হাজার হাজার মানুষের ঢল – আগৈলঝাড়ায় গ্রাম বাংলার দু’শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহি মারবেল খেলার মেলা

ওমর আলী সানি, আগৈলঝাড়া ॥ আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা হিসেবে দু’শ বছরের পুরনো মারবেল খেলার মেলা গতকাল রোববার ও সোমবার অনুষ্ঠিত হয়েছে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রামানন্দের আঁক গ্রামে। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেলায় বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলা সহ, পাশ্ববর্তী গোপালগ জেলার কোটালীপাড়া, কালকিনী, ফরিদপুরের রাজবাড়ি সহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সকল বয়সের হাজার-হাজার নারী-পুরুষেরঢল নামে এবং তারা জারজারমত অংশগ্রহন করে। খেলায় নরী পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই। জানাগেছে উপজেলার রামানন্দের আঁক গ্রামে আড়াই’শ বছর পূর্বে সোনাই চাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের ৭ বছর বয়সে স্বামী মারা যায় নিঃসন্তান অবস্থায় আর ওই বাড়ির একটি নিম গাছের গোড়ায় বিধপা সোনাই স্বমীর নামে পূজা-অর্চনা ও ধ্যান করতো। তার মৃত্যুর পরে ওই বাড়িটি সোনাই আউলিয়ার বাড়ি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করে। প্রতি বছর এই দিনটি উপলক্ষে ওই বাড়িতে বৈষ্ণব সেবা, সংকৃর্ত্তন, কবিগান শেষে সোয়ামন চালের গুড়ার সাথে গুড়, নারকেলসহ অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নবান্ন তৈরী করে মেলায় আগত দর্শনার্থিদের প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয়।

প্রতিবছর, পৌষ সংক্রান্তিতে বাস্তপূজা উপলক্ষে দু’শ বছরের অধিক সময় পর্যন্ত এ গ্রামে এই দিনটিতে মারবেল খেলার মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মারবেল খেলার মূল রহস্য সম্পর্কে স্থানীয় প্রবীন হরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস (৮০), হরবিলাস মিস্ত্রী (৭৫) ও বুদ্ধি হালদার (৭২) তারা বলেন, দু’শ বছরের অধিক সময় যাবৎ এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাপ-দাদারা এ খেলার (মেলা) আয়োজন করে আসছিল তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রতিবছর এ খেলার আয়োজন করে আসছি। এদিনটিকে ঘিরে রামানন্দের আঁক গ্রামে মহাউৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। স্থানীয়রা তাদের মেয়ে-জামাতাকে পর্যন্ত এ মেলায় মার্বেল খেলার জন্য আমন্ত্রন জানিয়ে আসছে। মেলা উপলক্ষে চিড়া, মুড়ি, খেজুর রসের গুড়ের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে এলাকায়। এ বছরও মেলার প্রধান আকর্ষণ হিসেবে রয়েছিল মেয়েদের মারবেল খেলার প্রতিযোগতা।

সরেজমিনে দেখাগেছে, প্রায় ৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মেলা বসেছে। মাঠ, রাস্তার ওপর,বাড়ির আঙ্গিনায়, অনাবাদি জমি, বাগান সহ সর্বত্রই মার্বেল খেলার আমেজের সাথে বসে মেলার আমেজ।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছে প্রদীপ দাস (৩৫) তিনি জানান মারবেল খেলার কথা শুনে মেলায় এসেছি। সব বয়সের নারী-পুরুস একসাথে মারবেল খেলতে দেখে আনন্দ পেয়েছি।
রাজবাড়ি জেলার বালিয় কান্দীর বাসিন্দা রবীন্দ্র নাথ রায় (৮২) তার মেয়ের জামাই মিহির বিশ্বাসের বাড়ি আগৈলঝাড়া উপজেলার রামানন্দের আঁক গ্রামে মেলার একদিন পূর্বেই মেলা উপভোগ করার জন্য এসেছি। তিনি বলেন, গ্রমা বাংলার বেতিক্র  মেলাটি উপভোগ করতে ভলো রেগেছে
এক তরুনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক,বলেন ছেলেরা শুদু মারবেল খেলে সামাজিক কারনে মেয়ের ইচ্ছা থাকলেও তারা খেলতে পারেনা , এই দিনটি উপলক্ষ্যে আমরা মনের ইচ্ছাটি পুরন করতে পারি। তাই মেয়েরা এই দিনটির অপেক্ষা থাকে।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা থেকে সমীর বিশ্বার (২৮), পলাস রায় (২৫), জুয়েল সমদ্দার (২৩), মিলন বিশ্বাস (২৪), টিটু সমাদ্দার (১৯) ও মনতোষ সমদ্দার (২০) জানান, আমরা মারবেল খেলার মেলার কথা ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি। আমরা প্রায় ৬ মাস পূবে থেকে বন্ধুরা সিধান্ত নিয়েছিলাম এই মেলাতে আসবো তাই এবছরই প্রথম এসেছি। ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলা দেখতে আমাদের অনেক ভাল লেগেছে। এছাড়াও সকালে মেলা উপলক্ষে বাস্ত পূজার প্রসাদ খেতেপেরেও আনন্দো পেয়েছি। উপজেলার রাজিহার গ্রামের বিমল বাড়ৈর ছেলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র বিপ্লব বাড়ৈ (১২) বলে, সারা বছর মারবেল না খেললেও মারবেল কেনার জন্য টাকা জমিয়ে প্রতি বছর এই দিনটির অপেক্ষায় থাকি। মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা শ’শত টাকার মারবেল বিক্রী হয়। শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, কিশোরী, যুবক-যুবতীরা মেলার প্রধান আকর্ষণ মারবেল খেলায় অংশগ্রহন করেন। মার্বেল খেলাকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে বড় রকমের মেলার আয়োজন। যা দিনব্যাপী হলেও চলে প্রায় ৩-৪ দিন পর্যন্ত। এছাড়াও বাস্তপূজা উপলক্ষে স্থানীয় মন্দিরে পূর্জা-অর্চনারও আয়োজন করা হয় শেখানে অনেকের মানত থাকে অনেকের। মেলা উপলক্ষে গত শনিবার থেকে ওই গ্রামের নিকট আত্মীয়-স্বজনসহ দুরদুরন্ত থেকে হাজার-হাজার লোকজনের সমাগম ঘটে আগেথেকে।

মেলা পরিচালনার জন্য শিক্ষক যতিষ চন্দ্র বাড়ৈকে সভাপতি করে ৩৭ সদস্য একটি মেলা উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়। এ বিষয় কমিটির সভাপতি যতিষ বাড়ৈ জানান, মেলায় মারবেল খেলার জন্য অনেকে দুর-দুড়ান্ত থেকে এসেছেন তাদের জন্য পূর্ব থেকেই ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এজন্য মেলায় ব্যাপক পুলিশ মেতায়ন এছাড়াও আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে ৬০ জন ভলান্টিয়ার সার্ব ক্ষণিক কাজ করছে। মেয়েদের জন্য ভ্যানু না থাকার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামীতে মেয়েদের জন্য আলাদা ভ্যানুর ব্যবস্থা করা হবে।

মেলায় উপস্থিত রাজিহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ ইলিয়াস তালুকদার ও পার্শ্ববর্তী গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কৃষ্ণকান্ত দে সার্বক্ষণিক মেলায় ছিলেন। তারা বলেন, গ্রাম্য বাংলার ঐতিহ্যবাহী মারবেল মেলাকে জনপ্রিয় করার জন্য মেলা স্থলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ মাঠ সম্প্রসারিত করার জন্য সরকারের দৃষ্টি কামনা করছেন।