Menu Close

স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা নারীরা খুঁজে পেয়েছে বেঁচে থাকার পথ – হস্ত শিল্পের মাধ্যমে দেশে আমদানি হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ বাল্য বিয়ে ও যৌতুকের কারনে অল্প বয়সে স্বামী পরিত্যক্তার খাতায় নাম লেখাতে হয়েছে মাসুদা খানম (১৮), শান্তনা রানী (১৭), রানু আক্তার (২৫) সহ শতাধিক নারীকে। এছাড়া বিধবা, দুঃস্থ্য ও অসহায় অপর শতাধিক নারীরা অভাবের সংসারে যখন চোখে শর্শের ফুল দেখছেন, ঠিক তখনই ওইসব নারীদের পার্শ্বে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি প্রকল্পের দু’শতাধিক নারীরা জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে আজ বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পেয়েছেন।

কঠোর পরিশ্রমের কারনে ওইসব নারীরা প্রত্যেকেই আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। বাবার অভাবের সংসারে বাল্য বিয়ের পর স্বামী ও শশুড় বাড়ির লোকজনের দাবিকৃত যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় অধিকাংশ নারীকে অল্প বয়সে স্বামী পরিত্যক্তার খাতায় নাম লেখাতে হয়েছে। একদিকে বাবার অভাবের সংসার, অন্যদিকে স্বামী পরিত্যক্তা হিসেবে যখন ওইসব নারীরা সমাজের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, ঠিক তখনই তাদের পার্শ্বে এসে দাঁড়িয়েছে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বে-সরকারি সংস্থা মেনোনাইট সেন্টাল কমিটি (এমসিসি)। ওই প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে শন সুতা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে (হস্তশিল্পের মাধ্যমে) একদিকে যেমন স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীরা খুঁজে পেয়েছেন বেঁচে থাকার পথ, তেমনি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি ওইসব নারীদের সু-নৈপূর্ণ হস্তশিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে আয় করছেন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। ব্যতিক্রমধর্মী এ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে বরিশালের হিন্দু অধ্যুষিত বলেখ্যাত আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত বাগধা গ্রামে। ওই শিল্প প্রতিষ্ঠানে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য, জেন্ডার, কোয়ালিটি, এ্যাওয়ারনেস, পরিবেশ, চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সামাজিক মর্যাদার মাধ্যমে ওইসব নারীদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে যাওয়া বে-সরকারি সংস্থা মেনোনাইট সেন্টাল কমিটি (এমসিসি) প্রকল্পের আওতাভূক্ত বাগধা এন্টারপ্রাইজ নামের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার কালীপদ অধিকারী জানান, “সঠিক পারিশ্রমিক-সঠিক ব্যবসা” এ মূল সুরকে ধারন করে দুঃস্থ অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫৬ টি দেশে বে-সরকারি এ সংস্থা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। তাদের কর্মসূচীর আওতায় দেশের হাজার-হাজার দুঃস্থ, অসহায় নারীরা আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। বাংলাদেশে এমসিসির ৯ টি শাখায় অসংখ্য দুঃস্থ নারীরা তাদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আজ আত্মমর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পেয়েছেন। একইসাথে ওই সংস্থাটি দুঃস্থ নারীদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল হিসেবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। যা দেশের জন্য রিতিমতো বয়ে এনেছে এক বিরল সম্মান। আগৈলঝাড়ায় এমসিসির ৪ টি প্রজেক্টে দুঃস্থ নারীদের নিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। প্রকল্পগুলো হলো-বাগধা এন্টারপ্রাইজ, জোবারপার এন্টারপ্রাইজ, কেয়া পাম হ্যান্ডিক্রাফ্টস ও বিবর্তন। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক নারীরা উৎপাদনের ওপর প্রতিমাসে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। এছাড়াও বছরের উৎপাদনের লভাংশ্য থেকে একটি অংশ এসব নারীদের মাঝে সমবন্টন করে দেয়া হয়। যা দিয়ে প্রতিটি নারীরাই আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন।

উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল বাগধা গ্রামে ১৯৮৪ সনে বাগধা এন্টারপ্রাইজ নামের প্রকল্পটি শুরু করা হয়। ২৫ শতক জমির ওপর ১২০ জন স্থায়ীকর্মী ও ৫ জন স্টাফ নিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলেও বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ও অনিয়মিত প্রায় দু’শতাধিক বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীরা কাজ করছেন। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপকরণ হচ্ছে শণ সুতা। শণ ও সুতার মাধ্যমে কাজ করে কুটির শিল্পটি স্বল্প সময়ে দেশে তথা বর্হিবিশ্বে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন। এখানকার উৎপাদিত সামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সুতলির ব্যাগ, পার্টস, সাইড ব্যাগ, শপিং ব্যাগ, ব্যাচলেট, পুতুলসহ ৩৭১ টি সৌখিন সামগ্রী। প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার কালিপদ অধিকারী আরো জানান, চলতি বছর উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় এক কোটি টাকার। উৎপাদিত পন্যের বেশীর ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমুহে রপ্তানি করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে দারিদ্রতা জয় করে ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন বাগধা গ্রামের শেফালী হালদারসহ অসংখ্য নারীরা। এককালে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো সেই শেফালী হালদারের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল হিসেবে তার বড়পুত্র বর্তমানে ঢাকার বারডেম হাসপাতালের শিশু মেডিসিন বিশেষষ্ণ ডাঃ অমৃত লাল হালদার।

এছাড়াও আগৈলঝাড়ায় এমসিসির চারটি প্রজেক্ট যথাক্রমে বাগধা এন্টারপ্রাইজ, জোবারপার এন্টারপ্রাইজ, কেয়া পাম হ্যান্ডিক্রাফ্টস ও বিবর্তনে প্রতিদিন বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও অসহায় দুঃস্থ শত শত নারীরা হস্তশিল্পের মাধ্যমে আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন।

Photo on- http://fb.com/GournadiWeb