দু’হাজার গ্রাহকের আমানাত হারানোর আশঙ্কা – গৌরনদীতে অবৈধ ম্যাক্সিমপ্রতিষ্ঠানে তিন কোটি টাকা সংগ্রহ

 

খোকন আহম্মেদ হীরা, গৌরনদী ॥ বরিশালের গৌরনদীতে অবৈধ পন্থায়  নিরহ সাধারন মানুষকে লোভনীয় মুনাফার ফাঁদে ফেলে একটি প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ম্যাক্সিম নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিয়ে তার অন্তরালে এলাকায় অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ভূয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে জাল নাগরিক সনদপত্র জমা দিয়ে গৌরনদী উপজেলা সমবায় অফিস থেকে নিবন্ধন নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রতিষ্ঠানে আমানাতকারী প্রায় দু’হাজার গ্রাহক এখন আমানাত হারানোর আশঙ্কায় ভুগছেন। উপজেলা ও জেলা সমবায় দপ্তর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানটিকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে বৈধ কাগজপত্র জমাদেয়ার নির্দেশ দিলেও তা অমান্য করে নির্বিগ্নে প্রতারনা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সরেজমিনে স্থানীয় জনসাধারন, প্রতারিত গ্রাহক, শাখা ব্যবস্থাপক ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জনৈক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে চেয়ারম্যান, গাজী মফিজুল হককে ভাইসচেয়ারম্যান, মুহাঃ হাবিবুর রহমানকে সাধারন সম্পাদক করে মোঃ অলিউর রহমান, শেখ আবদুল্লাহ আল মেহেদী, এম আমজাদ খানসহ ২০ জনের নাম উল্লেখসহ ম্যক্সিম আদর্শ বহুমূখী সমবায় সমিতি লিঃ হিসেবে ২০১১ সনের ২০ ফেব্র“য়ারি প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধনভূক্ত হয়।

গৌরনদী উপজেলা সমবায় অফিস সূত্রে জানা গেছে, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবুর রহমান, পিতা মিয়া মোঃ আঃ মালেক, গ্রাম কমলেশ্বর, উপজেলা বোয়ালমারি, জেলা ফরিদপুরসহ পরিচালনা কমিটির ৬ জনের বাড়ি বোয়ালমারি ফরিদপুরে হলেও তারা কাগজপত্রে গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কালনা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে নাম ঠিকানা ব্যবহার করেন। কিন্তু তারা আদৌ গৌরনদীর বাসিন্দা নন। যা পরবর্তীতে তদন্তে ধরা পরে।  

নলচিড়া ইউনিয়নরে চেয়ারম্যান গোলাম হাফিজ মৃধা তার ইউনিয়নের বাসিন্দা হিসেবে ভূয়া নাম ঠিকানা ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। অভিযোগের ব্যাপারে হাবিবুর রহমার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য এটা করা হয়েছে।

নিবন্ধন নেয়ার পরে গৌরনদী বন্দরের ইটালী মার্কেটের দোতালায় বিশাল ও সুসজ্জিত অফিস নিয়ে ম্যক্সিম ফাইনান্স এন্ড কমার্স এমসিএস লিঃ সোসাইটি গৌরনদী নামে আমানত গ্রহন কার্যক্রম শুরু করা হয়। ম্যক্সিম কো-অপারেটিভ সোসাইটির স্থানীয় ব্যবস্থাপক সেকেন্দার হোসেন জানান, এফডিআর, এম আই এস, মাসিক আমানত. স্থায়ী আমানত, পেনশন স্কীমসহ ১৯ টি প্রকল্পে আমানাত গ্রহন করা হয়। তবে মাসিক মুনাফা, (প্রতিলাখে মাসে ২ হাজার) চার বছরে দ্বিগুন ও ৭ বছরে তিনগুন এফডিআর প্রকল্পে আমানাতকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।  গ্রাহক মোঃ নজরুল ইসলাম, ফাতেমা বেগম, জাহাঙ্গীর আলমসহ অনেকেই জানান, লোভনীয় মুনাফার ফাঁদে তারা আমানাত রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক খান বলেন, প্রতি লাখে মাসিক মুনাফা দু’হাজার  টাকা। এই প্রলোভনে পরে আমি অবসর নেয়ার পর প্রাপ্ত টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা আমানাত রেখেছি। পরবর্তীতে তাদের জাল জালিয়াতি প্রকাশ পাওয়ার পর আমি টাকা ফেরত চাইলে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে নানা টালবাহানা শুরু করা হয়।

দিশেহারা আমানাতকারীরা মোঃ শামছুল হক খান, আলমগীর হোসেন, দেলোয়ার হোসেনসহ ২৫ জন গ্রাহকেরা উপায়অন্তুর না পেয়ে গৌরনদী উপজেলা সমবায় অফিসে ম্যাক্সিম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে উল্লেখ্য করা হয়েছে, একটি প্রতারক চক্র জাল জালিয়াতির মাধ্যমে “ম্যক্সিম আদর্শ বহুমূখী সমবায় সমিতি লিঃ” নামে নিবন্ধন নিয়ে তার অন্তরালে সাধারন মানুষের সাথে প্রতারনা করে সংগ্রহ করেছে কোটি কোটি টাকা। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা জনৈক মোঃ হানিফ বলেন, অধিক লাভের কথা শুনে আমি ওই প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রেখে এখন মহাবিপদে পরেছি।

গৌরনদী উপজেলা সমবায় অফিসার মোঃ খোরশেদ আলম জানান, সমবায় সমিতি বিধিমালা ৮৭ অনুযায়ী “ম্যক্সিম আদর্শ বহুমূখী সমবায় সমিতি লিঃ” সদস্যদের মাঝে ঋণ দিতে পারবে আর শেয়ার সঞ্চয় জমা নিতে পারবে কিন্তু আমানাত গ্রহন কার্যক্রম করতে পারবে না। তিনি আরো জানান, সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ এর ১২ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন শাখা খুলতে হলে নিবন্ধকের পূর্বানুমোদন নিতে হয় কিন্তু ম্যাক্সিম কোন অনুমোদন না নিয়ে আগৈলঝাড়া, পিরোজপুর, কুয়াকাটা, ঝালকাঠীসহ বিভিন্ন এলাকায় ১২টি শাখা খুলছে যা সম্পূর্ণ অবৈধ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ম্যাক্সিমের জনৈক কর্মকর্তা জানান, বেকারত্বের কারনে তিনি এখানে চাকুরী গ্রহন করেন। স্থানীয় প্রায় ২৫/৩০ জন আমানতকারীর কাছ থেকে নিয়ে তিনি প্রায় অর্ধ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় দু’হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

বরিশাল যুগ্ম নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে গত ২ মে ও গৌরনদী উপজেলা সমবায় দপ্তর গত ১০ মে পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তাদের জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি, বৈধ কাগজপত্র চাওয়া হয় এবং বিধী ও আইন পরিপন্থী লেনদেন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু সে নির্দেশ অমান্য করে ওই প্রতারক চক্রটি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ব্যবস্থাপক মোঃ সেকেন্দার আলী বলেন, দু’হাজার নয়; এক হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আড়াই কোটি টাকা আমানাত সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতারনা ও জাল জালিয়াতি সম্পর্কে তিনি বলেন, কাগজপত্রে সমস্যা রয়েছে যা সংশোধনের চেষ্টা চলছে। অবৈধ কার্যক্রমের অভিযোগ অস্বীকার করেন চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। বরিশাল জেলা সমবায় অফিসার মোঃ আবুল বাশার বলেন, ‘ম্যাক্সিমের প্রতারনার বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে তাদের আমানাত গ্রহনের কার্যক্রম অবৈধ’। এ প্রসঙ্গে বরিশালের যুগ্ম নিবন্ধক অঞ্জন কুমার সরকার বলেন, ‘অভিযোগের সত্যতা রয়েছে একাধিকবার চিঠি দিয়ে তাদের কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে তারা কোন সারা দেননি।  তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের উদ্যোগে নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।