ফিরছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার!

খোন্দকার কাওছার হোসেন ॥ নতুন নামে, নতুন ফরমেটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার ফিরে আসছে। সংবিধানের ষষ্টদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক মাঠের খেলোয়ারদের বাইরেও দেশী বিদেশী এক শ্রেনীর খেলোয়াররা পর্দার অন্তরালে তাদের খেলা খেলছেন। সে খেলায় সরকার ও বিরোধী দলীয় কতিপয় নেতা জড়িয়ে পড়েছেন। এতে উভয় দলের শীর্ষ নেতাদের সায় রয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন অগ্রগতি এখন পর্যন্ত হয়নি।

এ ব্যবস্থায় ফিরে যেতে সংসদে কে বিল আনবে এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। সরকারি দল আওয়ামী লীগ যাচ্ছে বিএনপি এ বিল সংসদে উত্থাপন করুক। বিএনপির বক্তব্য যেহেতু সরকারি দল সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা বাতিল করেছে। ফিরিয়ে আনতে হলে তাদেরকেই বিল উত্থাপন করতে হবে। বিরোধী দল এ বিল উত্থাপন করলে ব্রুট মেজরিটির জোরে সরকারি দল এ বিল বাতিল করতে পারে বলে তাদের আশংকা রয়েছে। এ অবস্থার অবশান হলেই সংবিধানের ষষ্টদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবারো ফিরে আসতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে ভিন্ন নামে বা পূর্বের নামেই ফিরতে পারে এ ব্যবস্থা।

জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে রেখেছে বিএনপি। বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা এ খসড়া তৈরি করেছেন। পরিবেশ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হলে, খালেদা জিয়াসহ সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এ বিষয়ে সংসদে হাজির হয়ে কথা বলবেন বলেও সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলতে সংসদের চলতি অধিবেশনেই যোগ দেয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। এ নিয়ে স্থায়ী কমিটি ও দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। চলতি অধিবেশনের শেষ দিকে খালেদা জিয়া সংসদে এ বিষয়ে দলের আনুষ্ঠানিক অবস্থান তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক, নির্দলীয়, অন্তবর্তকালীন কিংবা নির্বাচনকালীন যে নামেই ডাকা হোক না কেন কোনো একটি ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে এ বিষয়টি এখন উভয় দলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ ইস্যুতে প্রত্যেককেই কিছুনা কিছু ছাড় দিতে হবে এ বিষয়টিও তারা বুঝে ফেলেছেন। ফলে এ ইস্যুতে হার্ড লাইন থেকে সরে এসে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে সরকারী দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্পষ্টই বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তবর্তীকালীন যে নামেই ডাকা হোক না কেন নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি লক্ষিপুরে ও ১৩ ফ্রেব্রুয়ারি চাঁদপুরে পৃথক জনসভায় তিনি এ ব্যাপারে তার দলের অবস্থান পরিষ্কার করেন।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত শনিবার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশনে জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর স্বরণ সভায় বলেন, বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে সংসদে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। যুক্তিসংগত, গণতন্ত্র ও সংবিধান সম্মত হলে তা গ্রহণ করা হবে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পৃথক এক অনুষ্ঠানে বলেন, অন্তবর্তী সরকার নিয়ে আলোচনায় বিএনপি রাজি আছে। তবে এ ধরনের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, এ নিয়ে আলোচনার জন্য আমরা সংসদে যেতে রাজি আছি। কিন্ত সরকারকে বলতে হবে এ ধরনের প্রস্তাব তারা গ্রহণ করবেন।

তিনি বলেন, সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছে। এখন যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, তা সরকারকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকার যদি বলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনতে চায় তাহলে বিএনপি অবশ্যই এ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য সংসদে যোগ দেবে।
তিনদিনের বাংলাদেশ সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লে¬ক দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য শীর্ষ দুই নেত্রীকে সংলাপে বাসার তাগিদ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। বরং ব্লে¬কের তাগিদের সমালোচনা করেছেন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ব্লেক সাহেবদের কথায় বাংলাদেশ চলে না। বাংলাদেশ চলে বাংলাদেশের জনগণের কথায়। তিনি বলেন, বিরোধী দলের যে কোন প্রস্তাব নিয়ে সরকার আলোচনা করতে রাজি আছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারি দল এখন যত কথাই বলুক, শেষ পর্যন্ত তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনেক কিছুই মানতে রাজি হবে। একদলীয় নির্বাচন করলে তার ফল কী হতে পারে সরকার তা ভালো করেই জানে। আমাদের চেয়ারপারসন অন্তবর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, বিএনপি ইতিবাচক রাজনীতি এবং আশাবাদী দল। তাই আমি মনে করি, আলোচনার বিকল্প নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সংসদের চলতি অধিবেশনে বিএনপি যোগ দেয়ার কথা ভাবছে। সেখানে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের জনস্বার্থবিরোধী নানা কর্মকান্ডের কথা সংসদ সদস্যরা তুলে ধরা হবে। এই অধিবেশনে নির্দলীয় বা অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের বিষয়েও সংসদ সদস্যরা বক্তব্য দেবেন।

গত শনিবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের রাজনীতির বর্তমান ধারা খুব দ্রুত বদলে যাবে। আমি বলে দিচ্ছি, আপনারা লিখে রাখেন। তরুণেরা নিজেদের ভেতরকার শক্তি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালে দেশটা এমনিতেই বদলে যাবে।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের এ সংক্রান্ত বক্তব্যে রাজনৈতিক বোদ্বাদের মধ্যে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, দেশে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য নতুন নামে, নতুন ফরমেটে ফিরে আসছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।