দক্ষিণাঞ্চলের তিন জেলায় ফের চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বিস্তার

আহসানুর রহমান রাজীব, সাতক্ষীরা ॥ সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোরের সঙ্গমস্থল তালা, ডুমুরিয়া ও কেশবপুর এলাকাজুড়ে চরমপন্থী তৎপরতা ফের শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় আগে থেকেই চরমপন্থীদের প্রভাব বেশি ছিল। বহু ঘটনার পর তাদের তৎপরতা স্তিমিত হয়ে গেলেও নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চরমপন্থীদের কয়েকটি গ্রুপ তাদের প্রভাব বলয় বিস্তারের লক্ষ্যে গ্রামে গ্রামে গোপন মিটিং করছে। তারা নানা পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বিরোধ মীমাংসার দায়িত্বও নিচ্ছে তারা। দেশের দুই ধারার রাজনীতির পক্ষ নিয়ে বিভাজিত চরমপন্থি দলগুলো সামনের সংসদীয় নির্বাচনের বিষয়টিও মাথায় রেখেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের হয়ে তারা নিজেদের অবস্থানকে সংহত করছে। এরই মধ্যে এসব ঘটনা নিয়ে বিবদমান চরমপন্থীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশংকা দেখা দিয়েছে। গ্রামবাসীরা বলছেন, রাতের আঁধারে এসব চরমপন্থি যা বলছে তাতেই তাদের সায় দিতে হয়। তারা জানান, এর বিপক্ষে থাকলেই বিপদ হবে এমন অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। ফলে অস্ত্রধারীদের এতসব তৎপরতা সম্পর্কে আইনশৃংখলা বাহিনীকে অবগত করার সাহসও করছেন না তারা। চরমপন্থিরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় তিন জেলার এই সঙ্গমস্থলকে তাদের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে বেছে নিয়েছে। এমনকি মাছের ঘের লুটপাট, মাছের ঘেরের দখলদারিত্ব এসব নিয়েও চরমপন্থিরা খেলছে।

সাতক্ষীরার তালার চাড়িভাঙা ও সোনামুখী ঘের এলাকায় সম্প্রতি চরমপন্থিদের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, চরমপন্থিদের তৎপরতা ও আনাগোনা সংক্রান্ত নানা খবর তাদের কাছে রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না মেলায় ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দুর্র্ধষ চরমপন্থি ক্যাডার তালার বিদ্যুৎ বাছাড়কে ফের গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে তাদের হাতে বড় ধরনের কোন অপরাধ সংঘটনের খবর না থাকায় কাউকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা বলেন, তবে চরমপন্থিদের গ্রেফতার করতে সবসময়ই কমবেশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব এলাকায় চরমপন্থিদের যেসব দল সক্রিয় রয়েছে সেগুলো হচ্ছে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) জনযুদ্ধ। এই তিন পার্টির তিন শীর্ষ নেতা আজিজুর রহমান ওরফে অতুল কীর্তনীয়া ওরফে বরুণ, মনোরঞ্জন গোসাই ওরফে মৃণাল ও আবদুর রশিদ মালিথা ওরফে তপন মালিথা নিহত হলেও তাদের অনুসারীরা এসব দলের হাল ধরেছে। দীর্ঘদিন তৎপরতা বন্ধ রাখলেও তারা এখন মাঠে নেমে পড়েছে। এতে জনমনে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় এ তিন জেলার ওই এলাকাজুড়ে গত দুই দশকে শতাধিক ব্যক্তি চরমপন্থিদের হাতে খুন হয়েছে। এদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ও বিবদমান চরমপন্থিদের মধ্যকার সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অনেক ক্যাডার। হত্যার বদলা হত্যার ঘটনাও রয়েছে এর মধ্যে।

বহুল আলোচিত এসব হত্যাকান্ডের মধ্যে রয়েছে ১৯৯২ সালে অপূর্ব সাহা, ১৯৯৪ সালে তালার নজরুল ইসলাম, একই সালে রওশন আলী, গোপাল ঘোষ ও মনিরুজ্জামান ভুট্টো, মনোরঞ্জন দাস, ১৯৯৫ সালে খলিসখালির সাবেক চেয়ারম্যান মোক্তার খাঁ, একই সালে ডাঙা নলতার আকরাম হোসেন, নুরুল আলাউদ্দিন জোড়া খুন, ১৯৯৪ সালে আটারোইতে চার খুন, ১৯৯৬ সালে সোহরাব ও জববার খুন, একই সালে তালতলায় পাঁচ খুন, একই সালে তারাপদ দাস খুন, ১৯৯৭ সালে খলিসখালি ইউপি চেয়ারম্যান লক্ষ্মীকান্ত খুন, ১৯৯৮ সালে গোরাচাঁদ ও কার্তিক মন্ডল খুন, ১৯৯৯ সালে ইয়ামিন মাস্টার, ২০০৩ সালে মৃণাল সহযোগী সিরাজুল খুন, ২০০৪ সালে বিএনপি নেতা আলতাফসহ জোড়া খুন, ২০০৪ সালে দুলাল চৌকিদার, ২০০৫ সালে বোমা হামলায় রবীন্দ্রনাথ ও জায়গির হোসেন খুন, ২০০৬ সালে মির্জা মাসুদ খান জুয়েল খুন, ২০০৮ সালে গাছায় মহাদেব সরকার খুন, তারক দাস খুন ও ২০০৯ সালে কৃষক নেতা সাইফুল্লাহ লস্কর খুন।

এতসব খুন-খারাবির পরও এসব ঘটনায় সাজা হয়েছে কমসংখ্যক চরমপন্থির। গ্রেফতারের সংখ্যাও নগণ্য।