বাবার জন্য সামারুহ মির্জার মনের আগুন!

ফজলুল বারী ॥ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মেয়ে সামারুহ মির্জা একটি কলাম লিখেছেন। ‘নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না’ শিরোনামের কলামটি একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

সামারুহ’র বাবা জেলে বন্দী। মেয়ে হিসাবে তার মনের অবস্থা কি তা অনুভব করতে পারি। পিতার জন্য সন্তান, সন্তানের জন্য পিতা যে কোনো কিছুই করতে পারেন। বাবার প্রতি দরদের শতভাগ উজাড় করে সামারুহ লিখেছেন, তার পয়ষট্টি বছর বয়সী বাবা গাড়িতে আগুন দিতে পারেন, এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? তার বাবার প্রতি  দলমত নির্বিশেষে ঠাকুরগাঁও’র সব মানুষের ভালোবাসা, যে কারও বিপদে ছুটে যাওয়া, এসব বৃত্তান্ত তিনি লিখেছেন।

তার শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন নানা বিষয়ে লিখেন, কিন্তু তার বাবা’কে জেলে আটকে রাখার বিষয়টি নিয়ে কেন লিখেন না, খেদোক্তি করে সে বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন সামারুহ। কেন আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি, তা রাজনীতিক বাবার মেয়ে হিসাবে সামারুহরও নিশ্চয় জানার কথা। কিন্তু সেসব উল্লেখ করেননি। অনেক কিছু আংশিক আংশিক বলেছেন। সামারুহর সমব্যথী হিসাবে দু:খ প্রকাশ করেই তা এখানে কিছুটা খোলাসা করে লিখতে হচ্ছে।

প্রথমেই যে কথাটা বলি তাহলো,  সামারুহ’র বাবা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানো বা সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত ছিলেন না, তার মাপের নেতারা এসবে প্রত্যক্ষ জড়িত থাকেন না, এটি সত্য। কিন্তু হরতালকে সামনে রেখে যে এসব ঘটনা ঘটে, পাবলিকের গাড়ি পুড়ে ছারখার হয়, বদর আলীর মতো ক্লান্ত-ঘুমন্ত নিরীহ-নিরপরাধ গাড়িচালক সে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, এটিওতো সত্য।

বাবা জেলে যাওয়াতে কষ্ট পাচ্ছেন সামারুহ। বদর আলীর পরিবার কী আনন্দে আছে? একটিবার তা লেখায় একটা শব্দেও এ বিষয়টি উল্লেখ করলেন না! এ ঘটনাগুলোর দায়  কার? সরকারের তো অবশ্যই। সবার জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। সরকার সে দায়িত্ব পালনে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু এসব ঘটনায় কী বিরোধীদল তথা সামারুহর বাবা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের কোনই দায়-দায়িত্ব নেই? বিরোধীদলের প্রতিটি কর্মসূচির আগে এমন গাড়ি পোড়ানো বা সম্পদের ক্ষতির ঘটনা ঘটছে। বিরোধীদল কর্মসূচি দিচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব ঘটনায় কোথাও কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো নেতার গাড়ি পুড়ছে না! পুড়ছে শুধু পাবলিকের গাড়ি! এসব ঘটনার পর সরকার-বিরোধীদল পরস্পরকে দোষারোপ করছে। বিরোধীদল বলছে সরকার ঘটনা ঘটিয়ে দায় চাপাচ্ছে বিরোধীদলের ওপর! কিন্তু রাজপথে-প্রশাসনে বিরোধীদলের এত লোকজন! কিন্তু কোনদিন ‘সরকার এমন পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করছে’র একটি ঘটনা বিরোধীদল পাবলিকের কাছে হাতেনাতে ধরিয়ে দিচ্ছেনা কেন! অন্য সময় কোনো ঘটনায় কেউ নিহত হলে সে লাশটিকে ‘আমার লাশ’ দাবিতে সরকার-বিরোধীদল প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু দূর্ভাগা বদর আলীর ক্ষেত্রে তা–ও ঘটেনি! এমন কী ঘটনার নিন্দা করে বদর আলীর পরিবারের পাশেও দাঁড়ায়নি বিরোধী দল !

সামারুহ, আপনার বাবা যে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, সে দলটিও যে এমন বর্বর-নিষ্ঠুর! আপনার লেখায় তা কোথাও তা একবারও উল্লেখ করলেন না!
 
এখন প্রশ্ন তোলা যায়, পুলিশ বা সরকারই বা কেন এ ধরনের সাজানো মামলা দেবে? বা এসব ঘটনার শেষ কোথায়? গাড়ি পুড়ছে-পুড়েছে, জীবন্ত মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়েছে! রাজনীতির নামে এ ধরনের দুর্বৃত্তপনার শেষ তো হওয়া চাই। আমাদের দেশে বিরোধীদলের কর্মসূচির আগে কোনো কিছুতে আগুন দিয়ে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির রেওয়াজ অনেকদিন ধরে চলে আসছে। এতে করে যে মিডিয়ায় ছবির সৃষ্টি, তাতেই যেন কর্মসূচি অর্ধেক সফল! এটা আগে আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকতে করেছে। এখন তা বিএনপি করছে। এখানে কারও কথাবার্তায় কোন লাইসেন্স পর্যন্ত যেন নেই! একজন সরকারি দল বা বিরোধীদল করবেন বলে কী যা খুশি তাই বলবেন? তাদের কথাবার্তা, হুমকি-ধমকির কোথায় কী প্রতিক্রিয়া হয় বা হতে পারে, তা নিয়ে তারা মোটেই ভাববেন না?

সামারুহ, আপনি চলতি আধুনিক প্রজন্মের প্রতিনিধি। সুশিক্ষিত। বাস্তববাদী হোন। বাবা বলে তিনি সবকিছুর দায়দায়িত্বের উর্ধ্বে,  এমন একতরফা ভাবনা আপনার কাছে আশা করি না। তিনি নিজে বাসে-গাড়িতে সশরীরে আগুন লাগাননি ঠিক আছে। কিন্তু আগুনতো কেউ একজন লাগিয়েছে। এসব আগুনের দায়িত্বও তিনি এড়াতে পারেন না। আজ আওয়ামী লীগ সরকার বুঝে অথবা না বুঝে হোক বিষয়টিকে নোটিশে নিয়েছে। রাজনীতির নামে এসব নৈরাজ্য বন্ধের জন্য একটা সুরাহা হওয়া দরকার। আজ যদি দায়দায়িত্ব নির্ধারণের উদ্যোগটি আপনার বাবা বলে আপনি থামাতে চান, তাহলে আগামীতে আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে গিয়ে একই কাজ করলে আমরা তাদের থামাবো কী করে, সামারুহ?

বা যদি আপনার কথামতো ধরেও নেই যে, আপনার বাবা রাজনীতি করেন বলেই এমন নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন, তাহলেও কিন্তু ওপরে ছোঁড়া থু থু নিজের গায়ের ওপরেই এসে পড়ে! শামসুন্নাহার হলের ঘটনা মনে আছে না? অথবা মতিয়া চৌধুরীর মতো নেত্রীকে রাজপথে শুইয়ে পেটানোর ঘটনা! এসব কারা করেছে? সে সময় কী আপনার বাবা সেই বিএনপি সরকারের বিমান প্রতিমন্ত্রী ছিলেন না? তখনও কিন্তু অনাচার-নৈরাজ্যের এমন আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। অথবা মনে করুন রাষ্ট্রযন্ত্রকে লাগিয়ে সেই জজ মিয়া সাজানোর বীভৎস ঘটনাটি! তখনও কিন্তু আপনার বাবা মন্ত্রিসভায়।

হয়তো বলবেন, বিএনপি সে সব দুষ্কর্ম করবে বলে আওয়ামী লীগও তাই করবে না কী? কথা সত্য। এটা আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু একই সঙ্গে সত্য হচ্ছে আগামীতে ক্ষমতায় গেলে প্রতিপক্ষকে দেখে নেবার কাজটি আবার করবে বিএনপি। সে ঘোষণাটি প্রায়ই দিচ্ছেন আপনার বাবার নেত্রী খালেদা জিয়া। আপনার বাবাও গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তেমনই বলে এসেছেন। তাই সামনের দিনগুলো যে ভালো যাবে সে আশা আমরা কেউই করতে পারছি না। আপনি কী পারছেন, সামারুহ?
 
ঠাকুরগাঁওর বাড়ির কথা লিখেছেন সামারুহ মির্জা। সত্য ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধে না গিয়েও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় বিতর্কিত পন্থায় নাম তোলা ছাড়া ঠাকুরগাঁতে মির্জা ফখরুলের নামে তেমন বদনাম শুনিনি। কিন্তু যে বদনামটি ছিল তা চেপে গেছেন সামারুহ। এটা ভালো লাগেনি। কারণ আগেই বলেছি, নতুন আধুনিক প্রজন্মের মানুষ হিসাবে তার কাছে প্রত্যাশা হচ্ছে,  ভালোমন্দ দুটোই তিনি সটাসট বলবেন। সত্য যদি কঠিন-অপ্রিয়ও হয় তা চেপে যাওয়া চলবে না।

সামারুহ যে কথাটা লিখেননি বা এড়িয়ে গেছেন তাহলো গত বিএনপি আমলে ঠাকুরগাঁও শহরে তার দাদার বাড়ির সাদা দালানের ভবনটা স্থানীয়ভাবে ‘বাতাস ভবন’ নামে পরিচিত ছিল। ঢাকার হাওয়া ভবনের আদলে সারাদেশেই তখন এমন নানান নামের ‘ভবন’ গড়েছিল! সেই বাতাস ভবনে বসে ছড়ি ঘোরাতেন সামারুহর এক চাচা! বলা হতো বাতাস ভবনের ‘মনোরঞ্জন’ ছাড়া তখন সে জেলা শহরে সরকারি টেন্ডারের কাজ পাবার কোন ব্যবস্থা ছিলো না! সামারুহর সে চাচা মন্ত্রী-এমপি ছিলেন না। মন্ত্রী ছিলেন মির্জা ফখরুল। মন্ত্রী-ভাইয়ের নাম ভাঙ্গিয়ে সব করতেন সামারুহর চাচা। এটিও সামারুহের বলা উচিত ছিল।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এড়িয়ে গেছেন সামারুহ তার লেখায়। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নব নিযুক্ত উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন যে তার বাবার গ্রেফতার নিয়ে লিখেননি, এ নিয়ে তার খেদোক্তির জবাব এই চেপে যাওয়া তথ্যের মধ্যেই আছে। তাহলো সামারুহর দাদা তথা মির্জা ফখরুল ইসলামের বাবা “চোখা মিয়া“ ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে কী পরিশ্রমটাই না  করেছেন! সে জন্যে হয়তো সামারুহর বাবা মির্জা ফখরুলেরও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হয়ে ওঠেনি! মুক্তিযুদ্ধের সময় অবশ্য বাংলাদেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধার পিতা মুসলিম লীগার তথা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। এমন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেই তাদের ছেলেরা যুদ্ধে গেছেন। শত্রুপক্ষে থাকা অথবা সক্রিয় থাকা অনেক পিতা এমন অনেক স্বাধীনতাকামী সন্তানদের প্রাণ হাতে দিয়েছেন। ফখরুল ইসলামের যুদ্ধে না যাবার প্রকৃত কাহিনী আমরা জানি না। সামারুহ তা আমাদের অকপটে বলতে পারতেন। বলবেন কি সামারুহ ?

আজ আমরা যা জানি এবং দেখি তাহলো, দলীয় সিদ্ধান্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর! বেশি চাপে পড়লে বলেন যে, আমরাও বিচার চাই, তবে এ বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক মানের!

সামারুহ কী কখনো মুক্তিযুদ্ধ-যুদ্ধাপরাধী এসবের নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক মান বিষয়াদির ব্যাখ্যা তার বাবার কাছে  জানতে চেয়েছেন? কখনও কী জানতে চেয়েছেন, রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধী হিসাবে আপনার দাদা রাজাকার মির্জা রুহুল আমিন ওরফে চোখা মিয়ার মান ‘নিরপেক্ষ’, ‘আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন’ ছিল কীনা!

গত বিএনপি আমলে বিমান প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মির্জা ফখরুল ইসলামের নাম তোলা হয়। এ নিয়ে বিশেষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় ঠাকুরগাঁও’র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। এরপর থেকে চুপচাপ তালিকায় নামটি থাকলেও মির্জা ফখরুল আর এ দাবিটি ঈমানি জোরের সঙ্গে কখনো করেন না! সামারুহ কী কখনও তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তোলা-থাকা সত্ত্বেও তিনি এ দাবিটি আর কখনো করেন না কেন?

আর সামারুহ যাকে তার বাবার জন্য লিখতে বলছেন সেই ড. আনোয়ার হোসেন কিন্তু রণাঙ্গনে সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করা একজন মুক্তিযোদ্ধা। কোনো বিশেষ সরকারের ক্ষমতায় থাকার সুযোগে তদবির বা কায়দা করে তাকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তুলতে হয়নি। শুধু তিনি না, তার ভাই কর্নেল তাহেরসহ তাদের ভাইবোন সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এক পরিবারের সব সদস্য এভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি আছে কীনা আমার জানা নেই। এদের মধ্যে কর্নেল তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার থাকাকালে এক সম্মুখ সমরে নিজের একটি পা হারান কর্নেল তাহের। শারীরিক প্রতিবন্ধী সেই মানুষটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন, মির্জা ফখরুলের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসাবে সেই মির্জা ফখরুল ইসলাম এখন দেশের মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ পরিবারগুলোর প্রাণের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জোরালো সক্রিয় কন্ঠ! তার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ড. আনোয়ারকে লিখতে বলছেন সামারুহ!

আগেই বলেছি পিতার জন্য সন্তান, সন্তানের জন্য পিতা যে কোনো কিছুই করতে পারেন। সামারুহ তার বাবার জন্যে প্রাণের সবটুকু আকুতি দিয়ে লিখেছেন। তার বাবা একজন ভদ্রলোক মানুষ, এভাবে তার গ্রেফতারকে পছন্দ করিনি। কিন্তু মাঠের লড়াইয়েতো তিনি এখন সরাসরি বিপরীত পক্ষে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, তিনি বিপক্ষে। এ নিয়ে আগামী দিনগুলোতে মুখোমুখি আরও অনেক ঘটনা ঘটবে। কাজেই ড. আনোয়ার কেন তার বাবার জন্য লিখেননি বা লিখতে পারেননি তা কী বুঝতে পেরেছেন সামারুহ মির্জা? দু:খিত।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক