আজ মহাসমাবেশ – আল্টিমেটাম, হরতাল, বিক্ষোভ, সমাবেশসহ জোট সম্প্রসারনের ঘোষণা আসছে

খোন্দকার কাওছার হোসেন ॥ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মহাসমাবেশ আজ। এ মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য আল্টিমেটাম দিয়ে হরতাল, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, জেলা ও বিভাগীয় শহরে সমাবেশের সিরিজ কর্মসূচিসহ জোট সম্প্রসারনের ঘোষণা আসছে বলে বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

এর বাইরে এ মহাসমাবেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা ঘোষণা করবেন বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। আজ (সোমবার) মহাসমাবেশের পরই সংসদে যোগ দিয়ে এ রূপরেখা তিনি জাতীয় সংসদেও পেশ করতে পারেন বলে বিস্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপি বরাবরই বলে আসছে এ মহাসমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তারপরও এ মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে তাতে বিএনপি কঠিন কর্মসূচির কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। সে কারণে হরতালের ঘোষণা আসতে পারে। সঙ্গে বিভাগীয়, জেলা ও থানায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ও সমাবেশসহ সিরিজ কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেন খালেদা জিয়া। সিরিজ কর্মসূচির মধ্যে অসহযোগ কর্মসূচির ঘোষণাও থাকতে পারে।

নেতারা জানান, তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য সরকারকে ৩ মাসের সময় দিয়ে আল্টিমেটাম দেবেন খালেদা জিয়া। এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে হরতাল অসহযোগসহ কঠোর কর্মসুচি ঘোষণা করা হবে বলে সরকারকে হুসিয়ারি দিবেন তিনি।

বর্তমান ৪ দলীয় জোট সম্প্রসারিত করে ১৬ দল নিয়ে একটি নতুন জোট গঠনের কথা জানিয়ে তার ঘোষণাপত্রও এ সমাবেশে পাঠ করা হবে।

শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি
প্রায় ২ মাস আগে এ মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়া হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গতকাল রোববার বিকেল ৫টায় শর্ত সাপেক্ষে মহাসমাবেশের জন্য অনুমতি দিয়েছে।

বিএনপি সূত্র জানায়, ১১টি শর্তে মহাসমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত সমাবেশ করতে হবে। এ এলাকার বাইরে মহাসমাবেশ করা যাবে না, বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে মহাসমাবেশ শেষ করতে হবে। মহাসমাবেশ শুরু করতে হবে ঠিক দুইটায়। এর আগে নয়। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে সমাবেশের এলাকা বাড়ানোর জন্য ডিএমপির নিকট আবেদন করা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত (পৌনে ৯টা) ডিএমপির জবাব জানা যায়নি।

বিরোধীদলের রাজনীতি সরকারের অনুমতি নির্ভর নয়
বিরোধীদলের রাজনীতি সরকারি দলের অনুমতির ওপর নির্ভর করে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সরকারি দল কখনই বিএনপির কর্মসূচিকে অনুমতি দেয় না। তার জন্য বিএনপির সভা-সমাবেশ থেমেও থাকবে না। সরকার ১২ তারিখের কর্মসূচিকে সামনে রেখে দেশে গণ গ্রেপ্তার শুরু করেছে এবং বাড়ি বাড়ি তল্লাশিসহ দেশকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। সরকার যতই বাড়াবাড়ি আর অবরুদ্ধ করুক না কেন আমাদের কর্মসূচি চলবেই।
তিনি সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, বিরোধীদলের রাজনীতি তাদের অনুমতির ওপর নির্ভর করে না। তবে সরকার যদি ১২ তারিখের কর্মসূচি নিয়ে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করে তবে এর জবাব তাদের একদিন দিতেই হবে।

মঞ্চ নির্মাণ শুরু
মঞ্চ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দুদিন আগেই এনে রাখা হলেও পল্টন থানা পুলিশের বাধায় তা বানাতে পারেনি কর্মীরা। গতকাল সন্ধার পরে মঞ্চ নির্মানের কাজ শুরু হয়।  তবে পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। মতিঝিল জোনের এসি ও পল্টন থানার ওসিসহ কয়েকশ পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বিএনপি অফিসের সামনে।

পুলিশের কয়েকটি দল লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেও একটি দল ব্যস্ত রয়েছে তল্লাশিতে। বিএনপি অফিসের কয়েক গজ পূর্ব দিকে একদল পুলিশ রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ি তল্লাশি করছে। তারা সন্দেহভাজন পথচারীদেরও বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন।

মঞ্চ বানানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচারের জন্য মাইক লাগানোর কাজও শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে চলছে গান।

৬ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকের নিরাপত্তা বলয়
মহাসমাবেশ নির্বিঘ্ন করতে নিজস্ব নিরাপত্তা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। সহযোগী সংগঠনগুলোর বাছাই করা ছয় শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এরই মধ্যে মহাসমাবেশের নিরাপত্তা মঞ্চ ও আশপাশের এলাকার একটি ম্যাপ করে কে কোথায় থাকবে তা ঠিক করা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো শুরু হয়েছে।

বিএনপি কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, যুবদলের ২৫ জন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী গোল চত্বরে ও ২৫ জন কাকরাইল মোড়ে, স্বেচ্ছাসেবক দলের ২৫ জন নাইটেঙ্গল মোড়ে নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

মঞ্চের পশ্চিম পাশে বিএনপির সিনিয়র নেতা ও অতিথিদের পাহারায় থাকবে ৫০ জন করে। নাইটেঙ্গল মোড় থেকে ভিআইপি ও অতিথিদের স্থান পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে আইন-শৃংখলা উপ-কমিটির ৩০ জন। এর সামনে মঞ্চের পশ্চিম ও দক্ষিণ কর্নারে থাকবে ছাত্রদলের ৫০ জন।  মঞ্চের সামনে বিএনপি কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে থাকবে ১৫০ জন কর্মী। বিএনপি অফিসের পূর্ব পাশে থাকবে জাসাসের ৫০ জন। মঞ্চের ঠিক পূর্ব পাশে থাকবে ছাত্রদলের ৫০ জন।  এর বাইরে ফকিরাপুল মোড়ে ছাত্রদলের ২৫ জন, আরামবাগ পুলিশ বক্সে স্বেচ্ছাসেবক দলের ১৯ জন ও শাপলা চত্বরে তাঁতীদলের ৩০ জন নিয়োজিত থাকবে।

এছাড়া দৈনিক বাংলা মোড়ে শ্রমিক দলের ৩০ জন, পল্টন মোড়ে কৃষক দলের ২০ জন, প্রেসক্লাবে ওলামা দলের ২০ জন ও কাকরাইল মসজিদের সামনে মৎস্যজীবী দলের ২০ জন কর্মী থাকবেন।

নেতাকর্মীদের আড্ডা
রোববার দুপুর থেকে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঘোরাঘুরি করছেন কী হচ্ছে তা জানতে, কেউ দল বেধে মারছেন আড্ডা। কেউবা পুলিশের চোখকে ফাকি দিয়ে ঢাকায় আসার রোমাঞ্চকর বর্ণনা শোনাচ্ছেন সহকর্মীদের।

সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে জটিলতা
সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্ত বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)র পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় ও জনস্বার্থে এ ধরনের একটি কর্মসূচি সরাসরি সম্প্রচার না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ কারণে এ কর্মসূচি সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কিন্তু কোনো ধরণের বাধা না পেলে www.bnplive.com এ ইন্টানেটের মাধ্যমে এ কর্মসুচি সরাসরি সম্প্রচার করবে বিএনপি।

খালেদার নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন
মহাসমাবেশের সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে  আবেদন জানিয়েছে বিএনপি।
গতকাল রোববার দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ আহ্বান জানানো হয়।

আবেদনে বলা হয়, পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচির আওতায় রাজধানীর নয়াপল্টনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আয়োজিত মহাসমাবেশ করবেন।

এতে আরো বলা হয়েছে, মহাসমাবেশের সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সহযোগিতা চাই।

শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদেরও পাশে চান খালেদা
কর্মসূচি সফল করতে দেশের সৃজনশীল মানুষ অর্থাৎ শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদেরও পাশে চান বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

কর্মসূচি সফল করতে ধারাবাহিক মতবিনিময় সভার অংশ হিসেবে গুলশান কার্যালয়ে দেশবরেণ্য শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি যার যার অবস্থান থেকে ১২ মার্চের কর্মসূচি সফল করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করার আহ্বান জানান তাদের। একই সঙ্গে নিজেদের প্রজ্ঞা, মেধা, মনন ও সৃজশীলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সংকটময় মুহূর্ত উত্তরণে জাতীয়তাবাদী শক্তির পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

রাজধানীতে দুর্ভোগ
পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ রাখা হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা বেশ কয়েকটি গণপরিবহন। ফলে সাত সকালেই পথে পথে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন অফিসগামী যাত্রীরা। সকাল সাতটা থেকেই স্বল্প যান আর যাত্রীর দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে প্রধান সড়কগুলোতে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক বাসই আদায় করেছে বাড়তি ভাড়া। এ নিয়ে জায়গায় জায়গায় রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা গেছে যাত্রী-কন্ট্রাক্টর আর হেলপারের বচসা। কোনো কোনো রুটে এ নিয়ে দেখা গেছে হাতাহাতির ঘটনাও।

যেকোনো পরিস্থিতিতে সমাবেশ
যেকোনো পরিস্থিতিতে মহাসমাবেশ আয়োজনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রোববার বলেন, সরকার সমাবেশকে সামনে রেখে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। ঢাকা শহরকে পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন প্রায় ৫ হাজার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।

এছাড়া দৌলতদিয়া ও আরিচা, সদরঘাট, কমলাপুর, কাঁচপুর, গাবতলীসহ রাজধানীতে আসার বিভিন্ন পয়েন্ট সম্পূর্ণ বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর লাল বাহিনী ও আওয়ামী বাহিনী দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, যাই হোক না কেন মহাসমাবেশ হবে, আমাদের নেত্রী আসবেন এবং বক্তব্য রাখবেন।

প্রশাসন ধাপ্পাবাজি করছে: রিজভী
১২ মাচের কর্মসূচি নিয়ে প্রশাসন আমাদের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি করছে বলে মন্তব্য করে বিএনপির দপ্তর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী গতকাল রোববার সকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, প্রশাসনের কোনো নিরপেক্ষতা নেই। তারা বিরোধী দলের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি শুরু করেছে। এটা কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ নয়।

তিনি আরও বলেন, আমি চিরন্তনভাবে বলতে পারি ১২ মার্চের মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু সরকার পরিকল্পিতভাবে এ কর্মসূচিকে সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই কর্মসূচিতে বাধা দিলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।