আওয়ামী লীগের জনসভার মিডিয়া কভারেজ ভালো হয়নি!

ফজলুল বারী : বিএনপির মহাসমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগের জনসভার মিডিয়া কভারেজ ভালো হয়নি। এর মানে কী শাসকদলের জনসভা তুলনামূলক ফ্লপ নয়? মিডিয়ার সঙ্গে শাসকদলের সম্পর্ক শীতল যাচ্ছে না? কারণ অন্যখানে, তা দেশের ওয়াকিবহালরাই ভালো বলতে পারবেন।

এমনিতে সাধারণ বিবেচনায় দেশের রাজনীতি বা অন্যকিছুতে যখন যেখানে ব্যারিকেড পড়ে, সেক্ষেত্রে ব্যারিকেড ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে আলাদা আগ্রহের সৃষ্টি হয়। বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ে সরকারি ব্যারিকেড আর আওয়ামী লীগেরটা সফল করতে স্পষ্ট সহযোগিতা ছিল। বিএনপির মহাসমাবেশে ব্যারিকেড ডিঙিয়ে যোগ দেওয়া নিয়ে প্রায় সব মিডিয়ায় আলাদা রিপোর্ট অথবা শিরোনাম ছিল। সরকারি ব্যারিকেড জব্দ করা নিয়েও অনেক রিপোর্টে আলাদা জোশ ছিল। খালেদা নতুন কী কর্মসূচি দেন না দেন তা নিয়েও কৌতূহল ছিল দেশের মানুষ আর মিডিয়ার। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পাল্টা জনসভায় ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ জাতীয় গতানুগতিক রাজনৈতিক বার্তা ছাড়া তেমন কিছু ছিল না।

শেখ হাসিনার বক্তব্যও ছিল খালেদাকে জবাব দেওয়ামুখী। ‘যে দেশের টাকা খেয়েছেন, সে দেশে’ অর্থাৎ ‘পাকিস্তানে চলে যান’ জাতীয় বক্তব্যকেই শিরোনাম করেছে প্রায় সব মিডিয়া। মুন্সীগঞ্জের লঞ্চডুবি আর সমুদ্রসীমা নিয়ে করা মামলায় জয় বিষয়েও বেশিরভাগ মিডিয়ার স্বাভাবিক নজর ছিল বেশি। জনসভার বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বলেছেন, মিডিয়া স্বাধীনভাবে যা খুশি লিখছে-বলছে, সরকার বাধা দিচ্ছে না। মিডিয়া এখন যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন সন্দেহ নেই। অনলাইন মিডিয়া, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্লগ ইত্যাদি শক্তিশালী হয়ে ওঠাতে এখন কোনো তথ্য গোপন করা বা এড়িয়ে চলাও কঠিন। মিডিয়ার স্বাধীনতা অপব্যবহার করে অনেক স্বেচ্ছাচারও চলছে। সে কারণে ‘উত্তরা ষড়যন্ত্রের নায়ক’ মাহমুদুর রহমানও দেশের এক নম্বর তারকা সম্পাদক (!) বনে গেছেন এবং পেশাদার অন্য সম্পাদকরাও তা মেনে নিয়েছেন! পাশাপাশি সত্য, সরকারি অদৃশ্য হস্তক্ষেপে একাধিক চ্যানেলে বিএনপির মহাসমাবেশের লাইভ সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।
 
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের মূল সুর ছিল আগামী নব্বই দিনের মধ্যে নির্দলীয় সরকার মানতে হবে। শেখ হাসিনার বক্তব্যে এর সরাসরি জবাব নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সব নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে। এর মানে সরকার ভবিষ্যৎ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কোনো উদ্যোগ নিতে এখনই ইচ্ছুক না! নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের মনে যে পরিকল্পনা আছে (শোনা যায় ফর্ম‍ুলাটি  বিএনপির কাছেও দেওয়া আছে), সে বিষয়টিও তারা এখনই ফ্লোরে আনছে না।

একাধিক সূত্রমতে সরকারি চিন্তায় আগামী নির্বাচন পরিচালনার জন্য বর্তমান পার্লামেন্টের এমপিদের নিয়েই একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরিকল্পনা আছে। বর্তমান সরকারি ও বিরোধীদলের এমপিদের মধ্যে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না, এমন এমপিদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চিন্তা। সরকারিদল যে এখন অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধিতা করছে, এতে সে ধারণাটিকে সম্মান দেওয়া হবে।

সূত্রগুলোর মতে, এ ধরনের একটি ফর্মুলার আভাস পেয়েই খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে নির্দলীয় সরকারে সরে এসেছেন। আবার যেহেতু দলীয় এমপিদের নিয়ে প্রস্তাবটি, সেক্ষেত্রে এটিকে নির্দলীয়ও বলা যাবে না।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই ফর্মুলার উদ্যোক্তারা বর্তমান সংসদের সদস্য অনুপাতে সরকার তথা কেবিনেটের সদস্য নির্ধারণের পক্ষে। নেপথ্যে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতা না এগোনোয় ফর্মুলাটি এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। আবার কৌশলগত কারণে বিএনপি তা নাকচও করে দেয়নি। সে কারণে অনেকে মনে করেন, বিএনপি আগামীতে নির্বাচন বয়কট করবে, এ ধারণাটিও সঠিক না। এই সরকারের অধীনেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিএনপি যে কয়টি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই ভালো করেছে। বিএনপির নেপথ্যের উপদেষ্টাদের হিসাব হচ্ছে, আগামী নির্বাচন আসতে আসতে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও কমবে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে চলতি রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রেখেই বিএনপি আগামী নির্বাচনে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাফল্য দেখাতে পারলে তাতে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি হয় কিনা, তা নিয়ে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী মহলের উদ্বেগও আছে। যুদ্ধাপরাধী মামলায় দলের প্রধান নেতাদের জেলে রেখে  এই মুহূর্তে নির্বাচনে যাবার অবস্থাও জামায়াতের নেই।
 
সূত্রমতে খালেদার উপদেষ্টারা তার বক্তব্যকে সংযত রাখার কৌশল নিয়েছেন। খালেদা ইদানিং দলের স্থায়ী কমিটিসহ নানান লোকজনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। তাদের পরামর্শ শুনছেনও। শেখ হাসিনাকে এমন বলতে পারার, পরামর্শ দিতে পারার মতো বুকের পাটা নাকি কারোর নেই! দুই নেত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যেও এসবের প্রভাব-প্রকাশ স্পষ্ট। এর আগে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে তাকে কোলে তুলে ক্ষমতায় বসাবে না। মহাসমাবেশের বক্তৃতায় খালেদা এর জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাহলে কী ফখরুদ্দিন-মইন তাকে ওভাবে ক্ষমতায় বসিয়েছে?’ এক্ষেত্রে খালেদা শেখ হাসিনার মতো ‘কোলে তুলে’ কথাগুলো ব্যবহার করেননি। খালেদা জিয়ার ‘নুলা-ল্যাংড়া করে দেওয়ার’ মতো শেখ হাসিনার এই ‘কোলে তুলে’ বক্তব্যেরও সমালোচনা হয়েছে।

১৪ মার্চের জনসভায় আইএসআইয়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা খালেদার উদ্দেশে বলেছেন, ‘যেখান থেকে টাকা নিয়েছেন, সেখানে চলে যান’। বিএনপির তরফ এর যথাযথ জবাব দেওয়া হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের পত্রিকায় খবরটি ছাপা হওয়ার পর  টাকা দিয়ে নিউজ ছাপানো হয়েছে বলে বিএনপির তরফে গতানুগতিক দাবি করা হয়েছে। যেমন, সিঙ্গাপুরের স্ট্রেট টাইমস পত্রিকায় কোকোর টাকার বৃন্তান্ত ছাপা হওয়ার পরও একইকথা বলেছিল বিএনপি। খালেদা জিয়ার পরিবারের টাকাপয়সা-বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে বিএনপির ঈমানি অবস্থা বরাবরই এমন কমজোরি! আইএসআইয়ের প্রধান পাকিস্তানের আদালতের মুচলেকায় এমন বলে থাকলে সরকার সেটি জোগাড় করে এনে দেশের মিডিয়াকে দিতে পারে। না বলে থাকলে তা দিতে পারে বিএনপি। কিন্তু অভিযোগের ডকুমেন্টশনে কাউকে এখনও আন্তরিক মনে হচ্ছে না।
 
লেখক: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম