শীতের শেষে প্রকৃতিতে তখন বসন্তের মেলা। অক্টোবরের তেমনি এক সকালে পেরুর রাজধানী লিমার হোরহে চাভেস এয়রাপোর্ট হতে রওয়ানা হয়ে গেলাম প্রতিবেশী দেশ কলোম্বিয়ার উদ্দেশ্যে।
লিমা হতে বগোটা ৩ঘন্টার ফ্লাইট। এভিয়েন্কা এয়ার লাইন্সের লক্কর ঝক্কর মার্কা বিমানটা ঘুড্ডির মত গোত্তা খেতে খেতে উড়ে গেল এন্ডিসের উপর দিয়ে। বগোটার এল ডোরাডো এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার সময় মাথার উপর লাগেজ কেবিন হতে দু’একটা লাগেজ ছিটকে পরল। ভয়বহ আতংকের সৃষ্টি হল কেবিনে। এ সবের সাথে আমার পরিচিতি বহু দিনের, তাই খুব একটা বিচলিত হলামনা অপ্রত্যাশিত টার্বুলেন্সে। এক নাগাড়ে ১৫ ঘন্টা এয়ার ট্রাভেলের অভিজ্ঞতাও আছে ঝুলিতে, তাই তিন ঘন্টার জার্নি শরীরের উপর তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে মনে হলনা। লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট হতে বের হতে আরও আধা ঘন্টা লেগে গেল। লিমার সাথে বগোটার পার্থক্যটা বিমান হতে বের হলেই চোখে পরতে বাধ্য। যতবার লিমা গেছি একবারের জন্যেও সূর্য্যের দেখা পাইনি শহরটার আকাশে। কুয়াশার নীরবচ্ছিন্ন রাজত্ব। এন্ডিসের চূঁড়ায় খন্ড খন্ড অলস মেঘ প্রকৃতিতে অন্যরকম প্যানোরমা সৃষ্টি করলেও দিনের পর দিন একই দৃশ্য এক ধরনের ডিপ্রেশন তৈরী করে ফেলে, সূর্য্যের আলোর জন্যে এক সময় মনটা ছটফট শুরু করে দেয়। বগোটায় ঠিক উলটো, বছর জুড়ে রৌদ্রের একচেটিয়া রাজত্ব। গায়রে জ্যাকেটটাও খুলতে হল গরমের কারণে।
এল ডোরাডো এয়ারপোর্টটা একেবারেই সাধারণ মানের এয়ারপোর্ট, দূর হতে একচালা টিনের ঘর বলে ভূল হতে পারে। শুধু এয়রাপোর্টেই নয় বগোটা শহর জুড়েই সবুজের সমারোহ, যা দেশটাকে প্রতিবেশী পেরু হতে আলাদা করে দেয়। লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে যাওয়ার মুখেই পথরোধ করে দাঁড়াল এয়ারপোর্ট সিকিউরিইটি, চেক করবে আমাদের। ভূলেই গিয়েছিলাম কলম্বিয়া নামের দেশটার সাথে ড্রাগ শব্দটার নিবিড় সম্পর্ক। কোন বাক্য বিনিময় হলনা দশ মিনিট স্থায়ী ঝড়ো তল্লাশীর সময়। ওদের লক্ষ্য ছিল ড্রাগ, ট্রেইনড্ কুকুর সহ বেশ কিছু নতুন ডিভাইস দেখলাম এ কাজে ব্যবহার করতে। ৯টা বেজে গেল ঝামেলা চুকিয়ে এয়ারপোর্ট হতে বেরুতে বেরুতে।
সান্তা মার্তার কানেকটিং ফ্লাইট দুপুর ২টায়, ৫ঘন্টা এয়ারপোর্টে বসে কি করব ভাবনায় পরে গেলাম। অনেকগুলো অপশন বিবেচনা শেষে সিদ্বান্ত নিলাম এয়ারপোর্ট লকারে লাগেজগুলো জমা রেখে শহর দেখতে যাব। এয়ারপোর্ট হতে শহরের দূরত্ব খুব হলে ৬/৭ কিলোমিটার । লোকাল বাস সার্ভিস খুবই উন্নত মনে হল। সীমিত যাত্রী ও সময় জ্ঞানের কারণে লোকাল ট্রানস্পোর্টের সার্বজনীন ব্যবহার চোখে পরার মত। সিদ্বান্ত নিলাম আমরাও লোকাল বাস ধরে শহরে যাব। এয়ারপোর্ট কাউন্টারে ডলার ভাংগাতে গিয়ে একেবারেই ভড়কে গেলাম, লম্বা একটা ফর্ম পূরন করতে হবে। ডলার ভাংগাতে পাসপোর্টের দরকার হয় ব্যাপারটা দক্ষিন আমেরিকার অন্যকোন দেশে দেখেছি কিনা মনে করতে পারলামনা। খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক প্রশ্ন করল, উত্তর দিলে হল অনেকটা আসামীর কায়দায়। মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলাম। বডি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে তা প্রকাশ করতে চাইতেই ক্যাশিয়ার জানাল কলম্বিয়ায় ডলার পরিবর্তন খুব একটা সহজ কাজ নয়, এর সাথে ড্রাগ সংশ্লিষ্ট বহুবিধ সমস্যা জড়িত। ১০০ ইউএস ডলার ভাংগাতেই মনে হল কলোম্বিয়ান পেসোর মিলিয়নিওর হয়ে গেছি আমি।
পশ্চিমা দুনিয়ার যে কোন বাসের মত ঢুকার মুখে ভাড়া পরিশোধ করে বসে পরলাম ঝক ঝকে বাসটায়। আমার গিন্নীর মাতৃভাষা স্প্যনিশ, তাই কোন ষ্টপেজে নামলে শহর সেন্টারে নামা হবে তা বের করতে অসূবিধা হলনা। অফিস আওয়ার, তাই চারদিকে মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা। এসি১-২৬(অটোপিস্তা এল ডোরাডো) বুলোভার্ড ধরে শহরের কেন্দ্রস্থলে নামতেই মানুষের জোয়াড়ে ভেসে যাওয়ার মত অবস্থা হল আমাদের। চারদিকে মানুষ আর মানুষ, হাটছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। যে জিনিষটা প্রথমে চোখে পরতে বাধ্য তা হল, ধারালো ছুড়ির মত কিশোরী হতে ৬০ বছর বয়সী মহিলাদের শরীর। মনে হল ঈশ্বর নিজ হাতেই বোধহয় কলম্বিয়ান সুন্দরীদের তৈরী করছেন। দীর্ঘশ্বাষ ফেলা ছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা খোলা ছিলনা। আমার গিন্নী নিজেও বোধহয় মুগ্ব হল ঈশ্বরের এমন শৈল্পিক সৃষ্টীতে। আমার দিকে তাকিয়ে মনের অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করল, মৃদু হাসিতে ছিল নো অবজেকশনের সিগন্যাল।
আমরা যাব এসি৬৮’র (দ্যাল্ কংগ্রেসো ইউকারিসতিকো) উপর সাইমন বলিভার পার্কে। নিশানা ঠিক না করেই এলোমেলো হাটতে শুরু করলাম কলোম্বিয়ার রাজধানী বগোটার খোলা আকাশের নীচে।
এই একটা বাস্তবতা চোখে পরলে ভীষন হিংসে হয়; লাতিনোদের লাইফষ্টাইল! ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগ, অনাচার, অবিচার, ড্রাগ, সবই আছে পৃথিবীর এ প্রান্তে, কিন্তু পাশাপাশি জীবনকে উপভোগ করার আছে অন্তহীন ইচ্ছা, আছে প্রতিশ্রুতি। এ ধরনের ইচ্ছার বিরুদ্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না নিজ নিজ রাষ্ট্র, ধর্ম অথবা যুগ যুগ ধরে বেড়ে উঠা সাংস্কৃতি। রাষ্ট্র ও ধর্মের সাথে বিবর্তনশীল সাংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণেই হয়ত লাতিনোদের সামাজিক জীবন পৃথিবীর অন্য যে কোন জীবনের চাইতে বেশী জীবন্ত এবং উপভোগ্য। সামরিক শাষন আর দারিদ্রের ভারে নূয্য বলিভিয়ানদেরও যেমন দেখা যায় কঠিন একটা দিনের শেষে ক্লাব, রেস্তোরা, অথবা ডিস্কোতে ছুটে যেতে, তেমনি ইকুয়েডরীয় কলা বাগানের গরীব শ্রমিকরাও দিনান্তে বেরিয়ে পরে উপভোগের সন্ধানে। কলোম্বিয়ায় এর প্রভাব আরও প্রকট, আরও বেশী লক্ষ্যনীয়। সকাল ১০টার মধ্যেই বগোটার রাস্তাঘাট পরিপূর্ণ হয়ে গেল কর্মমূখী মানুষ আর ট্যুরিষ্টদের পদভারে। বসন্তের মৌ মৌ গন্ধে বিপদজনক সুন্দরীদের উদ্দাম চলাফেরা মধ্যমগজে কেমন একটা ভোতা সূড়সূরি দিয়ে যায়, বাধ্য করে চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলাতে। এক ‘অটোপিস্তা এল ডোরাডো’ রাস্তাটাই যেন পুরো কলোম্বিয়ার কালেইডোস্কোপ; একে অপরের কোমর জড়িয়ে সন্তানাদি সহ হাটছে স্বামী স্ত্রী, মধ্যপথে চুম্বনরত প্রেমিক প্রেমিকা, হাই হীল আর মিনি স্কার্ট পরা মধ্যবয়সী সুন্দরীদের নিতম্বের দোলা, রেস্তোরা হতে উড়ে আসা B-B-Q’র ধোঁয়া, কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয় লাতিন ভাললাগায়।
প্লাজ্যা দ্যা বলিভার’এ এসে থামতে হল। এটাই কলোম্বিয়ার রাজধানী বগোটার কেন্দ্রস্থল। প্রবেশমূখে ইতালিয়ান শিল্পী পিয়েতরো তেনারানীর তৈরী সাইমন বলিভারের বিশালকায় একটা ষ্ট্যাচু, দক্ষিনে প্যালেস অব জাষ্টিস, কংগ্রেস ভবন এবং পশ্চিমে ফ্রেঞ্চ ষ্টাইলে তেরী ল্যায়াভেনো বিলডিং অথবা বগোটার মেয়র অফিস। প্লাজার এদিক ওদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু কবুতর। এক কথায় পুরানো এবং নতুনের সমাহারে চমৎকার একটা স্থাপনা যা দেখতে পৃথিবীর সব প্রান্ত হতে ট্যুরিষ্টরা ভীড় জমায়। একটা ফ্যাক্ট উল্লেখ না করলে লেখাট অসম্পূর্ন থেকে যাবে হয়ত, পুরো লাতিন আমেরিকা জুড়ে সাইমন বলিভারের প্রভাব। দক্ষিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলা, কলোম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু এবং বলিভিয়াকে স্প্যনিশ উপনেবিশবাদ হতে মুক্ত করতে ভেনিজুয়েলান এই নেটিভ অন্য এক লাতিন বীর হোসে দ্যা সান মার্টিনের সাথে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভেনিজুয়েলার বড় শহরগুলোর প্রায় সব প্লাজারই নামকরন করা হয়েছে এই বীরের নামে। সাইমন বলিভারের পুরো নাম সাইমন হোসে আন্তনিও দ্যা লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ বলিভার পালাসিওস উ ব্লাংকা। ছবি তোলা এবং এলোমেলো ঘুরাফেরায় ঘন্টাখানেক সময় পার হয়ে গেল। আমাদের সময় খুবই সীমিত, তাই পরবর্তী ঠিকানা সাইমন বলিভার পার্কের দিকে পা বাড়ানোর সিদ্বান্ত নিলাম।
কিছুদূর হাটতেই রাজ্যের ক্ষুধা এসে চেপে ধরল দুজনকে। খালি পেট নিয়ে ঐতিহাসিন বিষয়বস্তূ দেখার পরিভ্রাজক আমি নই, তাই পেটের পাওনা মেটানোর তাগাদা দিলাম গিন্নীকে। মার্কিন ফাষ্ট ফুড ম্যাকডোনালড্ আর বার্গার কিং’এর ছড়াছড়ি চর্তুদিকে, কিন্তূ এতদূর এসে এসব খাওয়ার ইচ্ছা হলনা। বলতে গেলে প্রায় অভ্যাসই হয়ে গেছে, যে দেশেই যাই না কেন, স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহন আমার ভ্রমন আইটেনিনারীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক সময় তা চোখ এবং নাক বন্ধ করে খেতে হয়, কিন্তু তাতে পিছিয়ে আসিনা। এন্ডিসের ভয়াবহ উচ্চতায় হোয়াংকা হোয়াসি নামের একটা জায়গা আছে পেরুতে। ট্রাইবাল অধ্যুষিত ঐ এলাকার খোলা আকাশের নীচে স্থানীয় খাদ্যের স্বাদ যতদিন বেঁচে থাকব স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবে। পৃথিবীর অলিগলি ভ্রমনের এগুলোই হয়ত আলটিমেট প্রাপ্তি। শেষ পর্য্যন্ত পইয়্যো ল্যা ব্রাসাতেই (গ্রীলড্ চিকেন) থামতে হল সীমিত অপশনের কারণে। এই পইয়্যো ল্যা ব্রাসার রাজত্ব লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে। গ্রীলড্ মুরগীকে এত আপন করে খেতে পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন অংশে দেখা যাবেনা। এ যাত্রায় সামান্য একটু বৈচিত্র চোখে পরল যা দক্ষিন আমেরিকার অন্য কোন দেশে চোখে পরেনি। প্রথাগত ফর্ক & নাইফের পাশাপাশি একজোড়া প্লাষ্টিকের হ্যান্ড গ্লাবস্ দেয়া হল ব্যবহারের জন্যে। হাত ব্যবহারের স্বাধীনতা পেয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পরলাম বোধহয়, গিন্নী চোখের ইশারায় সেটাই বুঝিয়ে দিল। চমৎকার আবিস্কার, ভাজা মুরগী খাওয়ায় ডিসপোজেবল্ হ্যান্ড গ্লাবস্, আমার জন্যে এ ছিল কেরামতি জাহিরের মোক্ষম মুহুর্ত! আস্ত মুরগীটাকে টেনে ফানা ফানা করে ফেল্লাম মুহুর্তেই। আমার আর্ধাংগীনি মুগ্ব চোখে তাকিয়ে দেখল স্বামীর মুরগী নিধন বীরত্ব। ম্যাশ পটেটোর সাথে গ্রাবি মিশিয়ে আহার পর্ব শেষ করতেই হুশ হল, বলিভার পার্কে ফিরে যাওয়ার মত যথেষ্ট সময় নেই আমাদের হাতে। সান্তা মার্তার ফ্লাইট ধরতে এয়ারপোর্ট ফিরে যেতে হবে যথা সম্ভব দ্রুত।
এ যাত্রায় আর বাস নয়, টেক্সি ক্যাব নিতে হল অনেকটা বাধ্য হয়ে। ড্রাইভারকে বল্লাম বলিভার পার্কের চারদিকটা একটু ঘুরে যেতে। ট্যাক্সিতে বসে বগোটাকে বেশ অন্যরকম মনে হল। কলোম্বিয়ার জাতীয় পতাকার মতই শহরটাকেও মনে হল অসম্ভব রকমের হলুদ। মানুষগুলোকেও মনে হল উড়ছে। কোথায় যেন আনন্দের মেলা এবং সবাই মনের আনন্দে ছুটে যাচ্ছে সে দিকটায়।
এই এক উট্কো ঝামেলার কারনে বিদেশ ভ্রমন অনেক সময় চরম বিরক্তির উদ্রেক করে। ব্যাপারটা প্রথমবারের মত কটু হয়ে ধরা পরে ওসাকা হয়ে জাপান ঢুকার পথে। সিডনী হয়ে লস এঞ্জেলস্ যাচ্ছি। ওসাকায় ১৮ ঘন্টার ব্রেক। এয়ারপোর্টে এত লম্বা সময় কাটিয়ে প্রায় ১৩ ঘন্টা আকাশ ভ্রমন স্বাস্থ্যের উপর দিয়ে যাবে, তাই সিদ্বান্ত নিলাম শহরেই কাটিয়ে যাব সময়টা। জাপানে এই প্রথম, তাই এক ঢিলে দুই পাখী মারার লোভটাও কাজ করল ভেতরে ভেতরে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে অষ্ট্রলিয়ান পাসপোর্টটা জমা দিতেই সন্দেহের মধ্যরাত নেমে এল খুদে চোখের জাপানী অফিসারের জন্যে। সম্ভাব্য সব এংগেল হতে পাসপোর্টাকে যাচাই বাছাই করেও কিছু পেলনা, শেষমেশ আশ্রয় নিল প্রযুক্তির। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, লাইনের বাকি অষ্ট্রেলিয়ানরা পার হয়ে গেল ২/১ মিনিট সময় ব্যায় করে। ভেতরে ততক্ষনে অজগর সাপের তর্জন গর্জন শুরু হয়ে গেছে আমার। ধৈর্য্যের শেষ সীমায় গিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভে জানতে চাইলাম সমস্যাটা কোথায়, আমার চামড়ায় না পাসপোর্টে? ছোট চোখ দুটো বেশ কিছুটা বড় করেই তাকাল আমার দিকে, ’দিস ইজ আওয়ার রেগুলার প্রসিডিংস, উই হ্যাভ টু গো থ্রু দিস‘। ’হোয়াট ইউর প্রসিডিংস সে, এম আই ফেইক অর মাই পাসপোর্ট ইজ ফেইক?‘ এমন একটা আক্রমনাত্ত্বক উত্তরে আশপাশের অনেকেই ফিরে তাকাল। বস গোছের কেউ একজন এগিয়ে এল, কিছুক্ষন নিজদের ভেতর গাইগুই করে ৯০ দিনের ভিসা দিয়ে ফিরিয়ে দিল পাসপোর্টটা। কর্কশ একটা ধন্যবাদ দিয়ে জানিয়ে দিলাম ৯০ দিনের ভিসার দরকার ছিলনা আমার, ২৪ ঘন্টার হলেই যথেষ্ট ছিল। বগোটার ‘এল ডোরাডো’ এয়ারপোর্টেও বাধ সাধল কলোম্বিয়ান ইমিগ্রেশন। মার্কিন পাসপোর্টটাকে বিভিন্ন কায়দায় ধর্ষন করা হল, পাসপোর্টের ছবির সাথে শতবার মেলানোর চেষ্টা করল আমার চেহারা। কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতেই গিন্নী ইশারায় নিষেধ করল। আভ্যন্তরীন ফ্লাইটে এ ধরনের হাংগামা কলোম্বিয়ার মত দেশে আশা করিনি, তাই হজম করতে কষ্ট হল। ঝামেলা চুকিয়ে এভিয়াংকার ফ্লাইটে ঢুকতেই মনে হল আমিই ছিলাম শেষ যাত্রী এবং আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল বাকি সবাই। সব মিলিয়ে দেড় ঘন্টার ভ্রমন। ডান-বা আর এদিক ওদিক শেষে আকাশে ডানা মেলতেই ভুলে গেলাম এয়ারপোর্টের তিক্ততা।
ড্রাগ রিলেটেড ইস্যুর কারণে দেশটায় প্রচুর সমস্যা, খুনাখুনীও হচ্ছে যত্রতত্র, বহিবিশ্ব হতেও আসছে প্রচন্ড চাপ। কিন্তূ বাইর হতে হঠাৎ করে দেশটায় ঢুকলে এর সামন্যতম রেশও চোখে পরবেনা। কলোম্বিয়াকে মনে হবে দক্ষিন আমেরিকার অন্য দশটা দেশের মতই ফুটবল আর নাচ-গান পাগল একটা দেশ হিসাবে। আকাশ হতে বগোটাকে দেখাল শিল্পীর নিপুন ছোয়ায় আঁকা ছবির মতন। উঁচু উঁচু দালান, পাশাপাশি এন্ডিসের সাড়ি সাড়ি চূঁড়া। পাহাড়ের কোল ঘেষে ঘোরাফেরা করছে খন্ড খন্ড মেঘ, কাব্য রসিকদের জন্যে এ হতে পারে সৃষ্টির অফুরন্ত খোড়াক । এসব দেখতে পৃথিবীর এ প্রান্তে বছর জুড়েই লেগে থাকে ট্যুরিষ্টদের অস্বাভাবিক ভীড়। প্রকৃতি ও মানুষের মিলনমেলার এই বিশাল ক্যানভাস হাতছানি দিয়ে ডাকে ভ্রমনপিপাসুদের।
ছোট বিমানটায় ট্যুরিষ্টদের সংখ্যা নেহাত কম মনে হলনা। স্প্যনিশ ভাষাভাষী লাতিনোদের দেশ হিসাবে আলাদা করাটা খুব সহজ নয়, কিন্তূ সাদা চামড়ার ইউরোপীয় আর রোদে পোড়া অষ্ট্রেলিয়ানদের চিনতে বিশেষ কোন অসূবিধা হয়না। ঘন মেরুন রংয়ের আটসাট পোশাকের এয়ারহোষ্টেসদের আতিথেয়তায়ও কোন ফাঁক ছিলনা। ট্যুরিজম্ পৃথিবীর এ প্রান্তের প্রাণ, এর উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে লাখ লাখ মানুষ, তাই এ শিল্পকে বাচিয়ে রাখার কলোম্বিয়ানদের প্রচেষ্টা চোখে পরবে জীবনের সর্বত্র। যাচ্ছি ক্যরাবিয়ান সমুদ্র পাড়ের শহর শান্তা মার্তায়। দেশটার উত্তরে মাগ্দ্যালেনা ডিপার্টমেন্টের এ শহরটাকে তিন দিক হতে ঘিরে রেখেছে Sierra Nevada de Santa Marta পাহাড়। নৌ চলাচলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শহরের নৌ বন্দর। ১৫২৫ সালে স্প্যনিশ দখলদার Rodrigo de Bastidas ভিত্তি স্থাপন পূর্বক ক্যাথলিক সেইন্ট মার্থার নামে নাম করণ করেন শহরটার। বলা হয় সান্তা মার্তা শহর কলোম্বিয়ার প্রথম দিকের শহরগুলোর অন্যতম শহর। এ শহরকে ঘিরে কলোম্বিয়ানদের গর্বের শেষ নেই।
দেড় ঘন্টার পথ সোয়া ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আসতেই রক্ত হীম হয়ে গেল। পাহাড় ও সমুদ্রের ফাঁকে ছোট্ট একটা এয়ারষ্ট্রীপে এ ধরনের একটা বিমান কি করে ল্যান্ড করবে মাথায় ঢুকলনা। যাত্রীদের সবার চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছায়া। অনিশ্চয়তা এক ধরনের নীরবতা নিয়ে এল ফ্লাইটের ভেতর। যতই নীচে নামছি মনে হচ্ছে সমুদ্রের উপর ল্যান্ড করতে যাচ্ছি আমরা। যেদিকেই তাকাই শুধু ক্যরাবিয়ান সমুদ্রের নীল পানি আর রাশি রাশি ঢেউ, রানওয়েটা চোখে পরলানা কোথাও। ভ্রমন জীবনে এতবড় ভয় কোথাও পেয়েছি কিনা মনে করতে পারলামনা। গিন্নীকে দেখলাম চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন ঈশ্বরকে স্মরণ করতে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যে কায়দায় গোত্তা খেয়ে ঢিলটা ছুটে যায় একই ভাবে আমাদের প্লেনটাও আছড়ে পরল সরু রানওয়ের উপর। ভয়ে চীৎকার করে উঠল যাত্রীরা। সবকিছু শান্ত হতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। পাইলট তার খোঁয়াড় হতে বের হয়ে বত্রিশ দাঁত বের হাসি দিতেই তালিতে ফেটে পরল সবাই। মনে হল বিশ্বজয় হয়ে গেল এইমাত্র। ল্যান্ডিংয়ের এই সমস্যাটা নাকি প্রায়ই হয় শান্তা মার্তা এয়ারপোর্টে। রানওয়ে হতে প্লেন ছিটকে সাগরে ঠাঁই নিয়েছে এমন ঘটনাও নাকি কম নয়। এসব এখন অতীত, এ নিয়ে বেশী ভাবতে চাইলামনা।
প্লেন হতে বের হয়ে এক কদম এগুতেই তাপদাহের তীব্র ধাক্কা এসে আছড়ে পরল চোখে মুখে। মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবীতে এমনটা হয়েছিল শেষবার, কিন্তূ পৃথিবীর এ প্রান্তে এমনটা হতে পারে জানা ছিলনা। ধাক্কার ধকল সইতে বেশ কিছুটা সময় ব্যায় হল। ছোট অথচ খুবই গোছগাছ একটা এয়ারপোর্ট। চেক-ইন লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট হতে বেরুতেই স্তব্দ হয়ে গেলাম। এ কোথায় আমরা? স্বর্গ বলে কিছু থাকলে শান্তা মার্তা নিশ্চয় সে স্বর্গের সাক্ষাৎ প্রতিচ্ছবি।
– চলবে
রোদের তীব্র ঝাঁজে মগজ গলে যাওয়ার মত অবস্থা। প্লেনের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার তুলনায় এ মনে হল হাশরের ময়দান যেন। উপরের দিকে না তাকিয়েই আন্দাজ করে নিলাম সূর্যটা বোধহয় মধ্যচান্দি বরাবর দুহাত উপর হতে আঘাত হানছে। ঘন্টা খানেক আগে দেখা বোগোটার সাথে এর কোন মিল খুঁজে পেলাম না। বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস আর চারদিকে সবুজের সমারোহ বোগোটাকে অনেকটা ইউরোপীয় শহরের মতই মনে হবে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হল আমরা একই দেশে আছি। সাতটা দিন থাকতে হবে এ শহরে। সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে কিছুটা হতাশ হলাম। রোদের এমন কড়া মেজাজের সাথে আপোষ করতে গেলে কড়কড়ে ভাজা হয়ে ফিরতে হবে নিউ ইয়র্কে। গিন্নির ডাকে নজড় ফেরাতে মনটা অবশ্য হাল্কা হয়ে গেল। তার চোখে মুখে রাজ্যের ভাল লাগার ছোঁয়া। এ জন্যেই এতদূর আসা। সে খুশি তো আমি খুশি। আয়োজনও সার্থক।
হোটেলের বাসটাকে খুঁজে না পেয়ে একটু অবাক হলাম। লিমা হতে আমাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছিল আয়োজনে কোন ত্রুটি থাকবে না বলে। ধোঁকা দেয়া হয়েছে ভাবতে ইচ্ছে হল না। পৃথিবীর এ অঞ্চলে ট্যুরিজম খুবই গোছানো একটা ব্যবসা, যার সাথে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ মানুষের রুটি রুজির প্রশ্ন। ভ্রমণ প্রিয় মানুষদের স্ব স্ব দেশে আকর্ষণ করা নিয়ে গোটা দক্ষিন আমেরিকা জুড়ে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। কলম্বিয়া ইচ্ছে করে এ প্রতিযোগীতায় কালি ঢালবে তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পারলাম না। নিশ্চয় কোথাও কোন গোলমাল হয়েছে! প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নিতান্তই ছেলেমানুষি, এমনটা বুঝিয়ে গিন্নিকে আশ্বস্ত করে চাতকের মত তাকিয়ে রইলাম এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তাটার দিকে।
একটা নয়, একে একে তিনটা বাস এসে থামল আমাদের সামনে। বোগোটা হতে উড়ে আসা যাত্রীদের প্রায় সবাইকে দেখলাম আমাদের সংগী হতে। লাগেজ উঠানো পর্ব শেষ হল বিদ্যুৎ গতিতে। বাসে উঠে সীট নিয়ে বসতেই ক্ষমা চাওয়ার হিড়িক পরে গেল চারদিকে। ’নো হার্ড ফিলিংস’ বলে আমরাও ক্ষমা করে দিলাম। রাস্তার কাজ হচ্ছে সামনে, এয়ারপোর্ট আসার এক লেন বন্ধ এবং দেরিটা নাকি এ জন্যেই। বাংলাদেশের মানুষ আমি, ট্রাফিক জ্যামের কারণে মিনিট বিশেক দেরী ডালভাত হিসাবেই মেনে নিলাম। বাস ছাড়ার সাথে সাথে ভুলে গেলাম এসব খুচরো ঝামেলা।
অদ্ভুত সুন্দর একটা বাস। সাইজে ছোট হলেও আরামে কোন ঘাটতি নেই। একই পোশাকের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপারদের দেখে মনে হল কোন এক অদৃশ্য সুতায় পুতুলের মত নাচানো হচ্ছে তাদের। বোগোটায় দেখা ধারাল শরীরের মেয়েগুলোর তুলনায় সামনে বসা জৌলুস হীন মেয়েগুলোকে খুবই আনইমপ্রেসিভ মনে হল। এদের ইংরেজী বলার জ্ঞানও খুব একটা যুতসই মনে হলনা। এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে মূল রাস্তায় পরতেই যাত্রীদের সবাই ব্যস্ত হয়ে পরল চারদিকের প্যানোরমা নিয়ে। শহরকে তিন দিক হতে ঘিরে রেখেছে সিয়েরা নেভাদা দ্যা সান্তা মার্তা পাহাড়ের চূড়াগুলো। খন্ড খন্ড মেঘ রাজ্যের আলসেমি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চূড়া গুলোর কোল ঘেষে। ধোয়ার মত এক ধরনের নীল আস্তরণ পাহাড়ি প্যানোরমায় একে দিয়েছে অদ্ভুত এক প্রসন্নতা। ভেতর হতে বাইরের পৃথিবীকে নিথর নিস্তব্ধ মনে হলেও পড়ন্ত বিকেলের আকাশটাকে মনে হল প্রাণে ভরপুর। নীলের সমুদ্রে ডুবে আছে গোটা আকাশ, সাথে হরেক রকম পাখির মেলা। শহরের রাস্তাঘাট খুব একটা উন্নত মনে হল না। অনেকটা আমাদের দেশের মত। চারদিকে অযত্ন আর অবহেলার ছোয়া।
মিনিট পনেরোর ভেতর পরিবর্তন চোখে পড়ল। গাইড জানাল আমরা এসে গেছি প্রায়। শহরের পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরতেই দমে গেলাম ভেতরে ভেতরে। এ কোথায় চলছি আমরা! সিকউরিটি গেট পার হচ্ছি একটার পর একটা। গেটে দাঁড়ানো তামাটে চামড়ার স্থানীয় লোকগুলোকে প্রথম দৃষ্টিতে একদল রবোট বলেই মনে হবে। ভাষা নেই কারও মুখে, কথা যা বলছে তাও ইশারায়। লোহার গেট খুলেছে একটা একটা করে, আমরা ভেতরে ঢুকছি স্বশস্ত্র প্রহরীদের লম্বা স্যালুট সাথে নিয়ে। হলিউডের সায়েন্স ফিকশন ছবির মত মনে হবে চারদিকের দৃশ্যপট। মনে হবে অসৎ উদ্দেশ্যে গোপন কোন গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের। আরেকটু ভেতরে ঢুকতেই পরিবর্তনটা প্রকট হয়ে ধরা পরল। শেষ ফটক পার হয়ে সামান্য একটু এগিয়ে থেমে গেল আমাদের বাস। ইউনিফর্ম পরিহিত একদল যান্ত্রিক আদম হুড়মুড় করে ঘিরে ফেললো আমাদের। লাগেজগুলো নামিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করল সবাইকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলাম আমরা।
উঁচুমতো একটা ডিবি পার হয়ে অফিসের দোড় গোড়ায় পা রাখতেই চোখের সামনে আছড়ে পরল অবিস্মরণীয় এক দৃশ্য। ক্যারাবিয়ান সাগর।
চলবে…
Source : AmiBangladeshi.Org