হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা পানসি নৌকা

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ নৌকায় চড়ে দূরে কোথাও যাতায়াত কিংবা নতুন বৌকে নৌকায় চড়িয়ে বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়িতে আনার সময় মাঝি-মাল্লার ভাটিয়ালি, মুর্শিদী আর মারিফতি গানে একসময় মন কেড়ে নিত। সে সময় সর্বত্রই চলাচলের একমাত্র ও অন্যতম মাধ্যম ছিল পালতোলা পানসি নৌকা। আজ কালের বিবর্তনে নদী, খাল দখল ও পানসি নৌকাভরাট হয়ে যাওয়ায় ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা সেই পানসি নৌকা। তাই আজ কালে-ভদ্রেও কোথাও দেখা যায় না চিরচেনা সেই পানসি নৌকা।

বরিশালের বিলাঞ্চল বলেখ্যাত আগৈলঝাড়া উপজেলা। এক সময়ে আগৈলঝাড়া উপজেলায় সর্বত্রই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো এ পানসি নৌকার। দিনবদলের সাথে সাথে এখন বদল হয়ে গেছে বিলাঞ্চলের জীবনমানের চিত্রও। অধিকাংশ এলাকায়ই এখন সড়ক পথে যোগাযোগের জন্য উন্নত মানের রাস্তাঘাট নির্মান হয়েছে। যে কারনে ক্রমেই ওইসব এলাকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা পানসি নৌকা। তবে এখনও নৌকাই যেখানে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম, তেমনই একটি এলাকা হচ্ছে আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত বারপাইকা গ্রাম। ওই গ্রামের দুশুমির বাজার ও পাশ্ববর্তী সাহেবেরহাট নামকস্থানে এখনো দুটি ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাট রয়েছে। এছাড়া দুশুমির বাজার দিয়ে আজো প্রতিদিন অসংখ্য পানসি নৌকায় চড়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করছেন ওইসব এলাকার শত শত মানুষ। যাদের এখনো যাতায়াতের জন্য পানসি নৌকাই একমাত্র বাহন। নৌকার মাধ্যমেই আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলার জনগণের সেতুবন্ধন আজো অব্যাহত রয়েছে। দুশুমির বাজারের এ ঘাটে সারিবাঁধা নৌকা থাকে। এখান থেকে প্রতিদিন উজিরপুর উপজেলার জল্ল¬া, কারফা, সাতলা, মশাং, বিলগাববাড়ি, হারতা, হাবিবপুর, শোলক, ধামুরা বন্দরসহ আগৈলঝাড়া উপজেলার পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় যাত্রীরা যাতায়াত করে থাকেন।

দুশুমি গ্রাম ও এর আশপাশের এলাকাসহ উজিরপুরের উপজেলার জল্ল ইউনিয়নের শতাধিক পরিবারের সদস্যরা পানসি নৌকার মাঝি হিসেবে বাবা-দাদার এ পেশাকে এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। ষাটোর্ধ্ব বয়সের মাঝি বিরাজ বল্লভ জানান, এখন আর মানুষ অধিক সময় নিয়ে নৌকায় উঠতে চায় না। ফলে বর্তমানে এ পেশায় তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি আরো জানান, ঘাটে প্রতিদিন গড়ে ৫০টি নৌকা থাকে। গত ১০ বছর পূর্বেও নৌকা চালিয়ে প্রতিদিন দু’থেকে ৩’শ টাকা আয় করা সম্ভব হলেও বর্তমানে ১’শ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই নৌকা চালিয়ে যেসব পরিবার জিবীকা নির্বাহ করত সেসব পরিবার আজ অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ফলে নৌকাজীবী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা আর্থিক সঙ্কটে অনেকেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পেশা হিসেবে শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া অনেকেই বর্ষা মৌসুমে নৌকা চালালেও শুকনো মৌসুমে অন্যপেশায় নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছেন বলেও পানসি নৌকার মাঝি বিরাজ বল্লভ উল্লেখ করেন।