‘একে ধরে আনো, তাকে সরাও’ এসবই সংসদের মূল কাজ!

ফজলুল বারী : সংসদ-বিচার বিভাগ- ভোটার নাগরিক সব যেন এখন মুখোমুখি! এ যেন ফের পাকিস্তানের আলামত বাংলাদেশে! পাকিস্তানে আজকাল প্রায় এমন পরিস্থিতি ঘটছে। আর বাংলাদেশে বিরোধীদলবিহীন সংসদে সরকারি জোটের সংসদ সদস্যরা প্রায় যে কোনো কিছুতে কথায় কথায় ক্ষেপে যাচ্ছেন!

‘একে’ ধরে আনো, ‘তাকে’ সরাও এসবই হয়ে যেন উঠেছে সংসদের মূল কাজ! দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাংসদদের চোর-ডাকাত বলেছেন, এমন একটি অসত্য মিডিয়া রিপোর্টকে কেন্দ্র করে তাকে সংসদে ডেকে নিয়ে এসে মাপ চাওয়াতে বলেছিলেন সরকারি জোটের সদস্যরা! এরপর ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী বললেন, তিনি সংসদে থাকলে এমন আলোচনা হতে দিতেন না।

দেশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি সম্পর্কে সঠিক না জেনেশুনে সংসদে এভাবে আলোচনা করা যায় না। কিন্তু সংসদে যে আলোচনাটি রেকর্ডভূক্ত হয়ে গেছে তা কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেয়ার কথা বললেন না ডেপুটি স্পিকার! তার এমন আরেকটি বক্তব্যের সূ্ত্র ধরে বলতে পারি তা কার্য বিবরণী থেকে বাদ দেয়াও হবে না।

কারণ, কিছুদিন  আগে ডেপুটি স্পিকার সংসদে বলেছিলেন, সংসদ সদস্যরা পয়েন্ট অব অর্ডারে এমন কিছু বিষয় উত্থাপন-আলোচনা করেন, যা পয়েন্ট অব অর্ডারে হয় না। এমন কিছু কার্যপ্রণালী থেকে বাদও দেয়া যায় না। তাহলে এমন আগের আরও অনেক কিছু বাদ দিতে হবে। অতএব ডেপুটি স্পিকারের বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলছি, সাংসদরা যে দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক অধ্যাপক সায়ীদকে সংসদে গালমন্দ করেছেন, তার ছাত্র শেখ ফজলুল করিম সেলিম যে তার বাড়ি-গাড়ির হিসাব নিতে, তাকে সংসদে ডেকে এনে ক্ষমা চাওয়াতে বলেছিলেন, এসব কিন্তু সংসদের রেকর্ডে থাকবে। কিন্তু অধ্যাপক সায়ীদ যে বলেছেন তার কোনো বাড়ি-গাড়ি নেই, ঢাকা শহরে দু’কক্ষের ভাড়া বাসায় থাকেন, ম্যাগসেসাই পুরস্কার না পেলে তার রক্ত পরীক্ষার টাকাও হয়তো থাকতো না, এসব রেকর্ডে উঠবে না।

কারণ, তিনি সংসদের কেউ নন। চিন্তা করে দেখুন, দেশের সম্মানিত ব্যক্তিরাও এদেশে কত অনিরাপদ এদের এই সংসদীয় ব্যবস্থায়! আবার সবশেষ জানা গেল গুরুত্বপূর্ণ (!) সাংসদরা যে অধ্যাপক সায়ীদকে মাপ চাওয়ানোর জন্য টেনেহিঁচড়ে সংসদে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, সে আইন ব্রিটেনে-ভারতে আছে, তবে তা বাংলাদেশেই নেই। যা জানেন না আমাদের আইনসভার এসব বিজ্ঞ সদস্যরাও!

সর্বশেষ সরকারি দলের সদস্যরা দেশের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে অভিশংসনের আলটিমেটাম দিয়েছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিনের বিষয়টি পার্লামেন্টে তোলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নৌকা মার্কা সদস্য রাশেদ খান মেনন! তার জোটের নেতা শিল্পমন্ত্রী একদার “সর্বহারা দিলীপ বড়ুয়া“ কি করে তিন বছরের মন্ত্রিত্বে বেআইনিভাবে পাঁচটি সরকারি প্লটের মালিক বনে গেছেন, অমুক প্রতিষ্ঠান থেকে উপঢৌকন নিয়েছেন ২৬ লাখ টাকার গাড়ি, এসব শ্রদ্ধেয় মেনন ভাই’র নজর এড়িয়ে গেলো? তার কাছে এর চেয়ে জনগুরু্ত্বপূর্ণ মনে হলো কোর্টের সঙ্গে কিভাবে সংসদ-সরকারকে লাগিয়ে দেয়া যায়!

এরপর একের পর এক আমাদের বাঘা পার্লামেন্টারিয়ানরা শুধু তিন দিনের আলটিমেটামই নয়, সর্বশেষ এপিএস’র সত্তুর লাখ টাকা কেলেংকারি ধরা পড়াকে কেন্দ্র করে রেল মন্ত্রণালয় ছাড়তে বাধ্য হওয়া দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, তারা চাইলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে এসব বিচারপতিকে অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনতে পারেন! মন্ত্রিত্ব-বঞ্চিত, ‘মন-খারাপ’ প্রিয় তোফায়েল ভাই বিচারপতিকে বিশেষণ দিলেন ‘স্যাডিস্ট’!

উল্লেখ্য, গত ২৯ মে সংসদে সড়ক ভবন স্থানান্তর সম্পর্কিত আদালতের আদেশ নিয়ে আলোচনাকালে জনগণকে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেন স্পিকার আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট! এ নিয়ে রিট মামলাটির শুনানিকালে মঙ্গলবার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কোর্টে বলেছেন, “জনগণকে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলে স্পিকার আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল অপরাধ করেছেন, স্পিকারের এই ‘অপরাধের’ জন্য তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হওয়া উচিত।”

মঙ্গলবার  আলোচনাটি শুরুর সময় সংসদ নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। আলোচনাটি শুরুর পর তিনি অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। তাই মনে হতে পারে, এই আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর সায় আছে! আবার অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে আলোচনার তিক্ত অভিজ্ঞতায় ডেপুটি স্পিকার চাইছিলেন না বিষয়টি নিয়ে তখনই আলোচনা হোক। কিন্তু সরকারি সদস্যদের চাপের মুখে তিনিও তা আর থামাতে পারেননি! অতঃপর এমন ফ্রি স্টাইল আলোচনায় সরকারি দলের সদস্যদের মনের বেদনাটিও লুকোছাপা থাকেনি! তাহলো আওয়ামী লীগ তাকে বিচারপতি করেছিল, বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাকে কনফার্ম করেনি। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসাবে কনফার্ম করেছে। সেই বিচারপতিই কিনা!! অর্থাৎ বিচারপতিরা দল থেকে কথা বলবেন! সিদ্ধান্ত দেবেন!

অথচ এই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে নিয়ে এই সরকারি দলের আহলাদের সীমা-পরিসীমাও আমরা আগে কম দেখিনি! এই সংসদের অনেক রেকর্ড খুঁজে দেখলেও সে প্রমাণ বেরুবে। সংবিধান অনুসারে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসাবে সমুন্নত-সমুজ্জ্বল রাখা, জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা, সামরিক শাসনের গোপন বিচারে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেবার বিষয়টিকে বেআইনি ঘোষণা করা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই আমরা এই বিচারপতির বেঞ্চ থেকে পেয়েছি।

দেশের জনগুরু্ত্বপূর্ণ অনেক কিছু, সর্বশেষ সরকারি রাস্তা গায়েব করে প্লট বানিয়ে মিডিয়া মালিকসহ প্রভাবশালীদের ভাগাভাগি, তৃতীয় পক্ষের নামে সামরিক পক্ষকে ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আমন্ত্রণের উৎসাহ দাতাদেরও ডেকে নিয়ে এসেছে এই কোর্ট। খালেদা জিয়ার সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার কথার ‘জোশে’ সংবিধান ডাস্টবিনে ফেলার কথা বলেছিলেন দেশের শীর্ষ ফতোয়াবাজ মুফতি ফজলুল হক আমিনী! এই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সমন্বয়ে গড়া বেঞ্চই তাকে তখন কোর্টে ডেকে এনেছিলেন। তখন এমন একটি বক্তব্যের জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হওয়া উচিত বললে বিএনপির আইনজীবীরা কোর্টে এজলাসের উদ্দেশে ‘ট্রে ছুঁড়ে মারা’সহ অনেক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন! তখন সেই দুর্বৃত্তসুলভ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার-বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সরকারি দলের নেতারা।

আর এখন তারাই তার অভিশংসন চাইছেন? যেন কোর্টের কাজ হচ্ছে শুধু তাদের পক্ষে থাকা? আগে এই কোর্টের বিরুদ্ধে ছিলেন বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা। আসিফ নজরুলের মামলায় তাদের পক্ষে যোগ দেন ড. কামাল হোসেন। সর্বশেষ যোগ দিলেন সরকারি দলের সাংসদরা! ব্র্যাভো! এর সবকিছুর যোগফল মেলালে বুঝতে হবে এই কোর্টটি আসলেই একটি নিরপেক্ষ আচরণ করছিল। কিন্তু অতঃপর সবাই মিলে যেন একাট্টা হয়েছেন, দেশে নিরপেক্ষ বলে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকবে না! সব কিছু হতে হবে স্বপক্ষীয়! স্বদলীয়!

সুরঞ্জিত সেনগু্প্ত বলেছেন, চাইলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে তারা এই বিচারপতির চাকরি নট করার ক্ষমতা আবার তাদের কাছে নিয়ে আসতে পারেন! আমাদের এই দাদা সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীর আগেও অনেক বড় বড় কথা বলেছিলেন। পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিধান রাখার কথাও তখন বলেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে গিয়ে হয়ে পড়েছিলেন বাক বাকুম পায়রা! তা সেই আমাদের দাদা এত যদি ক্ষমতাধর হয়ে থাকেন, তাহলে সেই সংশোধনীর সঙ্গে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সন্নিবেশিত করার উদ্যোগ নিলেইতো দেশ রাজনৈতিক সংকট থেকে বেঁচে যায়! সংবিধান শুধু নিজেদের স্বার্থমতো করে সংশোধন করবেন, নিজেদের স্বার্থের বিপক্ষে কিছু করবেন না, এমনটা কেন হবে!

মঙ্গলবার কোর্টে সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু আর সরকারি কৌসুলি আনিসুল হকের ভূমিকা দেখে মনে হয়েছে তারা আঁচ করতে পারছিলেন পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াচ্ছে! তাই তারা বারবার তাকে থামতে বলছিলেন।

কিন্তু বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এর মাঝে এমন একটি উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন যে তার পক্ষে সেখানে থেমে যাওয়া কঠিন ছিল! সংসদকে সাংসদরা বলেছেন, সংবিধান সংসদ ও সাংসদদের দায়মুক্তি দিয়েছে। তাই সংসদের কথাবার্তা কোর্ট টেনে নিয়ে যেতে পারে না। কোর্টের হাত অত লম্বা নয়। সংসদে বলা হয়েছে, সংবিধানে রাষ্ট্র-সংসদ-কোর্ট সবকিছুর সীমারেখা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। তাই স্পিকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার কথা বলে শপথ ভঙ্গ করেছেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক!

কিন্তু স্পিকার যে সংসদে জনগণকে কোর্টের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন, এটি তার সীমারেখা লংঘন না? এখন রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিমকোর্ট, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস কী করে তা দেখার বিষয়। অ্যাটর্নি জেনারেল সম্প্রতি ব্যর্থ বিচারপতিদের অভিশংসনের কথা বলেছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কি হবেন এর প্রথম শিকার? সুপ্রিমকোর্ট কি তাদের এই অমিততেজি সাহসী স্বাধীনচেতা বিচারপতিকে প্রটেকশন দিতে পারবে? আগামী তিন দিন এদেশের বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক