জাকির মাহমুদ ॥ সাংবাদিকতা নিয়ে একটা প্রচলিত গল্প আছে: একবার এক দেশের প্রধানমন্ত্রী নদীপার হবেন। তো ঘাটে একটা নৌকা বাঁধা দেখেও প্রধানমন্ত্রী কী ভেবে সাঁতরে অন্য পারে চলে গেলেন। পরদিন একটা পত্রিকায় লেখা হলো, ‘প্রধানমন্ত্রী নদীপারের দেশে গিয়েছেন’। আরেকটা পত্রিকার শিরোনাম হলো, ‘কায়িক পরিশ্রমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী!’ অন্য আরেকটা পত্রিকায় লেখা হলো, ‘প্রধানমন্ত্রী নৌকা চালাতে জানেন না!’
হয়তো প্রত্যেকটা শিরোনামই ঠিক। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা প্রত্যেকে কিন্তু সবগুলো সত্য দেখতে পাইনা, দেখি যেকোনো একটা- এবং তার উপর ভিত্তি করেই একটা মতামত দাঁড় করিয়ে ফেলি। এজন্য একটা পত্রিকা পড়লে যাকে দেবতা মনে হয়, অন্য পত্রিকা দেখে তাকেই দানব ভাবা হয়। এটা হলো জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মিডিয়ার একটা কৌশল।
একটা খুব সহজ উদাহরণ দেই: এক বরেণ্য ব্যক্তিকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তো তিনি কী কী ভালো কাজ করেছেন এগুলো যখন আমি বলে শেষ করেছি তখন আমার বন্ধু ফিরিস্তি দিতে লাগলো ঐ ব্যক্তির দুর্নীতি আর অপরাধের। শুনে তো আমি থ’; কারণ এর কিছুই আমি জানিনা। আবার আমার বন্ধুও আমার মুখ থেকে ঐ লোকের প্রশংসা শুনে যরাপরণাই অবাক, কারণ এগুলো সে জীবনে প্রথমবারের মত শুনছে। এবং আমাদের দুজনেরই তথ্যসূত্র হলো পত্রপত্রিকা। তাহলে ব্যাপারটা কী হলো? আমার কাছে লোকটা ছিলেন দেবতার মত পরিশুদ্ধ, কারণ আমি যে পত্রিকা পড়ি তাতে কেবল তার ভালো দিকটাই লেখা হয়। আর আমার বন্ধুর বেলায় ব্যাপারটা উল্টো।
এটা তো গেল খুব সাধারণ একটা ঘটনা, যার সরাসরি কোনো প্রভাব আমাদের জীবনে নেই। কিন্তু এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে মিডিয়া পুরোপুরি আমাদের জীবনাচার বা চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়েও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জোর বেশি, বিশেষত তরুণদের কাছে। পোশাকের ব্যাপারটাই ধরি।
বাজারে এখন কাপড় চলে নায়ক/নায়িকার নামানুসারে। ‘চন্দ্রমুখী’ কামিজ বা ‘মাসাক্কলি’ ‘আনারকলি’তে বাজার ভরপুর। এবং ছেলেদের পোশাকেরও একই অবস্থা। একটা পাঞ্জাবী দেখলাম, নাম হলো ‘হাশমী পাঞ্জাবী’ (ঐ জামাটার বিশেষত্ব হলো এটা গায়ে দেয়ার পর বুক-পেটের ৮০% দেখা যায়!); নাম শুনে আমি ভাবলাম এটা হয়তো কোনো আরবদেশীয় পোশাক, গরমের দেশ বলে খোলামেলা জামা তারা গায়ে দেয়। পরে দেখি এটা এসেছে ভারতের বিখ্যাত নায়ক ইমরান হাশমীর নাম থেকে। এবং এই ‘কালেকশন’ নাকি এখন ‘চরম হিট খাইছে’! আবার যারা অতিরিক্ত মডার্ন, তারা বলিউডেই সীমিত না, তারা অনুসরণ করে হলিউডের নায়ক-নায়িকাদের। ছোট পায়জামা-বড় জামা, কোমরের এক বিঘত নিচ থেকে প্যান্ট পরা, চুল খাড়া করে রাখা (এটাকে ‘স্পাইক’ অথবা ‘স্পাইস’ বলে বোধহয়!), ভীষণ টাইট জামা গায়ে দেয়া–এগুলো হলো সেই অন্ধ অনুকরণের নিদর্শন।
কাপড় তো আছেই, বাসার ফার্নিচার বা বাসনকোসনও কোনটা ভালো –সেটা নির্ভর করে এর গুণগত মানের উপর না, বরং কোন মডেল কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন করলো তার উপর। পছন্দ থাকতেই পারে; বিখ্যাত কোনো তারকার জন্য উন্মুখ হওয়াটা তো নতুন নয়- আমাদের সময়েও তা ছিলো। কিন্তু এই আসক্তি কেন? কেন ছবি মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে নায়কের মত চুল ছাঁটতে হবে?কেন গান হিট করা মাত্রই মার্কেটে গিয়ে নায়িকার মতন পোশাক কিনতে হবে?
সবচেয়ে ভয়ের জায়গা হলো মিডিয়া আমাদের চিন্তাভাবনাকে পুরো নিজের মত করে পরিচালিত করছে। আমাদের এক প্রতিবেশীর সুখের সংসারে আজকাল নিত্য ঝগড়াঝাটি হচ্ছে। কেন?কারণ স্ত্রীর মনে হয়েছে তার স্বামী পরকীয়া করছে। সারাজীবন যে লোকটার রোটেশনাল ডিউটি, ঢাকার বাইরে প্রায়সময় থাকতে হয়- ১৫ বছর পর সেই লোকটাকে সন্দেহ করার কারণ কী?কারণ ‘অপর্ণা’র স্বামীও নাকি এমনটা করেছে! আজকাল সিনেমায় দেখানো হচ্ছে, যেটা চাও সেটার জন্য লড়াই করো, কখনও ছেড়ে দিওনা। মেয়েরা দেখছে: তাদের ‘হিরো’ সবকথায় হ্যাঁ বলবে, তাদের জন্য সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই করবে এবং ‘একটুখানি হাসির জন্য’ সব চিৎকার চুপচাপ শুনবে। আর ছেলেরা দেখছে: সব থেকে সুন্দর মেয়েটি সব থেকে যোগ্য ছেলেটিকে বাদ দিয়ে তার কাছে আসবে কারণ ‘ভালোবাসা হলো সবচেয়ে বড়’, মুখ বুজে সমস্ত কাজ করবে কারণ প্রেমিক খুশি থাকলেই সে খুশি! এর ফলাফল হলো সবাই ভাবছি বাস্তবেও তাই হবে। স্বামী ভাবছে স্ত্রী ছাড় দেবে, স্ত্রী ভাবছে স্বামী কম্প্রোমাইজ করবে। মাঝখান দিয়ে সংসারে ভাঙন ধরছে, অশান্তি হচ্ছে।
চন্ডীদাস লিখেছিলেন, “হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া কাঁদিতে জনম গেল-”। এই কথাটা কি আজকালের ছেলেমেয়েরা জানে?নাকি তারা ভাবে “হাসিতে হাসিতে”ই পুরো জনম কাটবে?তাই কি তারা কেবল প্রেম করা নিয়ে ব্যস্ত?সুন্দর থাকা, স্লিম থাকা, আর আড্ডা দেয়াতেই কি জীবন শেষ?বিজ্ঞাপণ দেখে ভাবছি হিরের গয়না দিলেই “সুখ চিরন্তন” হয়ে গেল! কিন্তু আংটির হিরেটাই কেবল চিরদিনের, সুসম্পর্ক না –এই বোধ কি কারো আছে?প্রত্যেক সকালে কাজে যেতে হবে, বসের ঝাড়ি খেতে হবে, যা চাইবো তা না-পাওয়ার দুঃখ নিয়ে ঘুমাতে যেতে হবে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে নিজেকেই ছাড় দিতে হবে, অহমকে আঁকড়ে ধরে থাকলে হবে না– এই শিক্ষা কি মিডিয়া আমাদের দেয়?নাকি মাথায় ঢুকিয়ে দেয় একটা ল্যাপটপ, একটা গার্লফ্রেন্ড, একটা মোটরসাইকেল আর দামি ফোন হলেই জীবনে চরম শান্তি পাওয়া যাবে?
মিডিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো এর আকর্ষণী ক্ষমতা চরম। আমাদের ভীষণভাবে তা আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে। এই যে পাশ্চাত্যের জীবনযাপনের জন্য আমাদের এত হাহাকার, কেন? কারণ আমরা ছবিতে দেখি ওখানকার সবকিছু ভালো- পথঘাট সুন্দর, দোকানপাট সুন্দর, ওখানকার মানুষেরাও সুন্দর। আর যত খারাপ তা হলো বাংলাদেশে। বাইরের দেশে কোনো দুর্নীতি নাই, ওখানকার মানুষেরা কোনো অসৎ কাজ করেনা, ওখানকার বাবা-মা’রা সন্তানকে বেশি ভালোবাসে, স্বামী-স্ত্রীরা ছবির মতন সুখেশান্তিতে দিন কাটায়। কিন্তু আসলেই কি তাই? মেশিনের মত যে জীবন তাদের তা কী আসলেই আমরা কামনা করি?একসাথে বের হয়ে আমার যে সহপাঠী ৬অংকের বেতন নিয়ে বাইরে চলে যায় তাকে হিংসে করেছি দীর্ঘদিন। কিন্তু ৮/৯ বছর পর, আজ কে বেশি ভালো আছে?একই বেতন পেয়েও যে স্বচ্ছল জীবন আমি যাপন করি তা কি সে পারে?না; কারণ উপার্জন বেশি- এটা দেখা যায়, খরচটাও যে বেশি, অনিশ্চয়তা আর অমানুষিক চাপ –তা কিচোখে পড়ে? আজ যে তরুণদের দেখি ‘আমেরিকা’ নামক স্বপ্নে বিভোর, তারা কি জানে যে স্টারমুভিজ আর এইচ.বি.ও –র জীবনটা বাস্তব না?এই যে আজকাল সবাই দেশ ছাড়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে -এর পেছনেও কি মিডিয়া কর্তৃক সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণাই দায়ী নয়?
মিডিয়া তো একটা রঙিন চশমা মাত্র: বাস্তবতাকে সে ঢেকে দেয়- বাস্তবতা তৈরি করতে কি সে পারে? এই বুঝেও আমরা তাহলে কেন মিডিয়ার অন্ধ অনুকরণ করি?কেন আংশিক চাকচিক্য দেখে আমরা পুরোটাই স্বর্ণ ভেবে নেব?মিডিয়ার প্রয়োজন অনস্বীকার্য; কিন্তু তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করাটা কি কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে?
–Zakir Mahmud
Medical Officer at National Healthcare Network (NHN)