সংখ্যালঘু একটি পরিবারের ভিটেমাটি কেড়ে নেয়ার পায়তারা

জহুরুল ইসলাম, গৌরনদী ॥ পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামীলীগ নেতাসহ ক্ষমতাসীনদলের ১২ নেতারা একটি হিন্দু পরিবারের ভিটে মাটি কেড়ে নেয়ার পায়তারা করেছে বলে পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন । জমির বৈধ মালিকের ওয়ারিসকে ধরে নিয়ে জোর পূর্বক পরিচিতিদানে বাধ্য করতে চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। ঘটনাটি ঘটেছে বরিশালের গৌরনদী পৌরসভা সদরের সুন্দরদী গ্রামে। ভিটেমাটি কেড়ে নেয়ার আশংকায় নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে পরিবারটি।

সরেজমিনে গিয়ে পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় লোকজন, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালের গৌরনদী পৌর সদরের ১নং ওয়ার্ডের সুন্দরদী মৌজার এসএ ২৯ নং খতিয়ানের ২০৯১ নং দাগের ৭৬.৪৪ শতাংশ জমির রেকর্ডিয় মালিক ওই গ্রামের মৃত কৃঞ্চ কুমার  চন্দের পুত্র মৃত গোপি নাথ চন্দ। কানাই লাল চন্দ (৬৫) বলেন,  ওই বাড়িতে বাবার তৈরী পাকাভবনেই আমার জন্ম  জন্মের পর থেকে আমি ওই বাড়িতে অদ্যবধি বসবাস করে আসছি। স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী একটি চক্র গত তিন বছর ধরে তারা বিভিন্নভাবে সম্পত্তি ভোগ দখলের চেষ্টা চালায়। তিনি অভিযোগ করেন, পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও পৌরসভা ১নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন দুলাল সুন্দরদী গ্রামের মৃত গোবিন্দ চন্দের দত্তের ওয়ারিস হিসেবে পাশ্ববর্তী উজিরপুর উপজেলার রাখালতলা গ্রামের স্বপন দত্ত তার  সহদর মৃত নিকুঞ্জ  দত্তের দুই পুত্র সুবল দত্ত ও অপূর্ব দত্তকে ওয়ারিস সনদ প্রদান করেন। প্রকৃত পক্ষে তারা ওয়ারিস না। স্বপন, সুবল  ও অপূর্ব দত্তকে ভূয়া ওয়ারিস সনদ দিয়ে পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও পৌরসভা ১নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন দুলাল, ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও গৌরনদী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের যুগ্ম আহবায়ক কাজী তৌফিক হাসান স্বজল, ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মোঃ খাইরুল খান, পৌর যুবলীগের আহবায়ক মোঃ দিদার হাওলাদার, সংসদ সদস্যের ছোট ভাই মোঃ আনিচ তালুকদার, তার চাচাতো ভাই উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য মোঃ রুবেল তালুকদার মোঃ শাহদাত তালুকদার, ইউপি সদস্য ও যুবলীগ সদস্য মোঃ মিলন হাওলাদার, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবলীগের সদস্য আল আমিন, গোলাম মোস্তফা চুন্নু সিকদার, মোঃ জুয়েল খান ও সমীর সরকার ওই সম্পত্তি সাব কবলা দলিল করার জন্য গত ১৬ জানুয়ারি গৌরনদী সাব রেজিষ্টার অফিসে যান। আওয়ামীলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও যুবলীগ নেতারা কানাই লালের পুত্র শিপক চন্দকে পরিচিতি দানের জন্য ধরে নিয়ে যায়। শিপক দলিলে পরিচিতি দিতে অস্বীকৃতি জানালে যুবলীগ নেতারা তাকে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন চালায়।  পুলিশ ওই দিন রাত ৯টায় শিপক চন্দকে উদ্বার করে। স্থানীয়রা জানান, মোটা অংকের উতকোচ গ্রহন করে গৌরনদী সাব রেজিষ্টার অসীম কল্লোল গত ২৮ ফেব্রয়ারি জমি রেজিষ্টারি সম্পন্ন করেন। কানাই লাল চন্দ ও তার স্ত্রী আলো রানী চন্দ অভিযোগ করেন। নেতারা দলিল নেয়ার পর থেকে প্রতিদিন রাতে মুখোসধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বাড়িতে এসে বাড়ি ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেয়। বাড়ি ছেড়ে না গেলে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। তাছাড়া দিনে দলবল নিয়ে এসে নেতারা মহড়া দেয়। গৌরনদী সাব রেজিষ্টার অফিসের অফিস সহকারী মোঃ আবুল হাসেম জমি রেজিষ্টারির কথা স্বীকার করে জানান, স্বপন দত্ত, সুবল দত্ত, অপূর্ব দত্ত, দাতা হিসেবে ১২ জন গৃহীতাতে সাব কবলা দলিল প্রদান করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক নেতা জানান, ওই সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল প্রায় দেড় কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ভূয়া ওয়ারিস সনদ দিয়ে মালিক বানিয়ে নিজেরা দলিল নিয়ে ক্ষমতার জোরে ভোগ দখল করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে গৌরনদী সাব রেজিষ্টার অসীম কল্লোল বলেন, আইনে বলা আছে আমি যদি মনে করি জমি রেজিষ্টারি করা যাবে তাহলে সেই জমি রেজিষ্টারি করতে বাধা নেই। ওয়ারিস সনদ ভূয়া হলে তার দায় দায়িত্ব আমার নয়।
নামজারি ছাড়া জমি রেজিষ্টারি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওয়ারিস সনদ থাকলেই হয় । বার্থী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানান, উপজেলার সুন্দরদী মৌজার  ওই জমির এস রেকর্ডিয় মালিক মৃত কৃঞ্চ কুমার চন্দর পুত্র মৃত গোপী নাথ চন্দ।  স্বপন দত্ত গংদের নামে কোন বৈধ কাগজপত্র ও রেকর্ড নেই। গৌরনদী উপজেলা ভূমি অফিসের একটি সূত্র  জানান, অফিসের কাগজপত্র অনুযায়ী জমির প্রকৃত মালিক  কানাই লাল। স্বপন দত্ত গং ওয়ারিস সুত্রে মালিকানা দাবি করা হয় তার কোন বৈধতা নেই। গৌরনদী উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শুনেছি ওয়ারিস সদন অনুযায়ী জমি রেজিষ্টারি করা হয়েছে। এ্যাডভোকেক মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, স্বপন গংদের দাবির বৈধতা নেই। গৌরনদী উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক আহবায়ক কালিয়া দমন গুহ এ প্রসঙ্গে বলেন, জমির বৈধ মালিক কানাই চন্দ। আওয়ামীলীগ নেতা ওয়ার্ড কমিশনারের দেয়া ওয়ারিস সনদের কোন সত্যতা নাই। দলিল নিয়ে ক্ষমতার জোরে নিরহ হিন্দু পরিবারের জমি দখল করে পরিবারটিকে দেশ ছাড়ার পায়তারা করেছে।

ওয়ারিস সনদ দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে মোঃ দেলোয়ার হোসেন সিকদার বলেন, আমি কোন ভূয়া ওয়ারিসকে সনদ দেইনি। জমি ক্রয়ের কথা স্বীকার বলেন, বিক্রেতার কাছ থেকে ন্যয্য মূল্য দিয়েই জমি ক্রয় করেছি। জমি বিক্রেতা স্বপন দত্ত, সুবল দত্ত, অপূর্ব দত্তের কাছে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বৈধ মালিক দাবি করেন।  রেকর্ড না থাকা প্রসঙ্গে বলেন, রেকর্ড পাওয়ার জন্য মামলা করেছি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী তৌফিক স্বজল, মোঃ খায়রুল আহসান, গোলাম মোস্তফা চুন্নু, আল আমিন, রুবেল তালুকদার, শাহদাত তালুকদার, মিলন হাওলাদার জমি ক্রয় ও অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, আমরা কোন ভূয়া ওয়ারিস বানিয়ে জমি ক্রয় করি নাই। বৈধ ওয়ারিসের কাছ থেকে ন্যয্যমূল্যে জমি কিনেছি। গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম বলেন, জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে কানাই লাল চন্দের পরিবার সাধারন ডায়রী করেছে। বাব দাদার ভিটেমাটি রক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন ওই পরিবারের সদস্যরা।