সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ হবে কবে

বর্তমানে বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কে নিয়মিতভাবে ঘটেচলা দুর্ঘটনা দেশবাসীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ সড়ক-মহাসড়কে চলাচলে মোটেই নিরাপত্তা অনুভব করছে না এখন। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয় তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পত্রিকার পাতা খুললে প্রতিদিনই চেখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়; যা এ সময়ের অন্যতম বড় সড়ক দুর্ঘটনা। সর্বশেষ গত ১১ মে একই দিনে বিভিন্নস্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক বিভাস চন্দ্র সাহা, বরিশালের উদিয়মান ফটো সাংবাদিক শহিদুজ্জামান টিটু, বর্ষীয়ান রাজনীতিক ইফতেখার হোসেনসহ ঝড়ে যায় ১৫টি অমূল্য প্রাণ।

এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত দেড় বছরে শুধু ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১৮০ এবং আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। সরকারী এক হিসেবে বলা হচ্ছে, গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ মারা গেছেন। বেসরকারী হিসেবে অবশ্য এ সংখ্যা অনেক বেশি। বেসরকারী বিভিন্ন সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে, এক বছরেই দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা কি এভাবেই ঘটতে থাকবে? মানুষজন প্রাণ হারাবে আর আহত হওয়াসহ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করবে? প্রত্যেক সচেতন জনগণই এ প্রশ্নের উত্তরে বলবেন, না। এ অবস্থা চলতে পারে না এবং তা কোনভাবেই চলতে দেয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনারোধে দ্রুত সমাধানের উপায় খোঁজাসহ এর বাস্তবায়ন জরুরী। আর সড়ক দুর্ঘটনা রোধের উপায় খুঁজতে হলে সর্বাগ্যে সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বিপজ্জনক বাঁক, ক্রটিপূর্ণ নকশা আর চালকদের বেপরোয়া গতি। আর দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিপজ্জনক বাঁক আর চালকের বেপরোয়া গতির কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা হচ্ছে। তবে নদীসংলগ্ন এলাকাগুলোয় বাঁকগুলো অনেক বেশি। বাসের চালকগন এসব বাঁক অতিক্রম করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি ঠিকভাবে দেখতে পান না। কোন কোন বাঁক অতিক্রম করার ক্ষেত্রে চালক বুঝতেই পারেন না যে, বিপরীত দিক থেকে গাড়ি আসছে। এরপরে গাড়ির গতিবেগ যদি স্বাভাবিক গতির (পূর্ব নির্ধারিত) চেয়ে বেশি থাকে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। সম্ভাব্য এসব দুর্ঘটনা রোধে প্রথমত বাঁকের দু’দিকে তিনটি করে ছয়টি গতিরোধক দেয়া যেতে পারে। কিন্তু রাস্তায় একই জায়গায় এত গতিরোধক দেয়া বাস্তব সম্মত নয় এবং এরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।

দ্বিতীয়ত নদী তীরবর্তী এলাকার রাস্তার নতুন করে বাঁক পরিবর্তন করাও অনেক ব্যয়বহুল ও সুবিধাজনক নয় এবং এরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তৃতীয়ত বড় বড় হাইওয়েতে বেশি গতির গাড়ি ও কম গতির গাড়ি একসঙ্গে চললে বড় গতির গাড়িগুলোর ওভারটেকিং টেনডেন্সি থাকে। এক্ষেত্রে ছোট গতির স্থানীয় গাড়িকে আমরা কি অবস্থায় রাস্তায় নামতে দেব; যেহেতু এসব গাড়ি লোকাল এরিয়ায় অনেক সেবা দিয়ে থাকে। আবার আমাদের মতো দেশে সব জেলা শহরে এ জন্য আলাদা লেন করা সম্ভব নয়। তাই বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে মিরর মেথড বা আয়না পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন: যেসব মোড়ে বাঁকটি বেশ বাঁকা সেসব সড়কে যানবাহন চালকরা একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখতে পান না এবং বিপরীত দিক হতে আগত যানবাহনের প্রকৃতি, আকার-আকৃতি ও ধরন কিছুই বুঝতে পারেন না। মাঝে মাঝে হেলপার চালকের উদ্দেশে বলে থাকেন, ডবল আসছে, সিঙ্গেল আসছে। কিন্তু এ থেকে চালক পুরোপুরি আগত গাড়ির ধরন সম্পর্কে বোধগম্য হতে পারেন না। এ ধরনের বড় বড় বাঁকে আয়না বা আয়নাজাতীয় বোর্ড রাস্তার ওপর এমনভাবে স্থাপন করা যেতে পারে যে অন্যপাশের আগত গাড়ির ধরন সম্পর্কে জানা যায়। রাস্তার বাঁকের ওপর নির্ভর করে আলোর প্রতিফলনের নিয়ম অনুযায়ী কনভে ট্রাফিক মিরর বা রিফ্লেক্টেড সিট একটা নির্দিষ্ট এঙ্গেলে স্থাপন করে সাইট ডিসট্যান্স বাড়ানো যেতে পারে। এভাবে যদি রাজধানীগামী জেলাসহ সকল বিভাগীয় শহর ও বড় বড় বাঁকে আয়নার বোর্ড স্থাপন করে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা রোধ করা যায়; তবে তা খুব বেশি ব্যয়বহুল হবে না।
এছাড়া বড় বড় বাঁকে বিশেষ করে নদী তীরবর্তী ও পাহাড়ী এলাকায় ভূমির ক্ষয়রোধ করার জন্য রাস্তার দু’পাশে অনেক গাছ লাগানো হয় (যদিও ভূমির ওপর ইট-সিমেন্টের ব্লক ব্যবহার করা উচিত)। যদি বাঁকের অভ্যন্তরীণ পার্শ্বের গাছের ডালপালা তিন-চারমাস অন্তর কর্তন করা হয়, তাহলে চালকগণ উল্টোদিক হতে আগত গাড়ির ধরন দেখতে পাবেন। চালকগণ রাস্তার অপূর্বদৃষ্টির যানবাহনকে পূর্বেই চিহ্নিত করে দুর্ঘটনার এড়াতে সক্ষম হবেন। এই পদ্ধতি কোনভাবেই ব্যয়বহুল নয় এবং সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহলের প্রচেষ্টা ও সু-নজর থাকলে অতি সহজেই তা করা সম্ভব।