ঈষাম আরমান ॥ ঢাকার রাস্তায় যাতায়াতের জন্য বাসের চেয়ে পায়ে হাটাটাই উত্তম। আজকাল রাস্তায় যে ধরণের বিরাট আকারের জ্যাম পরে, তার কল্যাণে বাসে চড়লে গন্তব্যে পৌছুতে মাঝে মাঝে দুই থেকে তিন ডাবল সময় লেগে যায়। তার উপরে অতিরিক্ত মানুষের অমানুষিক গ্যাজাগ্যাজি তো লেগেই থাকে সবসময়। তাই পায়ের উপরে ভরসা করেই ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মূলত বাসে চড়ার উপরোক্ত সমস্যাগুলি আমার জন্যে কোন
সমস্যাই না। কিন্তু আমার খালি পকেট বাসে চড়ার অনুমতি প্রদানে ব্যর্থ। তাই বাধ্য হয়ে পায়ে হেটে যাওয়া। বাসে জ্যামহীন পথে ১০ মিনিট এবং পায়ে হেটে গেলে বড়জোড় ৪০-৫০ মিনিটের পথ। আমার মতো সময় নিরপেক্ষ এবং চালচুলোহীন মানুষের জন্য এই পথ পায়ে হেটে কোন ব্যাপারই না। তার উপর এই কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতাগুলিও আমার সাথেই ছিল।
প্রায় ৫০ মিনিটের মতো হাটার পরে একটি ধূসর রংয়ের মস্ত বড় বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম। পায়ের হাটু গুলি টনটনিয়ে ব্যথা করছিল। হয়তো তারা আমাকে চিত্কার করে বলছিল “আর কতো অত্যাচার করবি?এবার মাফ কর ব্যাটা!”
আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম বাড়ির গেইটের দিকে। গেইটে টোকা মারার আগেই দারোয়ান প্রকান্ড গেইটের ছোট দরজাটা খুলে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার। এইটা একটা নিয়মিত ঘটনা। যতোবারই আমি এই বাড়িতে এসেছি ততোবারই সে এইরকম একটা অদ্ভুত চাহনি প্রদর্শন করে আমাকে। গৃহকর্তা মাঝে মাঝে অসময়ে বাড়িতে ফকির দেখলে এমন একটা চাহনির প্রদর্শন ঘটায়। মনে মনে ভাবলাম, আমিই তো বড় ফকির। ফকিরদের থালাতে
তবুও তো অনেকগুলি পয়সা এবং পুটলি ভর্তি চাল থাকে। কিন্তু আমারতো তাও নেই। থালা নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করবো কিনা মনে মনে ভাবতে লাগলাম। হঠাত্ দারোয়ানের মোটা কর্কশ কন্ঠের শব্দে বাস্তবে ফিরে আসলাম।
-আরে ভাইজান যে। দাড়ায় আছেন ক্যান! ভেতরে আসেন…
-কি মফিজ মিয়া..আছো কেমন?
-এইতো ভাইজান। আপনেগো দোয়ায় ভালোই আছি।
মনে মনে বললাম, “নিজের জন্যেই দোয়া করার সময় পাইনা,আবার তোমার জন্য করবো দোয়া !”
আর কথা না বাড়িয়ে বড় বড় পায়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। দোতলায় উঠে কলিংবেলে চাপ দিলাম। ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ শব্দে কলিংবেল বেজে উঠলো।
ভাবলাম, ‘বড় লোকের বড় বড় কারবার। এই কলিংবেলের শব্দ যদি আমাদের দেশী কুকুরগুলাকে শোনানো যায় তাহলে পরের ৬ মাস শিওর ঐগুলা ডাক দেওয়া ভুলে যাবে।
১০ সেকেন্ড অপেক্ষার পরেই ঘরের দরজা খুললো। চোখের সামনে বড় আপা দাড়িয়ে আছেন। তিনি ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কিছুক্ষণ পড়েই বললেন,
-ঈষাম তুই ?? এতো দিন পরে ??
আমি কিছু না বলেই আপার পায়ে ধরে তিনবার সালাম করলাম।
-আরে আরে। কি করছিস?
-দেখছো না যে সালাম করছি।
-তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কোন খুশিতে? চাকরি বাকরি পেয়েছিস নাকি?
-আরে ধুর!! তুমি আমার বড়। মুরুব্বি মানুষ। তাই দোয়া নিলাম আরকি।
সাথে সাথে আপার ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেলো। ঠিক ঠাঠানো রোদের পরে আকাশে হঠাত্ ঘন কালো মেঘের আগমনের মত…
-তুই আর মানুষ হবি না…
-কি বলো আপা! আমাকে কি গরু ছাগলের মতো লাগছে নাকি!
বলেই পেছন ফিরে তাকালাম..
-কই! লেজ তো নাই! তার মানে এখনো মানুষই আছি। আসলে তোমার একটা চশমা লাগানো দরকার। কবে আবার দুলাভাইকে দেখে বলবা যে ‘তোমাকে তো গাধার মতো লাগছে’
তারপরে তোমার সুখের সংসারে ভাঙ্গন ধরবে।
-ধুর চুপ কর তো..আয় ভেতরে আয়…
সুবোধ বালকের মতো আপার পিছে পিছে তাদের বিশাল ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলাম। আপা বললো ‘তুই বোস,আমি তোর জন্যে নাস্তার ব্যবস্থা করি।’ এই বলেই আপা চলে গেলো…
আমি বসে বসে বাসার সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে লাগলাম।মিনিট পাঁচেক পরেই হঠাত্ কি যেন একটা আমার কোলে এসে ঝাপিয়ে পড়লো। তাকাতেই দেখলাম যে আপার একমাত্র ৪ বছরের ছেলে অর্ক।
-মামা মামা,এতো দিন আসো নাই কেন? আমি তোমার উপর অনেক রাগ করেছি। কাট্টি ! কাট্টি !
-তোর জন্য চকো চকো কেনার টাকা যোগার করতেই তো এতো দিন লেগে গেলো..তাই একটু দেরী হয়ে গেলো! রাগ করেনা বাবু..
এই বলে দুইটা চকো চকো তার দুই হাতে গুজে দিলাম…
সাথে সাথেই অর্কের সব ধরণের রাগ নিমিষেই উধাও। তার চোখে মুখে এখন প্রাপ্তির নির্মল আনন্দের হাসি। প্রথম এভারেস্ট জয়ী এভারেস্ট জয়ের পরে এমন হাসি দিয়েছিল কিনা সন্দেহ…
অর্ক এখন আমার কোলে বসে বসে চকোচকো খাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাস করলাম,
-অর্ক, তোমার নদী ফুপ্পি কোথায়? দেখছি না যে !
-ফুপ্পি তো ভার্সিটিতে !
-ও আচ্ছা !
অর্ক আবার চকোচকোতে মনোনিবেশ করলো আর আমি স্মৃতি চারণ করলাম ৬ বছর পূর্বে আপার বিয়ের দিনটাতে।
ঐ সময় আমি পড়তাম ভার্সিটি ফাইনাল ইয়ারে এবং নদী ছিল ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী..দুলাভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন হিসেবে তার উপর আমার নজরটা একটু বেশীই ছিল। সুযোগ পেলেই তাকে গিয়ে রাগাতাম এবং মেয়েটি গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো ঠিক পিচ্চি বাচ্চাদের মতো। এভাবে খুনশুটির এক পর্যায়ে কখন যে তার প্রেমে পরে গেলাম নিজেই বুঝে উঠতে পারলাম না।
এরপরে কয়েকটি ঘটনা খুব তাড়াতাড়িই ঘটে যায়…প্রেম নিবেদন,প্রেম প্রস্তাব গ্রহণ,সারা রাত ফোনালাপ,চুপিসারে দেখা করা,চুটিয়ে প্রেম করা ইত্যাদি ইত্যাদি…
কিন্তু পাশ করার পরেও যখন কপালে কোন চাকরি জুটলো না তখনই ঘটলো বিপত্তি। আমার এবং নদীর মাঝে দূরত্ব আমার পোড়া কপালের দূর্দশার মতো সমানুপাতিক হারে বেড়েই চললো। তারপর একদিন আপা এবং দুলাভাই আমাদের ব্যপারে সব জেনে যায়। দুলাভাই নদীর উপর আলটিমেটাম জারি করে যে আমার সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। সেই দিনের পর থেকে আপার বাসায় আসাটাও বন্ধ হয়ে যায় আমার।
হঠাত্ আপার ডাকে তন্দ্রা ভাঙ্গে।
“এই ঈষাম,ডাইনিং এ তোর নাস্তা দেয়া হয়েছে। খেতে আয়..”
অর্ককে পাশের সোফার বসিয়ে দিয়ে গেলাম ডাইয়িং রুমে। টেবিলের উপর খাবারের পশরা দেখে রীতি মতো অবাক না হয়ে পারলাম না..পরোটা,ডিম,গরুর কলিজা ভূণা,গরুর মাংস ভূণা, ভাজি আরো দুই তিনটা আইটেম…
-আপা,গণভোজের দাওয়াত নাকি আজ তোমাদের বাসায় ?
-চুপ কর ! খেতে বোস..
আমি কথা না বাড়িয়ে একটা চেয়ার টান দিয়ে বসে পড়লাম…মনে মনে দুঃখ করতে লাগলাম,
‘ইস !এক সপ্তাহের খাবার যদি একসাথে খাওয়া যেত!’
পরোটার ভেতরে গরুর মাংসের টুকরা ঢুকিয়ে মুখে পুরতে যাবো ঠিক এই সময়ে দুলাভাই ভেতরের রুম থেকে বেড় হয়ে আসলেন পত্রিকা হাতে..আমি ঐ অবস্থাতেই বললাম,
‘কেমন আছেন দুলাভাই?’
তিনি কোন জবাব না দিয়েই আবার ভেতরে চলে গেলেন। এই মানুষটা প্রথম প্রথম আমাকে ভালোই আদর করতো..কিন্তু নদীর সাথে আমার ভালবাসার ঘটনা জানার পরে আর একটা কথাও বলেন নি আমার সাথে।
অন্য কেউ হলে হয়তো তার এই আচরণে অসম্মানবোধ অনুভব করতো এবং তখনি বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যেত। কিন্তু আমি মানুষটা হয়তো একটু বেশীই নির্লজ্জ। তাই সব ভুলে আবার খাওয়াতে মনোনিবেশ করলাম…
এইবার আপা এসে বসলো ঠিক আমার সামনের চেয়ারটায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকেই তিনি বলা শুরু করলেন,
-তুই কোন কাজ করিস না কেন?
-কাজ তো করছিই ! দেখতে পাচ্ছো না ?
-কি কাজ করিস ?
-এইযে খাচ্ছি ! বিজ্ঞানের ভাষায় কিন্তু এইটাও একটা কাজ…
-(রাগের স্বরে) চুপ কর ! সব সময় শুধুই ফাজলামো..এবার লাইফটাকে একটু সিরিয়াসলি নে !
-আচ্ছা নিবো !
আমি খাওয়া চালিয়েই যাচ্ছি !অপরদিকে আরো কয়েকটা উপদেশ দিয়ে আপা আবারো চুপ। আমার এই আপাটা আমাকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশী ভালবাসেন। বাবা-মা মারা যাবার পরে তিনিই আমাকে আগলে রেখেছিলেন আপন ছেলের মতো করে। তিল তিল করে অনেক কষ্ট সহ্য করে আমাকে বড় করেছেন। পারিনি আমি তাকে তার অকৃত্রিম ভালবাসার উপযুক্ত সম্মান দিতে। তবুও তিনি আমাকে ভালবাসেন। প্রকৃত ভালবাসা হয়তো এমনই। এতে থাকেনা
কোন প্রতিদানের আশা…
আপা আবার বললেন,
‘কয়েক সপ্তাহ পরেই নদীর বিয়ে। বর পক্ষ এসে তাকে পছন্দ করে গেছে গতকাল’
-আপা আমি উঠি..
-এখনই চলে যাবি?
-হুম..
-আচ্ছা একটু দাড়া..
এই বলে আপা ভেতরে চলে গেলেন। ফিরে এসেই আমার হাতে চারটা পাঁচশ টাকার নোট গুজে দিলেন। এই মুহূর্তে আমার টাকার যে কি পরিমাণ প্রয়োজন তা আপা কিভাবে বুঝলেন সেটা আমার জানা নেই। হয়তো একেই বলে হৃদয়ের টান।
সাথে সাথেই বের হয়ে আসলাম আপার বাসা থেকে..আসার সময় অর্ক অনেক কাঁদছিল। আমার শার্টের কোণা ধরে ঝুলে ছিল ছেলেটা। তার মায়ের মত এই ছেলেটাও কেন জানি আমাকে অনেক বেশী ভালবাসে। যে ভালবাসা নিস্পাপ।হাজার কোটি টাকার বিনিময়েও কোথাও পাওয়া যায়না এই ভালবাসা….
এক মাসের মতো হয়ে গেলো শেষবার আপার বাসায় গিয়েছিলাম। রুমে শুয়ে শুয়ে নদীর কথা ভাবছিলাম। আজ সকালে আপা ফোন দিয়ে বলেছে যে কাল নদীর বিয়ে। তার হবু বর আমেরিকা প্রবাসী। বিয়ের পরেই বউ নিয়ে চলে যাবে সেখানে। নদীকে বিয়ে শাড়িতে কেমন লাগবে তা চিন্তা করতে করতেই হঠাত্ পেটে তীব্র ক্ষিদা অনুভব করলাম। ঘড়িতে দেখলাম রাত ১১.৩১ মি.। ঘরের দরজায় তালা মেরে বেড়িয়ে পরলাম খাওয়ার উদ্দেশ্যে।
অনেক্ষণ গন্তব্যহীনভাবে হাটতে হাটতে চলে আসলাম ধানমন্ডি লেকের পাড়ে।
চারিদিকে কেউ নেই। রাস্তার সোডিয়াম বাতি গুলির হলুদ আবছা আলো পরিবেশটাতে একটা ভূতুরে ভাব ফুটিয়ে তোলেছে। লেকের পাড়ে একটা সিড়িতে গিয়ে বসলাম আমি। আকাশে আজ ভরা জ্যোছনা। জ্যোছনার আলো লেকে পানিতে পরে একধরণের রূপালী প্রলেপ সৃষ্টি করেছে। এই প্রলেপ প্রতিফলিত হচ্ছে চারিদিকের গাছ পালা এবং এদের লতাপাতায়।
প্রকৃতির এই অপরূপ খেলায় কিছুক্ষণের জন্য পেটের ক্ষিদাটাকে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবার তা মাথা চারা দিয়ে উঠেছে আবার। কতোক্ষণ বসে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য খাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা পেটের উপর কোন প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করতে পারলো না।
তাই আর কোন পথ না পেয়ে উঠে পরলাম নৈশ হোটেলের খোজে উদরপূর্তির উদ্দেশ্যে…….