বরিশাল এলজিইডিতে বরাদ্দ দেয়া টাকার সিংহভাগ চলে গেছে শাসক দলের নেতাদের পকেটে

উম্মে রুমান, বরিশাল ॥ এলজিইডি’র মাধ্যমে সড়ক সংস্কার ও পুল-কালভার্ট নির্মাণের জন্য গত ৫ মাসে শত কোটি টাকা বরাদ্দ আসলেও তা চলে গেছে শাসক দলের কয়েকজন নেতার পকেটে। দু’ আওয়ামী লীগ নেতার বিরোধকে কেন্দ্র করে এখানকার যুবলীগের এক শীর্ষ নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল টাকা। এখানকার এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়ার পরিবর্তে শাসকদলের গুছপার্টির লোকজন নামে-বেনামে গ্রহণ করেন। এরপর তা বিক্রি করে দেন বিএনপি দলীয় ঠিকাদারদের কাছে। এলজিইডি’র নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে পরিচিত কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কোনো কাজ দেয়া হয় না। বরং কাজ দেয়ার কথা বলে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এসব টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে।

এলজিইডি’র দপ্তর সূত্র জানায়, তাদের অধিনে জেলায় মোট সড়ক রয়েছে ২হাজার ৪৪২টি। এর দৈর্ঘ্য ৭হাজার ৯৩৭ কিলোমিটার। এসব সড়ক সংস্কার ও নতুন পুল-কালভার্ট নির্মাণের জন্য গত ১জুলাই থেকে এ পর্যন্ত বরাদ্দ এসেছে প্রায় একশ কোটি টাকা। এরমধ্যে অর্ধেক টাকাই সাউথ ওয়েস্ট প্রকল্পের (দক্ষিণ-পশ্চিম) ১৪ জেলার জন্য জাপানের জাইকা বরাদ্দ দিয়েছে, বাকি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। শত কোটি টাকার এই কাজের মধ্যে সর্ববৃহৎ কাজ হচ্ছে উজিরপুরের হারতায় ২২কোটি টাকা ব্যয়ে ২৮০ মিটার ব্রীজ নির্মাণ, এর পরবর্তী বৃহৎ প্রকল্প হিসেবে বাকেরগঞ্জ নেয়ামতি সড়কের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ২১কোটি ১৪ লাখ টাকা। বৃহত্তর বরিশাল প্রকল্পের অধিন ঐ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বাকি টাকার মধ্যে সাউথ ওয়েস্ট প্রকল্পের অধিন বাকেরগঞ্জ, মেহিন্দগঞ্জ, হিজলা, বানারীপাড়া, মূলাদী, বাবুগঞ্জ, উজিরপুর এলাকায় সড়ক নির্মাণ ও মেরামতের কাজ চলছে। ঠিকাদার নিয়োগের ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডি’র প্রকৌশলীরা জানান, শাসক দলের নেতারাই ঠিকাদার নিয়োগের জন্য তালিকা করে কাজ ভাগবাটোয়ারা করেন। অলিখিত ভাবে এলজিইডি’র শুধু শত কোটি নয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে যত কোটি টাকার কাজ ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে তার একক নিয়ন্ত্রণকর্তা হচ্ছেন এখানকার মহানগর যুবলীগের আহবায়ক সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার নিজামূল ইসলাম নিজাম। ঠিকাদারী কাজের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে গত বছর তিনি ঢাকার পল্টন এলাকায় নিজ দলীয় হিজলা উপজেলা চেয়ারম্যানের ছোট ভাই দিপু শিকদার ও মোয়াজ্জেম হোসেন চুন্নুর হাতে প্রহৃত হন। বিসিসি মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সামনেই ঐ দু’ যুবলীগ নেতা একত্রিত হয়ে নিজামকে বেধম মারধর করে। ঐ ঘটনার জের ধরে রাতভর নগরীতে চলেছে যুবলীগের তান্ডব। ঘটনার পর কেন্দ্র থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিতর্কিত যুবলীগ নেতা আবুয়াল হোসেন অরুন সহ ১২ জনকে বহিষ্কার করা হলেও নিজাম রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। অভিযোগ রয়েছে এখানকার আওয়ামী লীগের দু’ প্রভাবশালী নেতার বিরোধকে পুঁজি করে নিজাম সুবিধাজনক অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। ঠিকাদারী কাজ ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারেও এক নেতার বিরুদ্ধে অপর নেতার কাছে অভিযোগ তুলে তিনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। দল ক্ষমতায় আসার পর গত তিন বছরে তিনি এলজিইডি থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তার সঠিক হিসাব না জানলেও দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ নিজাম শুধু আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়নি সে বটগাছ থেকে এখন জোড়া বটগাছ হয়েছে। নিজামের টেন্ডার জালিয়াতি সম্পর্কে শুধু এলজিইডি’র প্রকৌশলীরা অতিষ্ট নয় সাধারণ ঠিকাদাররা পর্যন্ত চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

অতি সম্প্রতি এলজিইডি’র ১৪নং নোটিশে ১১ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সড়ক সংস্কারের দরপত্র আহবান করা হয়। ঠিকাদাররা জানান, নির্মাণ কাজের চেয়ে সংস্কার কাজে লাভ বেশি হওয়ায় নিজামের অপতৎপরতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তিনি এই নোটিশে থাকা ২৮ গ্রুপের কাজ বিভিন্ন যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের পাইয়ে দেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। টাকা নেয়ার পর সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সম্মতিপত্র এনে এলজিইডিতে কাগজপত্র তৈরীর টাকা জমা দিতে বলেন। ২০/২২ লাখ টাকার একেকটি কাজের জন্য যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীরা এলজিইডিতে টাকা জমা দেন। এর পাশাপাশি অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী দলীয় ফান্ডের নামে নিজামের হাতে তুলে দিতে হয়েছে এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে। প্রত্যেক ঠিকাদারের কাছ থেকে ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর নিজাম ঐসব ঠিকাদারদের জানান, সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন এসব ঠিকাদারী কাজ এলজিইডি’র প্রকৌশলীদের ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তাদেরকে কাজ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কোনো প্রকৌশলী তার কাছে ঠিকাদারী কাজ দাবী করেননি এবং যুবলীগ নেতা নিজামকে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা তিনি দেননি বরং নিজাম এসব কাজ ছাত্রলীগ-যুবলীগের অপর নেতাদের দেয়ার জন্য সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে মেয়রকে জানিয়েছেন। এ তথ্য জানিয়ে সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন অধিকাংশ ঠিকাদারী কাজের ভাগ-বাটোয়ারা করেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তিনি নিজামকে যেভাবে নির্দেশ দেন সেভাবেই কাজ ভাগ-বাটোয়ারা হয়। এক্ষেত্রে এলাকা ভিত্তিক এমপিদের সুপারিশ থাকে। সদর উপজেলায় তেমন উন্নয়ন কাজ না হওয়ায় তিনি দলীয় কর্মীদের কোনো কাজ দেয়ার সুযোগ পান না।

আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এ অভিযোগ অস্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, বিগত আওয়ামী লীগ আমলেও আমার বিরুদ্ধে কোনো টেন্ডার ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগ উঠেনি। আর এবার তো আমার ক্ষমতাই নেই। দলের বঞ্চিত তৃণমূল নেতারা জানান, দু’ প্রভাবশালী নেতার মতবিরোধকে কেন্দ্র করে মূলত পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া একাই নিয়ন্ত্রণ করেন নিজাম। তিনি যেসব ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছেন এবং এখন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন ও সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র দোহাই দিয়ে কাজ বাতিলের কথা বলছেন তার কোনো সত্যতা নেই। এলজিইডি’র সহকারী প্রকৌশলী রুহুল আমিনের নাম উল্লেখ করেই মেয়রের বরাত দিয়ে যুবলীগ নেতা নিজাম এ প্রতারণা করেন। গত সোমবার এলজিইডি ভবনে গিয়ে প্রকৌশলী রুহুল আমিনের সাথে কথা বললে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ঠিকাদারদের কাজ দেই। আমরা মেয়র কিংবা কোনো যুবলীগ নেতার কাছে ঠিকাদারী চাওয়ার অভিযোগ একটি হাস্যকর বিষয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। পুরো বিষয়টি জানার জন্য যুবলীগ নেতা নিজামুল ইসলাম নিজামের একাধিক মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি বরং ব্যক্তিগত লোক পাঠিয়ে কথা বলার জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিষয়টি তিনি পরিস্কার করে বলতে রাজি হননি। বরিশালে শত কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দের কাজ নিয়ে ঠিকাদারদের বঞ্চিত করে শুধুমাত্র কাগজে-কলমে কাজ দেখিয়ে কয়েকজন যুবলীগ নেতা নিজেদের ফায়দা হাসিল করলেও বাস্তবে এসব টাকার সিকিভাগ কাজও হয়নি। বৃহত্তর প্রকল্পের ব্রীজ ও সড়ক নির্মাণ হলেও যেসব প্রকল্পের কাজ এক কোটি টাকার নীচে বিশেষ করে মেরামত, আরসিসি, এসবিবি, কার্পেটিং করার কাজে শুধুমাত্র কাগজপত্র ঠিক করেই টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

বরিশালে যখন শত শত কোটি টাকার হরিলুট চলছে তখন ভোলায় আওয়ামী লীগের বিবাদমান দু’গ্রুপের বিরোধকে কেন্দ্র করে এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক-জনপথের কাজ শুধু স্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়া নয় লটারীর মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে সেখানকার গণপূর্ত বিভাগের ২০ কোটি টাকার সংস্কার কাজের ঠিকাদার নিয়োগের জন্য লটারী অনুষ্ঠিত হয়। ঐ লটারীতে শাসক দলের কোনো নেতা একটি কাজও পাননি। সব ঠিকাদারী কাজ পেয়েছেন বিএনপি দলীয় লোকজন। দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার যখন চরম বেহাল দশা এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ভূগছে আর্থিক সংকটে তখন দেশী-বিদেশী সাহায্য মিলিয়ে যে সামান্য টাকা আসে তাও শাসক দলের নেতাদের পকেটে যাওয়ায় বাস্তব অবস্থা আরো সংকটের দিকে যাচ্ছে।

এলজিইডি’র প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, যে টাকা বরাদ্দ এসেছে তা দিয়ে ৪৭টি পাকা সড়ক মেরামত করে রাখাই দরুহ ব্যাপার। এই ৪৭টি সড়কের দৈর্ঘ্য ৬৭৯ কিলোমিটার। এর বাইরে ৮৬৩ কিলোমিটার এসবিবি ও ৬২ কিলোমিটার সিসি রোড রয়েছে। জেলা-উপজেলার সড়কগুলো যখন চরম বেহাল দশা তখন গ্রাম পর্যায়ে যে ৮৩৬টি সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিলো সেই সড়কের ২ হাজার ৬৬৯ কিলোমিটার এলাকা এখন ইট-সুরকি উঠে গিয়ে কাঁচা রাস্তায় পরিণত হয়েছে।