সহস্রাব্দের সেরা মানুষ হত্যাকারীদের মরণোত্তর ক্ষমা কি খুব অন্যায় হবে?

WatchDog : আজ আর কাজে যায়নি ওহাব গায়েন। ঘাটে পারাপারের মত যাত্রী পাওয়া যাবে তারও সম্ভবনা ছিলনা। তাই আর বের হয়নি। সাতদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। তাও আবার একাধারে। শ্রাবনের অঝোর ঝরে ভেসে গেছে চারদিক। নদীতেও প্লাবনের আলামত শুরু হয়েছে। গঞ্জের বাঁধ উপচে পানি ঢুকতে শুরু করেছে ধান ক্ষেতে। সবাই বলছে এবারের প্লাবন নূহ আলায়েসসালামের প্লাবনকেও হার মানাবে। তাই ভয়ে আছে সুখিগঞ্জের মানুষ। বারান্দায় বসে তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছিল ওহাব। স্ত্রী আফিয়া খাতুন কখন এসে পাশে বসেছে খেয়াল করেনি। উঠানটার এক কোনা ভেসে গেছে বৃষ্টির তোড়ে। তৈরী হয়েছে বিশাল একটা গর্ত। সে গর্তের উপর বড় বড় ফোটা পরে তৈরী হচ্ছে অদ্ভুত এক ধরণের বুদবুদ। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে দিকে। এক সময় আপন মনে হেসে উঠল। ভয়ে পেয়ে গেল আফিয়া। ভাবল পুরানো ভুতের আছরটা বোধহয় ফিরে এসেছে। কিল ঘুসির দুরত্ব বজায় রেখেই জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে আফনের, আজ এত হাসি কেন? কথা বলল না ওহাব। আবারও হেসে উঠল এবং এবার উচু স্বরে। মুখের সুখী ভাবটা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পরল গোটা শরীরে। এবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল আফিয়া, ’কি হয়েছে আফনের, হাসতাছেন কেন?’। ’না না এমন কিছুনা, পুরানো কিছু কথা মনে পরায় হাসি পাইতাছে। তুমি এইসব বুঝবা না। যাও, অন্দরমহলে যাও।’। ’কি এমুন কথা যা মনে হইলে এত হাসি পায়? আমারেও কন, আমারও হাসতে ইচ্ছা করতেছে’। কয়েক সেকে¨ তাকিয়ে রইল স্ত্রীর দিকে, ভাবল এত বছর আগের ঘটনা, বললেই বা ক্ষতি কি?

– এই রকম একটা দিন ছিল সেইদিন। শাওন মাস। আসমান ফাটা মেঘ, ঘুটঘুটা আন্ধাইর আর কড়াৎ কড়াৎ বিজলী। গফুর বয়াতীর গলা টিপে ধরতেই সে বুইঝা গেল সাক্ষাৎ আজরাইল আইছে। চোখে মুখে মৃত্যু ভয় দেইখা বড়ই আনন্দ হয়েছিল আমার। বলেছিলাম, গফুর তোর যাওয়ার সময় হইছে, আল্লা আল্লা কর। এই নির্জন মাঠেই তোরে কবর দিমু। কেউ দেখব না, কোন স্বাক্ষী থাকব না। জানডা বেরোনোর আগে হেয় কইল, গায়েন, উপরে আল্লা মাটিতে মেঘ, এই যে বুদবুদ গুলা দেখতাছো হেরা স্বাক্ষী দিব একদিন। সব আল্লার খেইল। তুমি আমি এইখানে কেউ না। মরণের আগে তওবা কইরও, শান্তি পাইবা।‘ একদমে কথা গুলো বলে হো হো করে হেসে উঠল ওহাব। ’শুয়রের বাচ্চা গফুর, কই গেল তোর বুদবুদানি?’ – এবার অট্টহাসিতে ফেটে পরল সে। ভয়ে কুচকে গেল স্ত্রী আফিয়ার গোটা শরীর। একই সাথে বিশাল একটা বজ্রপাত কাঁপিয়ে দিল গোটা সুখিগঞ্জ, সাথে কোটি কোটি দৈত্যের অট্টহাসি। বিজলীর ঝলকানিতে ঝলসে গেল চারিদিক।

বছর না ঘুরতে ফাঁসির আদেশ হয়ে গেল ওহাব গায়েনের। দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতেই বেঁকে বসল প্রথম স্ত্রী। প্রচন্ড ভাবে মারল তাকে। আধমরা অবস্থায় রেখে এলো উওর চকে। দুর্ভাগ্য ওহাবের। ঐ অবস্থায় কেউ একজন খুজে পেল এবং চিকিৎসার জন্যে নিয়ে গেল গঞ্জের হাটে। ভাল হয়ে সুখিগঞ্জে ফিরেই থানায় গেল আফিয়া। খুলে বলল গফুর বয়াতীর কাহিনী।

ওহাবের ফাঁসির দিন গোটা গ্রামের মানুষ কেঁদেছিল। অনেকে রোজা রেখেছিল। জুমা ঘরে বিশেষ মোনাজাতেরও আয়োজন হয়েছিল। গায়েনের জন্যে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার চেয়ারম্যান সহ অনেকে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। রশিতে ঝুলিয়ে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার আইনী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ বাধা হতে পারেনি।

______________********____________

মনে হবে উপসংহার বিহীন একটা ছোটগল্প বলছি আমি। হয়ত তাই। কিন্তু একজন খুনির জন্যে গ্রামের মানুষ কেন কাঁদবে তার হদিস করতে পাঠকদের নিশ্চয় কষ্ট হবে। এটা আসলে গল্প নয়, মার মুখে শোনা সত্য ঘটনা। মা যে বছর বৌ হয়ে দাদাবাড়ি এসেছিলেন সে বছরই নাকি ঘটেছিল ঘটনাটা। উপলক্ষ পেলেই বলতেন গল্পটা। বলতেন পাপ প্রমানের কোন স্বাক্ষী লাগে না। সৃষ্টিকর্তা নিজেই নাকি বুদবুদ হয়ে হাজির হন স্বাক্ষী দিতে।

একজন খুনিকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের প্রেসিডেন্ট যা করলেন তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমার পুরানো বিশ্বাসটাকে কেন জানি সত্য মনে হল। সৃষ্টিকর্তা বলতে আসলেই কেউ নেই। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীই আমাদের খোদা। ওহাব গায়েনদের শাস্তি দিতে এখন আর বুদবুদ যথেষ্ট নয়, তার জন্যে চাই নব্য খোদাদের দয়া, আশীর্বাদ। গুলিস্তানের গলিতে বোবা পশুর মত হত্যা করা হয়েছিল প্রেসিডেন্টের স্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রীর গোটা পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল ৩২ নং বাড়ির বেডরুমে। এসব অপরাধীদের অনেককে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে, বাকিদেরও আওতায় আনা হয়েছে বিচার প্রক্রিয়ায়। হয়ত সময় হলে তাদেরও পাঠানো হবে একই পথে। স্বজন হারানো প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কি জানা আছে বিপ্লবেরও মা ছিল, বাবা ছিল? সবার মত তাদেরও কি আধিকার ছিলনা সন্তান হত্যার বিচার চাওয়ার? ক্ষমতার জোরে অধিকার কেড়ে নেয়ার যে সাংস্কৃতি উনারা চালু করলেন সে ধারাবাহিকতায় একদিন কেউ যদি মুজিব হত্যাকারীদের মরণোত্তর ক্ষমা করে দেয় খুব কি অন্যায় হবে? নাকি বিল্পবের রক্ত আর শতাব্দীর সেরা মানুষের রক্ত ভিন্ন ছিল?