সরকারকে লুলা ও ল্যাংড়া বানিয়ে ছেড়ে দিতে চাই -খালেদা জিয়া

খোন্দকার কাওছার হোসেন, চাঁদপুর থেকে : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, এই সরকারকে লুলা আর ল্যাংরা বানিয়ে ছেড়ে দিতে চাই। তাদের আমরা ফেলে দিতে চাইনা। দেখি তারা খুঁড়িয়ে কতদূর যেতে পারে।

সোমবার বিকেলে চাঁদপুর স্টেডিয়ামে গত ২৯ জানুয়ারি গণমিছিলে নিহত নেতাদের স্বরণে জেলা বিএনপি আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।

চাঁদপুর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মুমিনুল হকের সভাপতিত্বে এ জনসভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমকে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব,) আ স ম হান্নান শাহ, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাসসহ দলের সিনিয়র ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

খালেদা জিয়া বলেন, গুলি করে যারা মানুষ হত্যা করেছে তাদের একদিন বিচার হবেই। এখন না হলেও আমরা অবশ্যই বিচার করবো।

তিনি সরকারকে বলেন, আর কত মায়ের বুক খালি করবেন? আপনাদের আর কত রক্ত চাই?

খালেদা জিয়া বলেন, আগামীতে অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। আপনাদের যদি তত্ত্বাবধায়ক নামটি পছন্দ না হয় তাহলে অন্য যে কোনো নামে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।

তিনি বলেন, সরকারের যদি বোধদয় না হয় তাহলে যা করার আমরা করবো। ১২ মার্চের পর এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেব, ঢাকায় অবস্থান করতে হবে সবাইকে। আমিও আপনাদের সঙ্গে থাকবো। আপনারা ঢাকায় যাবেন না?

খালেদা জিয়া বলেন, ২৯ জানুয়ারি গণমিছিলে দুই জন ছাত্রনেতাকে সরকারের নির্দেশে পুলিশ গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তিন বছরে তারা কিছুই দিতে পারেনি। প্রতিনিয়ত লাশ উপহার দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে আইনশৃঙ্খলা নাকি ভালো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিলো অনেক আগেই পদত্যাগ করা।

তিনি বলেন, হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার পর এই সরকার আবার মাফ করে দেয়। এদেশে গণতন্ত্র আইনের শাসন নেই। তারা মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি করে। আওয়ামী লীগের অতীত কলঙ্কময়। তারা কখনোই গণতন্ত্রের চর্চা করেনি। তারা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলো। চারটি সংবাদপত্র রেখে সব বন্ধ করে দিয়েছিলো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তাদের নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করেছিলো। লাল বাহিনী, নীল বাহিনী রক্ষী বাহিনী ঘর থেকে মানুষ তুলে নিয়ে হত্যা করতো। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো প্রতিদিন মানুষ হত্যা হচ্ছে। গত তিন বছরে ১২ হাজার মানুষ হত্যা করেছে। দুদিন আগে ঘরে ঢুকে দুই জন সাংবাদিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ঘরেও এখন মানুষ নিরাপদ নয়। সেই হত্যাকারীদের এখনো ধরতে পারেনি। নিরীহ কাউকে ধরে বলবে এইতো ধরেছি।

খালেদা জিয়া বলেন, সরকার গলাবাজী আর মানুষ খুন ছাড়া কিছু পারে না। দেশে কোনো উন্নয়ন নাই। চাল, ডাল, লবন, তেল, ডিমের দাম বেশি। মাছ মাংশের কথা বললাম না। তারা কথা দিয়েছিলো ঘরে ঘরে চাকুরি দেবে। দিয়েছে? দেয়নি।

বিদেশে এখন লোক যেতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মানুষ শূন্যহাতে ফেরত আসছে। সরকার এখন বন্ধু হীন হয়ে পড়েছে। বন্ধুহীন কখন হয় যখন সরকার দুর্বল হয় ও অন্ধভাবে কোনো দেশের আনুগত্য প্রকাশ করে।

চাঁদপুরের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের জেলার মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন না কেনো সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যা করছে। ফেলানী আপনাদের বোন আমাদের মেয়ে তাকে হত্যা করে কাটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। একজনকে কাপড় খুলে পিটিয়েছে। পাথর ছুড়ে মানুষ হত্যা করছে। তারা বলে হত্যা আরো করবো। কিন্তু এর কোনো প্রতিবাদ হয় না।

তিনি বলেন, এই হত্যা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আমাদের সীমান্ত রক্ষী যারা আছে তাদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

যুবকদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, যুবকদের কাজ নেই। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিছু করবো তাও ব্যাংকে টাকা নেই। সব টাকা সরকার ঋণ নিয়ে গেছে। সরকার চাকুরি দিতে পারে না। ব্যাংক দেউলিয়ার পথে। তিন বছরে নতুন কোনো শিল্প কলকারাখানা বেড়ে ওঠেনি। বেকারত্ব বেড়েছে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ার বাজার লুট হয়। আমাদের সময় এমন হয়নি। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেয়ার বাজার লুট করেছিলো। এবারো হাজার হাজার কোটি টাকা লূট করেছে। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর দেড় কোটি পরিবার আজ নিঃস্ব। এর জন্য তারা প্রতিবাদও করতে পারবে না। প্রতিবাদ করলে জেলে নেওয়া হয়। নির্যাতন করা হয়। অনেকে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।

তিনি বলেন, এই সরকারের আমলে দেশের মানুষ কিছু পায়নি। পেয়েছে শুধু লাশ আর লাশ। সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আর কত লাশ চান। আর কত রক্ত চান। আর কত মায়ের বুক খালি করতে চান। কত বোনকে বিধবা করতে চান। কত শিশুকে পিতৃহারা করতে চান? আপনাদের কি খুনের পিপাসা মিটে নাই? এই সরকার খুনি সরকার। এদের হাত রক্তে রঞ্জিত।

খালেদা জিয়া চাঁদপুরে নিহতদের আলোচিত্র দেখিয়ে বলেন, তারা শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি। এই ছবিতে দেখেন কিভাবে উলঙ্গ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তে যেভাবে উলঙ্গ করে পিটিয়েছে পুলিশও তাই করছে। এরা কি বাংলাদেশের পুলিশ? আগে কখনো এরকম দেখিনি।  

পুলিশের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বাড়াবাড়ি করবেন না। গুলি করে হত্যা করে অতীতে আন্দোলন দমন করা যায়নি। এখনো যাবে না। বরং আরো বেগবান হয়। আমি চাঁদপুরবাসীকে কথা দিলাম হত্যাকারীদের বিচার করবো। এখন নাহলেও একদিন বিচার হবেই ইনশাল্লাহ।

তিনি বলেন, আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি। তাই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়েছি। তবুও তারা বাধা দেয়। জনগণ হরতাল করে আমাদের পিকেটিং করার দরকার হয় না। হত্যা করে ভয় দেখিয়ে কর্মসূচি দমন করা যায়নি। আগামীতেও যাবে না।

তিনি বলেন, সারাদেশে শান্তিপূর্ণ রোডমার্চে মানুষের ঢল দেখে সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তারা ভীতু হয়ে গেছে। গণমিছিলে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার মতো ২৯ জানুয়ারি তারা পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছিলো। আমরা একদিন পিছিয়ে ৩০ জানুয়ারি কর্মসূচি দিয়েছিলাম। সেই গণমিছিলে জনজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিলো।

খালেদা জিয়া বলেন, ১২ মার্চ ঢাকা চলো কর্মসূচিতে মানুষের ঢল নামবে ইনশাল্লাহ। মন্ত্রীরা আবোল তাবোল বকতে শুরু করেছে। তারা নাকি ঢাকা দখল করবে। আমরা দখল করতে চাই না। আমাদের সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। তারা যদি দখল করতে চায় তাহলে দেখা যাক! তবে আমি সাবধান করে দিতে চাই ওই দিন পাল্টা কোনো কর্মসূচি দেবেন না। দিলে তার দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে।

আগামী নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার ষড়যন্ত্র করছে সরকার এমন অভিযোগ এনে তিনি বলেন, আগামীতে ফখরুদ্দিন মইন উদ্দিন নেই যে তাদের আবার ক্ষমতায় বসাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোর্টের দোহাই দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছে। কোর্ট বলেছে আরো দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তারা একথা না শুনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে।

তিনি বলেন, সরকার চায় নিজেরা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপি থেকে নির্বাচন করবে। এটা নির্বাচন হবে না। এই আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ যারা হেলিকপ্টারে করে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে এনে গণভবনে বসে ফল ঘোষণা করেছিলো।

খালেদা জিয়া বলেন, সরকার বিজয় নিশ্চিত করতে ইভিএম মেশিন দিয়ে নির্বাচন করতে চায়। এই মেশিন আমেরিকা জার্মানীসহ বিশ্বের বড় দেশ বাতিল করেছে। তারা বলেছে এই মেশিন দিয়ে কারচুপি করা যায়। আপনি ভোট দিবেন ধানের শীষে যাবে নৌকায়। আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। ইভিএম এ কোনো নির্বাচন হবে না। হাতের টিপ সই দিয়ে আগের মতোই ভোট দিবে মানুষ।

খালেদা জিয়া বলেন, কুইক টাকা বানানোর জন্য তারা কুইক রেন্টাল প্লান্ট বানিয়েছে। বিদ্যুৎ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়েছে। সামনে গরম আসছে কেমন লোড সেডিং হয় বুঝতে পারবেন।

তিনি বলেন, আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছি তাতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। দেশের মানুষ সুখে থাকতে পারবে। দেশকে অর্থনৈতিভাবে সুখি সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলবো।

এর আগে ঢাকা থেকে সকাল সোয়া এগারোটায় রওয়ানা করে বিকাল পৌনে ৪ টায় চাঁদপুর পৌছেন খালেদা জিয়া। আধা ঘন্টা চাঁদপুর সার্কিট হাউজে বিশ্রাম নিয়েই তিনি সোয়া চারটায় মঞ্চে ওঠেন। এসময় স্টেডিয়ামের লাখো জনতা শ্লোগানের মধ্যে দিতে তাকে বরণ করে নেয়। মঞ্চে চারদিকে ঘুরে তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন।

অভিনব প্রতিবাদ
খালেদা জিয়া চাঁদপুর যাওয়ার পথে কচুয়া উপজেলা অতিক্রম কালে এক অভিনব প্রতিবাদ করেছে কচুয়া উপজেলা বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী। উপজেলার জগতপুর বাসস্টান্ড এলাকায় প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তারা কয়েদির পোশাক পরে রাস্তার দুপাশে দাড়িয়ে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানান এবং সরকার বিরোধী নানা শ্লোগান দেয়। কয়েদির পোশাকে তাদের বুকের ওপর লেখা ছিল ‘ডিজিটাল হাসিনার উপহার সারা কচুয়া কারাগার’কয়েদি নং—-।  এ সময় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন একটি প্রাইভেটকারে বসে ঢাকা থেকে আগত নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের শুভেচ্ছা জানান।

সাবেক এমপিকে মঞ্চে উঠতে দেয়নি
বিএনপির সাবেক এমপি এম এ মতিনকে মঞ্চে উঠতে দেয়নি নেতাকর্মীরা। গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মঞ্চে এসে উঠতে চাইলে মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা তাকে মঞ্চে উঠতে বাধা দেয়। এসময় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে মঞ্চের পেছনে একটি চেয়ার নিয়ে বসে থেকে চলে যান। জানা গেছে, জেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হকের লোকেরা এ কাজ করেছে।