ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা ‘গৌরনদী’

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা ও দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্মৃদ্ধ এবং রাজনৈতিক সচেতন বলেখ্যাত বরিশালের গৌরনদী। স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কৃষি মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্বপ্ন ছিলো বরিশাল উত্তর জনপদের মহাকুমা গৌরনদীকে জেলা হিসেবে রূপান্তরিত করায়। ১৯৭৫ সনের ১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কৃষি মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গৌরনদী জেলা ঘোষনার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালো রাতে ঘাতকদের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাত শহীদ হন। ফলে ওইসময় গৌরনদীবাসীর জেলার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু ও সাবেক কৃষি মন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অতিসম্প্রতি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) নির্বাচনী এলাকার মহাজোটের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস গৌরনদী ও আগৈলঝাড়াবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি গৌরনদীকে জেলা ঘোষনা করার জন্য মহান সংসদে দাবি তোলেন। সে লক্ষ্যে তিনি (এমপি) গৌরনদীকে জেলা ঘোষনা করার বাস্তব যৌক্তিকতাও তুলে ধরেন। এমপি ইউনুস তার বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগীতায় তৎকালীন কৃষি মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করনের লক্ষ্যে জেলা সদরে যেসব অফিস থাকা প্রয়োজন তা গৌরনদীতে স্থাপন করেছেন। যারমধ্যে পাঁচ থানা পুলিশের হেডকোয়ার্টার সহকারি পুলিশ সুপারের অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় অফিস, বন বিভাগের উপ-বিভাগীয় অফিস, বিদ্যুৎ বোর্ড অফিস, তাঁত বোর্ড অফিস উল্লেখযোগ্য।

সূত্রমতে, ভৌগলিক দিক থেকে গোপালগঞ্জ জেলার পূর্ব সীমান্তে, মাদারীপুর জেলার দক্ষিণ, বরিশাল বিভাগীয় শহরের উত্তর সীমান্তে ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার মুখে ১৪৭.৮৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনে গৌরনদী উপজেলার অবস্থান। বরিশালের বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, মুলাদী, আগৈলঝাড়া ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার মধ্যবর্তীস্থানে গৌরনদী অবস্থিত। অতিপ্রাচীণকাল থেকেই শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, ইতিহাস-ঐতিহ্যে গৌরনদীর সুনাম-সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পরে। এখনো তা বিদ্যামান রয়েছে। এখানে গড়ে উঠেছিলো উন্নত জনপদ। তাই মোগল যুগে ইসলাম প্রচারক খানজাহান আলী ও ইয়েমেনের বাদশার পুত্র হযরত মল্লিক দূত কুমার পীর সাহেব বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসে গৌরনদীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা এ অঞ্চলে স্থাপন করেছেন বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, দীঘি ও সরাইখানা। এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আল্লাহর মসজিদ, কমলাপুর মসজিদ, হিন্দু ধর্মাবোলম্বীদের তীর্থস্থান বার্থী তাঁরা মায়ের কালী মন্দির, মাহিলাড়ার সরকার মঠ, সমাজ সেবক ছবি খাঁর হুজরা, পলাশীর যুদ্ধের দূর্গ ও কামান, শতিদাহ মঠসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন।

গৌরনদীর নলচিড়া, মাহিলাড়া ও বাটাজোর নিয়ে নিম নবদ্বিপ গঠিত হয়েছিলো। ওইসব স্থানে প্রায় ৩০জন পন্ডিত লোক বসবাস করতেন। গৈলা, ফুল্লশ্রী এলাকা ছিলো উপ-মহাদেশের সবচেয়ে অধিক শিক্ষিত লোকের বসবাস। মধ্যযুগের মহাকবি বিজয় গুপ্তের জন্মস্থান এ এলাকায়। বৃট্রিশ যুগে সংস্কৃতি ভাষা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে গৈলার কবিন্দ্র বাড়িতে এবং নলচিড়ায় দুটি টোল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিলো। ওইসময় গৈলাতে ৩৬০ ঘর তালুকদার ও একজন জমিদারের বসতি ছিলো। গৌরনদী উপজেলার পাশ্ববর্তী আশোকাঠী গ্রামে মোহন লাল সাহা এবং চাঁদশী গ্রামে কেদারনাথ বসু, অন্মিকা চরন গুহ ও অন্নদা বসু নামের তিনজন জমিদারের বাড়ি ছিলো। বরিশালের শিক্ষা ও সংস্কৃতির রূপকার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বসত বাড়ি গৌরনদীর বাটাজোরে। অবিভক্ত ভারত বর্ষের একাধিকবার নির্বাচিত এমএলএ ও আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জন্মস্থানও হচ্ছে গৌরনদী। বৃট্রিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধি পর পর দু’বার এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠক করার জন্য গৌরনদীতে এসেছিলেন। ওই আন্দোলনে নিহত হয়েছিলেন গৈলার তারক সেন নামক এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। তৎকালীন সময়ে গৈলা গ্রামে শতাধিক এমএ পাশ এবং ৪০ জন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী লোক বসবাস করতেন। দ্বিতীয় কোলকাতা বলেখ্যাত গৌরনদীতে তখন সরাসরি কোলকাতা থেকে ষ্টীমার নিয়মিত আসা যাওয়া করতো। সারাদেশের সাথে নদী ও সড়ক পথে রয়েছে গৌরনদীর সুষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থা। গৌরনদীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক। বরিশাল সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত গৌরনদী উপজেলা। স্বাধীনতা যুদ্ধেও গৌরনদীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছিলো অসামান্য অবদান। ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর গৌরনদী পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিলো। দেশের মধ্যে সর্বশেষ বিজয় পতাকা উড়েছিলো গৌরনদী। ভাষা আন্দোলনের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহবায়ক ভাষা সৈনিক মরহুম কাজী গোলাম মাহবুবের জন্মস্থানও হচ্ছে গৌরনদী।

গৌরনদী পৌর নাগরিক কমিটির সাধারন সম্পাদক সাংবাদিক জহুরুল ইসলাম জহির জানান, ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালো রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাত শহীদ হবার পর গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরিত করার উদ্যোগ স্থিমিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৮১ সনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করনের পদক্ষেপ গ্রহন করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারনে তার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এরপর প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহনের পর মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দেশের সবকটি মহাকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করলেও দুরভাগ্যক্রমে বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা গৌরনদী তৃতীয়বারের মতো জেলা ঘোষনা থেকে বাদ পরে যায়। জেলার জন্য চতুর্থবারের মতো দাবি ওঠে ১৯৯১ সনে। কিন্তু তাও আর আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৯৬ সনে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নির্বাচিত হন। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর তিনি গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করনের প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ গৌরনদী পৌরসভা গঠন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পিতা শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৌরনদীতে ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন, পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিস, ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিভাগীয় বেবী হোমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। ২০০১ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী এম.জহির উদ্দিন স্বপনের নির্বাচনী জনসভায় (সরকারি গৌরনদী কলেজ মাঠে) প্রধান অতিথির ভাষনে বেগম খালেদা জিয়া গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরিত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাও আর আলোর মুখ দেখেনি।

সর্বশেষ অতিসম্প্রতি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) নির্বাচনী এলাকার মহাজোটের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু ও সাবেক কৃষি মন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এবং গৌরনদী-আগৈলঝাড়াবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি গৌরনদীকে জেলা ঘোষনা করার জন্য সংসদে দাবি তোলেন। তার এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির কাছে জোরদাবি জানিয়ে ইতোমধ্যে (২৮ জুন) গৌরনদী ও আগৈলঝাড়াবাসী বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী বাসষ্ট্যান্ডে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও সাবেক কৃষি মন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ওইদিন সকালে আধাঘন্টা থমকে ছিলো গৌরনদী। বন্ধ ছিলো দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সড়ক পথের সকল যোগাযোগ। শেষপর্যন্ত কি বঙ্গবন্ধু ও সাবেক কৃষিমন্ত্রীর অপূর্ণ স্বপ্ন পূরন করে বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা গৌরনদী কে জেলা ঘোষনা করা হবে? নাকি এলাকাবাসীর স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে? এমনই নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন মহলের মধ্যে।