এক মুঠো লাল গোলাপ ও নদী

পুতুলের মতো সাজানো হয়েছে বাড়িটাকে আজ। বাহারি ফুল, রঙিন কাপড় ও কাগজের সমাহার পুরো বাড়ি জুড়ে। তার উপর রং বেরংয়ের মরিচা বাতি গুলো প্রজ্জলিত হচ্ছে সারা বাড়িময়। তারা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে বিরামহীন চন্চলতা নিয়ে।আমার মনের ভাবনা গুলিও যেন এই মরিচা বাতিদের সাথে খেলা করার ব্যার্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। এক ধরনের জড়তা জমেছে আমার মনের ভাবনা গুলুতে।বলা যায় কেউ একজন অসীম জড়তা নিয়ে আটকে রয়েছে এই হৃদয়ে। যে জড়তা কখনো ছুটবার নয়। হয়তো ইচ্ছে করেই পুষে চলেছি এগুলোকে।

 

আজ আমার সোহাগ রাত। কিন্তু সোহাগ রাত পালন করার মতো কোন চিন্তা ভাবনাই এখন আমার মনে কাজ করছে না। নতুন বউকে খাটের উপর বসিয়ে রেখেই বারান্দায় এসে সিগারেটের পর সিগারেট টানছি আর এইসব সাত পাঁচ ভাবছি। কিছুটা জোড় করেই বিয়েটা করানো হয়েছে আমাকে। বাবার আদেশ এবং মায়ের অশ্রুসিক্ত নয়নের আবদার উপেক্ষা করতে না পেরেই বিয়েটা করা।মায়ের মতে আমার নতুন বউ নাকি খুব সুন্দরী এবং সুশীল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু তাতে আমার কি!! আমার কিছু যায় আসেনা।এখন পর্যন্ত মেয়েটির ছবিও দেখিনি। দেখার কোন ইচ্ছাও নাই!! যার সাথে কখনো মনের মিল হবার নয় তাকে দেখেই বা কি লাভ !!

আজ হাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ৪ বছর পূর্বের সেই ভার্সিটি জীবনে। বারবার মনে পরছে সেই দিনটির কথা। যেদিন প্রথমবার দেখা হয়েছিল তার সাথে। ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণায় কফির মগ হাতে নিয়ে বসে ছিল মেয়েটি।জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে দেখে হৃদয়ের স্পন্দন গতি বেড়ে গিয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল এই অপ্সরীর জন্যেই আমার পৃথিবীতে আসা। তাকে ছাড়া জীবন অচল, অর্থহীন।

আমার এক বন্ধুর কল্যানেই পরিচয় হয় তার সাথে। তার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী ছিল সে। সেদিন-ই আমি প্রথম জানতে পারি তার নাম।

সামিয়া। এই নামটি যেন আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য। সেদিনের পর প্রতিদিনই দেখা হতো আমাদের। আমাদের সম্পর্কটা এক সময় আপনি থেকে তুমি গড়িয়ে তুই এ রুপান্তরিত হয়। একে অপরকে ছাড়া একটি মুহূর্ত ও থাকতে পারতামনা আমরা। আমাদের বন্ধুত্ব সারা ভার্সিটি জুড়ে ঈর্ষার কারন হয়ে দাড়িয়েছিল। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় কোথায় আমাদের। আমরা আমাদের বন্ধুত্বটা ঠিকই বহাল রেখেছিলাম ভার্সিটির শেষ দিনটি পর্যন্ত।


সামিয়াকে প্রথম দেখার দিনটি থেকেই তার উপর দুর্বল হয়ে পরেছিলাম আমি। তাকে বন্ধু থেকে কিছুটা বেশিই ভাবতাম সর্বদা। যতক্ষণ তার সাথে থাকতাম এক ধরণের অজানা ভাল লাগা কাজ করতো আমার মাঝে। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ মুগ্ধ হয়ে দেখতাম আমি। এক অসীম মায়ায় আটকা পড়েছিলাম এই মেয়েটিকে ঘিরে। ভালবাসার মায়া। সামিয়াকে আমি মনে মনে অনেক ভালবাসলেও মুখ ফোটে কখনো বলা হয়নি তাকে নিজের হৃদয়ের অনুভূতি গুলো। অনেক ভয় পেতাম যদি পরিশেষে এই বন্ধুত্বটাও হাড়াতে হয়!! এই ভেবে সর্বদাই এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যেতাম।


আমাদের ভার্সিটি জীবনের পরেও মাঝে মাঝে দেখা করতাম আমরা তেমনি একদিন সামিয়ার ফোন আসে দেখা করার জন্যে। ফোনে বলেছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে আমাকে। আমি ভাবলাম এইটাই সুযোগ। আজ তাকে ভালবাসার কথাটি বলার। তার প্রিয় এক মুঠো লাল গোলাপ নিয়ে গেলাম সেদিন। কিন্তু তার দেয়া বিয়ের কার্ডটি হাতে নিয়ে আর ভালবাসার কথাটি বলা হলো না আমার। যে লাল গোলাপ নিয়ে নিজের ভালবাসার ফুল ফোটাতে চেয়েছিলাম সেই লাল গোলাপ দিয়েই তার নতুন জীবনের শুভেচ্ছা প্রদান করে ফিরে আসলাম। এটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। আমার ভালবাসার পরিসমাপ্তি।


বারান্দায় বসে থাকতে আর ভাল লাগেনা। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসে। হাতের শেষ সিগারেটটা শেষ করেই রুমের ভেতরে যাই আমি। মাথার ঘুমটা না উঠিয়েই খাটের উপর জড়সড় হয়ে হয়ে ঘুমিয়ে পরে আমার নতুন বউ। নিঃশব্দে তার কাছে যাই আমি। গায়ের উপর কাথা জড়িয়ে দিয়ে নিজের বালিশ নিয়ে সোফায় এসে ঘুমিয়ে পড়ি সাথে সাথেই।


চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। হাতের ঘড়িটাতে চোখ পড়তেই দেখি ১০:১৫মি:। কখনো এতো দেড়ীতে ঘুম থেকে উঠিনা আমি। হয়তো কাল রাতে দেড়ী করে ঘুমানোর ফল এইটা। সোফার সামনে টেবিলে এক মগ গরম কফি রাখা। তার পাশে আমাদের বিয়ের কার্ড। ডান হাতে কফির মগ হাতে নিয়ে বাম হাতে কার্ডটি খুলি আমি। কনের নামের জায়গায় লিখা-

“সাদিয়া মেহজাবিন নদী”

নামটা অনেকটা মনে ধরে যায় আমার। মনে হলো যেন তিনটি সুন্দর নামকে একত্রিত করে একটি নাম বানানো হয়েছে।

এরই মাঝে মাথায় ঘোমটা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করে নদী। সোফাতে বসেই তার দিকে চোখ তুলি আমি। কিন্তু সেই চোখ আর সরাতে পারিনা কিছুতেই। এতো স্নিগ্ধ এবং কোমল চেহারার মেয়ে আমি হয়তো জীবনে প্রথম দেখলাম। তার কাজল টানা চোখ গুলি ঝিলের জলের মতো স্বচ্ছ। যেন এখনই ডুব দিয়ে সাতার কাটা যাবে। তার উপর পড়নের লাল শাড়িটা তার সৌন্দর্যটা বাড়িয়ে দিয়েছিল শতগুণে।


এভাবেই কাটছিলো আমার দিন গুলি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে চলে যেতাম এবং ফিরতাম অনেক রাত করে। নদীর সাথে খুবই কম সময় কাটাতাম আমি। তার স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য্য আমাকে আকৃষ্ট করতো সর্বদা। কিন্তু এক ধরনের বাধা কাজ করতো আমাদের মাঝে। যে বাধার কারণে সব আকর্ষণ ছিন্ন করে দিতো আমার। দূরে ঠেলে দিতো তার কাছ থেকে যোজন যোজন পথ। নদীকে আমি কখনো ভালবাসা দিতে না পারলেও তার পক্ষ থেকে কোন আক্ষেপই শুনিনি, ছিলোনা কোন আবদারও। আমার ঐ দূরত্ব ও নির্লিপ্ততাকে গ্রহণ করে সংসার করে চলেছিলো অনায়াসেই। হয়তো মেয়েদের একটা আলাদা শক্তি থাকে। যা দিয়ে তারা নিরঙ্কুশভাবে ভালবাসা বিলিয়ে যেতে পারে কোন প্রকার প্রতিদানের আশা ছাড়াই।


প্রায় চার মাসের মতো হয়ে গেলো আমাদের বিয়ের। মায়ের কথায় নদীকে তার বাবার বাড়ীতে নিয়ে চললাম আমি। এই প্রথম আমি তাকে নিয়ে বেড় হই। ঢাকার ব্যাস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি এবং আমার পাশে বসে আছে নদী। গাড়ির জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসে তার খোলা চুলগুলি বারবার সরে আসছিলো আমার দিকে।আড় চোখে আমি তার দিকে তাকাচ্ছিলাম এবং মুগ্ধ হচ্ছিলাম তার সৌন্দর্য্যে। এরই মাঝে সিগনাল পরে রাস্তায়। গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকালাম আমি। বাইরে ফুলের দোকানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো মেয়েটি। সেদিকে তাকাতেই দেখলাম অনেকগুলো লাল গোলাপ সাজিয়ে রাখা হয়েছে পুরো দোকান জুড়ে।।


এক দৌড়ে চলে গেলাম ফুলের দোকানে। এক মুঠো লাল গোলাপ হাতে নিয়েই পা বাড়ালাম গাড়ির দিকে। এরই মাঝে সিগনাল ভাঙ্গলো রাস্তার। গাড়ির কাছাকাছি চলে আসতেই হঠাৎ সো সো শব্দ করে একটি বাস চলে গেলো চোখের সামনে দিয়ে। কিছু বোঝে উঠার আগেই এক চিৎকার দিয়ে নদী এসে ঝাপিয়ে পড়লো বুকে। তার চোখের পানিতে ভিজতে শুরু করলো আমার সাদা শার্ট। নিজের অজান্তেই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম নদীকে। মনে হলো যেনো মৃত্যুকে ফাকি দিয়ে সদ্য জয় করে নিলাম এক নতুন জীবন। ভালবাসাময় নতুন জীবন।