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, পুঁজিবাজার চাঙ্গা করা ও অর্থনৈতিক সংকট নিরসন, মানবাধিকার সুরক্ষা, পদ্মাসেতু নির্মাণ ও সড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি ও টিপাইমুখ সমস্যার সম্মানজনক সমাধান, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানি সংকট সামাল দেয়াÑ এই ১০টি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে সরকারকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সাফল্য-ব্যর্থতার মিশেলে ৩টি বছর পার করেছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে উল্লেখ করার মতো অনেক সাফল্য আছে সরকারের। অন্যপিঠে ব্যর্থতাও কম নয়। তাও দেশ পরিচালনায় নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে বেশ দক্ষতারই পরিচয় দিয়েছে সরকার। ক্ষমতারোহনের দুমাসের মাথায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ছাড়া তেমন আর কোনো বড় বিপদে পড়তে হয়নি সরকারকে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তাদের অভিযোগ, সে ষড়যন্ত্র এখনো থামেনি। এই ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার পাশাপশি সরকারের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা এবং অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার চ্যালেঞ্জও আছে সামনে। আবার সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান লেগেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। বিশেষত হবিগঞ্জের একটি আসনের উপ-নির্বাচনে এবং ৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় সরকারের জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে মহাজোট সরকারের শেষ দুবছর কুসুমাস্তীর্ণ হবে না বলেই মনে করছেন অভিজ্ঞজনরা।

বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে এই দুবছরে সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারার ওপরই নির্ভর করছে সরকারের ভবিষ্যৎ। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখন খুবই নাজুক। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের প্রতিবাদে ও যুদ্ধাপরাধ বিচার ঠেকানোসহ নানা ইস্যুতে মারমুখো বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। যে কোনো মূল্যে সরকারের ‘পতন ঘটাতে’ মরিয়া তারা। এরই মধ্যে হরতাল-ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওসহ ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে বিরোধী দল।

আগামী দিনগুলোতে বিরোধী দলের আগ্রাসী আচরণ আরো বাড়বে বলেই অনেকের আশঙ্কা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন আগামীকাল চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হবে সরকার পতনের চূড়ান্ত কর্মসূচি। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সরকারের জন্য হবে সুকঠিন কাজ। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, তত্ত্বাবধায়ক বিতর্ক, যুদ্ধাপরাধ বিচারসহ বিদ্যমান ইস্যুগুলো সরকার কিভাবে সামাল দেয়, তাই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। মহাজোট সরকারের প্রথম ৩ বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলের তুলনায় অনেক ভালো ছিল বলে দাবি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের। সুধী মহলের অনেকেও তার সঙ্গে একমতই পোষণ করেছেন। বিশেষত জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস দমনে সরকারের সাফল্য দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যার ঘটনা, নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবু হত্যা, নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হত্যা, সিলেটে বাসযাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাসহ বেশ কিছু ঘটনা সরকারের এই অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি হানাহানির দিকে গেলে আইনশৃঙ্খলা আরো নাজুক হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে।

যুদ্ধাপরাধ বিচার এ সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার। তরুণ প্রজন্ম এই প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়ে ভোট দিয়েছে মহাজোটকে এ মন্তব্য স্বয়ং মহাজোট নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাই প্রতিশ্রুতি পূরণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করেছে সরকার। তবে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, এ বিচার কাজ চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। মেয়াদের ৩ বছর পেরিয়ে বিদায়ী বছরের শেষপ্রান্তে এসে শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার। সরকারের মেয়াদে এ বিচার শেষ করা সম্ভব হবে কিনা তাই নিয়ে আশঙ্কা অনেকেরই। অব্যশ্য প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধ বিচার হবেই এবং তা এই সরকারের মেয়াদেই। এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বৈকি।

আওয়ামী লীগের নির্বচনী ইশতেহারে ৫টি বিষয়ে অগ্রাধিকারের প্রথমটিই ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা। ইশতেহারে বলা হয়েছিল- দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সরকার গত ৩ বছরে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। জিনিসপত্রের দাম কমানোর জন্য সরকার বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপের কথা বললেও তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। মহাজোট সরকার গঠনের সময়ে মোটা চালের প্রতি কেজির মূল্য ছিল ২৬ টাকা। বর্তমানে এর দাম ৩২ টাকা। তখন আটার কেজি ছিল ২৩ টাকা। তা বেড়ে এখন হয়েছে ৩০ টাকা। ৯০ টাকা লিটার সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা। নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও গত ৩ বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি সরকার। টিসিবিকে কার্যকর করতে পারেনি। ফলে এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে না গেলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ভুগিয়েছে সরকারকে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তার সরকার ভোগ্যপণ্যের দাম কমিয়েছে। আগামী ২ বছরে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করাই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। নিদারুন যানজট রাজধানীর জনজীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। যানজট নিরসনে লেন পদ্ধতি, স্কুলের সময় পরিবর্তন, মার্কেটগুলোতে এলাকাভিত্তিক ছুটি নির্ধারণসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

এ সমস্যার সমাধানে সরকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পাতাল রেল, মেট্রোরেলসহ নানান উদ্যোগের কথা বললেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। ঢাকাকে যানজটমুক্ত করা না গেলে সরকারের অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে। তিন বছর বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানি সংকট সরকারকে বিব্রত করছে নিরন্তর। তবে এখন পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও এই খাতে ঘাটতি আছে এখনো। হাজার হাজার বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদন পড়ে আছে। রাজধানীতে গ্যাস ও পানি সংকটের সুরাহা হয়নি এখনো। আগামী ২ বছরে এ ব্যাপারে অনেক কাজ করতে হবে সরকারকে। দেশের পুঁজিবাজারে ধস এই সরকারের কপালে একটি কলঙ্ক তিলক হয়ে আছে। গত বছর পুঁজিবাজার সামাল দিতে ব্যর্থতার কারণে সরকারের সমালোচনা হয়েছে এন্তার। অবশেষে বছরের শেষ দিকে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগী হন পুঁজিবাজারকে সংকটমুক্ত করতে। তার সুফলও দৃশ্যমান। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখার পাশাপাশি দেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন অভিজ্ঞমহল। বিশেষত মূল্যস্ফীতি, তারল্যসংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া সরকারকে ভোগাবে বলেই অনেকের আশঙ্কা।

পদ্মাসেতু নির্মাণ নিয়ে অচলাবস্থা ও নাজুক সড়ক যোগাযোগ সরকারকে বিব্রত করেছে গত ৩ বছরে। পদ্মাসেতু-দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে মন্ত্রণালয় বদল হয়েছে যোগাযোগমন্ত্রীর। এসেছেন নতুন মন্ত্রী। আর সড়ক-মহাসড়কের বেহালদশা নাস্তানাবুদ করেছে সরকারকে। মেয়াদের বাকি দিনগুলোতে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদ্মাসেতু নির্মাণ ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মহাজোট সরকারের ৩ বছরে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছেÑ খোদ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানই এ কথা স্বীকার করেছেন। তারপরও মানবাধিকার নিয়ে সচেতন মহলের উদ্বেগ কমেনি। র‌্যাবের গুলিতে লিমনের পঙ্গু হওয়া, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র কাদেরকে অকারণে ধরে নিয়ে ডাকাত বানানোর ঘটনা সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এই ৩ বছরে র‌্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার কমলেও এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ হয়নি। আবার ঘটে গেছে বেশ কিছু গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা। মানবাধিকারকর্মীরা এসব গুম ও গুপ্তহত্যার জন্য অভিযোগের আঙুল তুলেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই। এসব কারণে মানবাধিকার নিয়ে সরকারের সমালোচনাও থামেনি। আগামী দিনগুলোতে মানবাধিকারের উন্নতি সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে করতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে অভিন্ন নদী তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি অন্যতম। মনোমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় দেশের মানুষ হতাশ হয়েছে যা সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারতের মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে বরাক নদীর ওপর বাধ নির্মাণের বিষয়টি বাংলাদেশে সরকারবিরোধী রাজনীতির এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার মেয়াদে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন ও টিপাইমুখ ইস্যুর সম্মানজনক সমাধান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই ১০টি চ্যালেঞ্জ ছাড়াও ছোট-বড় আরো অনেক চ্যালেঞ্জ মহাজোট সরকারের সামনে। এসব চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করা সহজ নয়। তবে মহাজোটের প্রধান নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার ৩ বছরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে নিরলস চেষ্টা করেছে। বাকি ২ বছরে সব প্রতিশ্র“তি পূরণ করতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি।
খবর: আজকের বাংলা