কীর্তনখোলা নদীর দপদপিয়া সেতু ঘেঁষে বালু উত্তোলনের মহাৎসব – হুমকির মুখে রব সেরনিয়াবাত সেতু

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বরিশালের শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (দপদপিয়া) সেতু ঘেঁষে কীর্তনখোলা নদী থেকে বালু তুলে অবাধে বিক্রি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সম্প্রতি প্রশাসনের চাঁপের মুখে কিছুদিন বালু তোলা বন্ধ থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে পূর্ণরায় বালু উত্তোলনের কাজ শুরু হয়েছে। সেতু ঘেঁষে এভাবে বালু উত্তোলন চলতে থাকায় হুমকির মুখে পড়েছে দপদপিয়া সেতু ও নদীর তীরবর্তী বাসিন্দাদের ঘর-বাড়ি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেতু ঘেঁষে কীর্তনখোলা নদীর প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অথচ জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বালু উত্তোলনে কোনো ইজারা নেয়া হয়নি। বালুমহল ইজারা প্রদান ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে প্রণীত আইনের ৪-এর ‘খ’ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, সেতু এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা বা আবাসিক এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু বা মাটি তোলা নিষিদ্ধ। এখানে আইনের কোন তোয়াক্কা না করেই প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা তাদের খেয়াল খুশী মতো সেতু ঘেঁষেই বালু উত্তোলনের কাজ অব্যাহত রেখেছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সেতু এলাকায় বালুর ব্যবসা করে আসছেন আব্দুল খালেক মিয়া, মোহন শরীফ, সবুজ হাওলাদার, মিলন হাওলাদার, আনোয়ার হোসেন, বাশার চৌকিদার, রহমান, মোস্তফা, মজিবর, কামরুল, মোনাব্বরসহ কয়েকজন প্রভাবশালীরা। এদের মধ্যে জনৈক মোনাব্বর প্রথম সেতু ঘেঁষে বালু উত্তোলনের ব্যবসা শুরু করেন। সেতু এলাকায় অবাধে বালু উত্তোলন ঠেকাতে গত ২১ মে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ মোঃ মোকাদ্দেস বরিশাল কোতোয়ালী মডেল থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেছিলেন। এরপর কিছুদিন বালু উত্তোলন বন্ধ থাকলেও স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে পূর্ণরায় সেতু ঘেঁষে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। দিন-রাত ২৪ ঘন্টায় ৮ থেকে ১০টি ড্রেজার দিয়ে বিরামহীনভাবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চললেও অদৃশ্য কারনে প্রসাশন নীরব ভুমিকা পালন করছে।

এ ব্যাপারে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতুর প্রকৌশলী মোঃ সামসুল আরেফিন বলেন, মাটির স্তর অনুযায়ী সেতুর নকশা করা হয়েছে। ওই স্তর থেকে মাটি সরে গেলে সেতুটির ক্ষতি হবে। সেতু এলাকা থেকে বালু উত্তোলন অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোঃ নাজমুল হক বলেন, বালুমহল ইজারা দেয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন। কিন্তু এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ ছাড়পত্র নেয়নি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পলাশ কান্তি বালা বলেন, স্থাপনা নষ্ট হতে পারে এমন কোনো স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা নিষিদ্ধ। সুতরাং সেতু এলাকায় বালু তোলার অনুমতি নেই। কারন এলাকা নির্ণয়ের বিষয়টি সার্ভেয়াররা নকশা করে দেন। সেই নকশার বাহিরে গিয়ে কেউ বালু উত্তোলন করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানা গেছে, বালু উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান আল জেরিন ১৫ লক্ষ টাকা ও রুকাইয়া ড্রেজার ১২ লক্ষ টাকায় কীর্তনখোলার বালুমহল ইজারা নিয়েছেন। তাদের বালু উত্তোলনের এলাকা চিহ্নিত করে দেয়া হলেও ওই প্রতিষ্ঠান দুটি আবার প্রায় এক ডজন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিয়েছে। তারা ওই নকশার বাহিরে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতুর কয়েক গজের মধ্য থেকে বালু উত্তোলন করে আসছে। এ ব্যাপারে আল জেরিন নামের ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক লুৎফর রহমান বলেন, বরিশাল নৌ-বন্দর থেকে নলছিটি উপজেলা পর্যন্ত নদীর অংশ বালুমহল হিসেবে আমি ইজারা নিয়েছি। তবে বালু উত্তোলনের সময় শ্রমিকেরা ভুল করে সেতুর পাশে গিয়ে বালু উত্তোলন করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মেসার্স রূকাইয়া ড্রেজিং’র মালিক মোঃ আমিনুল ইসলাম চুন্নু বলেন, আমরা সরকারি টাকা জমা দিয়ে লিজ এনেছি। কিন্তু কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারি অনুমতি না নিয়েই সেতু এলাকার বালু উত্তোলন করছে। সেতু এলাকায় জনৈক মোস্তফা, মজিবর, কামরুলসহ কয়েকজন ব্যবসায়ীর শ্রমিকেরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এ ব্যাপারে সেতু প্রকল্পের পরামর্শক রণজিত কুমার ভৌমিক বলেন, সেতু এলাকায় বালু উত্তোলন করলে শুধু সেতুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সঙ্গে নদীর গতিপথ পরিবর্তনসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় ভাঙ্গনের আশঙ্কা রয়েছে। সওজ’র নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ মোঃ মোকাদ্দেস বলেন, ‘সওজের নিজস্ব জনবল কম থাকায় সেতু এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে পুলিশের সহায়তা চেয়ে আমি থানায় সাধারন ডায়েরী করেছি। কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মতিয়ার রহমান জানান, ‘সওজ’র পক্ষ থেকে সাধারন ডায়েরী করার পর থানার উপ-পরিদর্শক (এস.আই) হেলালুজ্জামানকে সেতু এলাকায় বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এস.আই হেলালুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সেতু এলাকায় বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য পুলিশের টহল অব্যাহত রয়েছে। তার পরেও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে হয়তো কেউ বালু উত্তোলন করে থাকতে পারে।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের কীর্তনখোলা নদীর ওপর নির্মিত শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতুটি উদ্বোধন করেন। ১ হাজার ৩’শ ৯০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার প্রস্থের এ সেতুটি নির্মাণের জন্য ব্যয় হয় ২’শ ৩৩ কোটি টাকা।

কীর্তনখোলা নদীর দপদপিয়া সেতু ঘেঁষে বালু উত্তোলনের মহাৎসব - হুমকির মুখে রব সেরনিয়াবাত সেতু