বরিশালে এলসি স্টেশনের অভাবে ভোগান্তিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকরা

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ রাজস্ব বোর্ডের এস.আর.ও নং-২১১/২০০৮/শুল্ক, তাং-২৯/০৬/২০০৮  অনুযায়ী বরিশাল এলসি ষ্টেশন ঘোষণা করা হলেও এর কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। ফলে বরিশালে অবস্থিত আমদানীকৃত কাঁচামাল নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আমদানী কারকদের ঘূর্ণায়মান নদীপথে কিংবা স্থলপথে পণ্য আমদানী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। নৌরুটে পণ্য আমদানির সময় আমদানিকৃত পণ্য ভারত থেকে শেখবাড়িয়া হয়ে নদী পথে প্রায় ১শ’ নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করে খুলনা এলসি ষ্টেশনে পৌঁছে শুল্কায়ন শেষে পুনরায় খুলনা থেকে ঘূর্ণায়মান নদীপথে বরিশালে আসে। যা শেখবাড়িয়া হতে বরিশালের সরাসরি দূরত্ব অপেক্ষা দ্বিগুণ। ফলে অতিরিক্ত সময় ক্ষেপনের পাশাপাশি আমদানীকারকদের পরিবহন জনিত ব্যয় বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

আমদানীকৃত কাঁচামালের পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবে ওই স কল কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্য সমূহের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ফলে মূল্য বৃদ্ধি জনিত কারণে উৎপাদনকারীদের বর্তমানে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় ও বিপণনে প্রতিনিয়ত বড় ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শুধুমাত্র বরিশাল এলসি ষ্টেশনের কার্যক্রম সচল না থাকায় এ এলাকার আমদানীকারক ব্যবসায়ীবৃন্দ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান সমূহ প্রতিনিয়ত নানামুখী বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। একই কারণে আমদানী নির্ভর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর পরিবহন খরচ বেশী হওয়ার এ এলাকার সাধারণ জনগণ অন্যান্য এলাকার চেয়ে অধিক মূল্যে এসব দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে।

ভৌগলিকভাবে বিভাগীয় শহর বরিশাল পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে নদী বেষ্টিত। তাই পণ্য পরিবহনের জন্য নৌপথই হচ্ছে এই শহরের প্রধান মাধ্যম। অসংখ্য নৌযান নোঙ্গর করার জন্য এখানে বিআইডব্লিউটিএর ঘাট, কেডিসি ঘাট সহ রয়েছে অসংখ্য সরকারি, বেসরকারি ঘাটের সুব্যবস্থা। এ পর্যায়ে শহর সংলগ্ন যে কোন একটি ঘাটকে এলসি ষ্টেশন ঘোষণা করে ঐ ঘাটের মাধ্যমে আমদানী ও রপ্তানীকৃত পণ্য লোড আনলোডের ব্যবস্থা করা অনায়াসেই সম্ভব। আলাদা ভৌত অবকাঠামো তৈরীর আবশ্যকতা নেই। তবে শুধু নজরদারীর লক্ষ্যে একটা ছোট স্থাপনা ও পণ্য খালাশের পর প্রাথমিক গুদামজাত করণের ব্যবস্থা করে সুবিধাজনক যে কোন নৌঘাটকে চিহ্নিত করে এলসি ষ্টেশন এর কার্যক্রম চালু করা সম্ভব। আমদানীকৃত পণ্য শুল্ক ষ্টেশনে পৌঁছানোর পরে শুল্কায়ন কার্যক্রমে লোকবল বৃদ্ধি না করে বরিশাল কাষ্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগে কর্মরত জনবল দিয়েই পরীক্ষন ও শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পাদন করা সম্ভব।

এলসি ষ্টেশন এর মাধ্যমে প্রধানত বিভিন্ন কারখানার কাঁচামাল আমদানী হবে যা সাধারণত সিআরএফ ভুক্ত হওয়ায় রাজস্ব ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া বরিশাল কোন চোরাচালানী রুট নয় বিধায় চোরাচালানের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির সম্ভাবনা নেই। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারিত হলে প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলে উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানা বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। সমৃদ্ধশালী হবে দেশের অর্থনীতি। ভারতীয় যে সকল নৌবন্দর থেকে বাংলাদেশে আমদানীকৃত পণ্য নৌযানে বোঝাই করে বাংলাদেশের বিভিন্ন শুল্ক ষ্টেশনে যায় সে সকল নৌযানকেই বরিশালের কোষ্টাল এরিয়া বা বরিশাল সংলগ্ন নদী দিয়ে যেতে হয়। ফলে এসব বিষয় বিবেচনায় এনে দ্রুততার সাথে বরিশালে এলসি ষ্টেশনের কার্যক্রম শুরু করা উচিত।

বরিশালের শহর এলাকাতেই আমদানীকৃত কাঁচামাল নির্ভর অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে অলিম্পিক সিমেন্ট লিঃ, সোনারগাঁও টেক্সটাইল লিঃ, খানসন্স টেক্সটাইল লিঃ, খানসন্স জুটেক্স লিঃ, অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিঃ, অপসো স্যালাইন লিঃ, গোবাল ক্যাপসুল, লিঃ, রেফকো ল্যাবরেটরিজ লিঃ, ইন্দোবাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস লিঃ, কেমিষ্ট ল্যাবরেটরিজ লিঃ, পদ্মা ক্যাপ লিঃ, এমইপি লিঃ (বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান), অমৃত ফুড প্রডাক্টস্ লিঃ, অমৃত কনজুমার প্রডাক্টস্ লিঃ, সুন্দরবন নেভিগেশন গ্রুপ অফ কোম্পানি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিনিয়ত ক্ষতির শিকার হয়ে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান সমূহ রুগ্ন শিল্পে পরিণত হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার যেমন বিপুল অংকের রাজস্ব হারাবে তেমনি কর্মসংস্থান হারাবে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। তাছাড়া বরিশালে এলসি ষ্টেশনের কার্যক্রম চালু হলে সাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন চাল, ডাল, গম, সয়াবিন কেক, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, ফলসহ অন্যান্য দ্রব্যের আমদানি কারকদের সময়ের সাথে সাশ্রয়ী হবে আমদানী খরচ। ফলে আমদানী নির্ভর এসব দ্রব্যের বাজার মূল্যহ্রাস পাবে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সুফল ভোগ করবে সাধারণ এলাকাবাসী।

বিশেষ সূত্রে জানা যায়, বরিশালের আমদানীকৃত কাঁচামাল নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান, আমদানি কারক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের এই মারাত্মক সংকট নিরসনে বরিশালের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক সিমেন্ট লিঃ মাননীয় সদস্য শুল্ক ও মূসক নীতি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর বরাবরে গত ১৩/০৬/২০০৯ইং তারিখ বরিশালে এলসি ষ্টেশন এর কার্যক্রম চালু করার জন্য একটি আবেদন করে যা, মাননীয় কমিশনার, কাষ্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, খালিশপুর, খুলনা মহোদয়ের সুপারিশ পূর্বক মাননীয় সদস্য (শুল্ক ও মূসক নীতি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর বরাবরে ০৫/১০/২০০৯ইং তারিখ প্রেরণ করা হয় যার নথি নং-৫/২০(১৮) এলসি-এডমিন/এলসি ষেটশন/ বরিশাল /০৯/ ২১৩৮। উল্লেখ্য যে, কমিশনার, কাষ্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, খালিশপুর, খুলনা এর আদেশ পত্র নথি নং-৫/ ২০(১৮) এলসি-এডমিন/এলসি ষ্টেশন/ বরিশাল/ ০৯/২৭৪৩, তারিখ ২৭/১২/২০০৯ইং অনুযায়ী তৎকালীন বিভাগীয় কর্মকর্তা, কাষ্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ, বরিশাল কর্তৃক বরিশালে এলসি ষ্টেশন কার্যকর করার বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়েছিল। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে ভৌত অবকাঠামো, আমদানী রফতানি বাণিজ্যের উযোগিতা, রাজস্ব ঝুঁকি লোকবলের প্রয়োজনীয়তা, ভিআইবিআইটিওয়াই/ টিকে থাকার ক্ষমতা ও ভারতীয় অংশে শুল্ক ষ্টেশন থাকার তথ্য সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা শেষে সহকারী কমিশনার, কাষ্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ, বরিশাল এর নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা উল্লেখ করে বরিশালে এলসি ষ্টেশন এর কার্যক্রম চালু করার পক্ষে সুপারিশ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রযোজনীয়তা ও যৌক্তিকতার বিচারে সকল ধরণের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বরিশালে এলসি ষ্টেশন এর কার্যক্রম চালু হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বরিশালে এলসি ষ্টেশন এর কার্যক্রম চালু করার প্রক্রিয়া স্থগিত থাকায় সংকট থেকে রেহাই পায়নি বৃহত্তর বরিশাল বিভাগবাসী।

সূত্রে আরো জানায় শিল্প উন্নয়নে অনগ্রসর, অবহেলিত, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের শিল্প উদ্যোক্তা, কারখানা মালিক, আমদানী কারক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বরিশাল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি আলাদা আলাদা ভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর চেয়ারম্যানের বরাবরে বরিশালের এলসি ষ্টেশন এর কার্যক্রম শুরু করার জন্য আবেদন করেছেন। আশা করা যায় বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে সুদৃষ্টির মাধ্যমে অচিরেই চালু করা সম্ভব হবে বরিশাল এলসি ষ্টেশন এর কার্যক্রম। যা বৃহত্তর বরিশাল বিভাগবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশাকে বাস্তবতায় রূপ দেবে।