চাই বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে তিন’শ পরিবার

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রত্নপুর ইউনিয়নের মোহনকাঠী গ্রামের তিন’শ পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন মাছ ধরার ফাঁদ চাই বানিয়ে। কবে কখন কেই বা প্রথম ওই গ্রামে চাই তৈরি করার কাজ শুরু করেছেন তাহা সঠিক করে কেহ বলতে না পারলেও এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন চাই পল্লীটি প্রায় দু’শ বছরের পুরনো। বংশ পরস্পরায় এ গ্রামের তিন’শ পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে চাই তৈরির ওপর। গ্রামটির প্রত্যেক বাড়ির প্রত্যেকটি ঘরের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী, বয়োবৃদ্ধরা সবাই চাই তৈরি করেন। এ গ্রামের পুরুষেরা বর্ষা মৌসুমের ছয়মাস চাই তৈরি ও শুল্ক মৌসুমে দিনমজুরের কাজ করেন। মোহনকাঠী গ্রামের তৈরি করা চাই বিক্রি হচ্ছে বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাগুলোতে।

নির্ভৃত, খেটে খাওয়া ঘনবসতিপূর্ণ ও শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে পরা গ্রামটির নাম মোহনকাঠী হলেও বর্তমানে ওই গ্রামকে সবাই “আগৈলঝাড়ার চাই পল্লী” নামেই চেনেন। নানাবিধ সমস্যার মধ্যে ওই গ্রামের তিন’শ পরিবার এখনও বংশ পরস্পরায় চাই তৈরির পেশাকে আকঁড়ে ধরে রেখেছেন। চাই তৈরির প্রধান উপকরন বাঁশ, বেঁত ও লতার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই অর্থাভাবে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন ও বিভিন্ন এনজিও কিংবা গ্রাম্যসুদি মহাজনদের কাছ থেকে টাকা এনে এ ব্যবসা করছেন। এ কুটির শিল্প ‘চাই পল্লী’টিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারি ভাবে সহজ শর্তে ঋণ বিতরন করা হলে এ পল্ল¬ীর শ্রমজীবিরা তাদের দীর্ঘদিনের পেশাকে টিকিয়ে রেখে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতে পারেন।

দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষার আলো থেকে মোহনকাঠী গ্রামটি পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে ওই গ্রামের দিনমজুরেরা স্বপ্ন দেখছেন সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার। তারই ধারাবাহিকতায় ওই গ্রামের মাখন বৈরাগীর পুত্র দুলাল বৈরাগী বর্তমানে মাস্টার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত, হরলাল বৈদ্ধর পুত্র প্রশান্ত কুমার বৈদ্ধ øাতক প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত। প্রশান্ত কুমার বৈদ্ধ জানান, লেখাপড়ার পাশাপাশি সে তার পিতার কাজে সহযোগীতা করে যাচ্ছেন। শুধু প্রশান্তই নয় ওই গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনার পাশাপাশি চাই তৈরির কাজে পিতা-মাতাকে সহযোগীতা করছেন।

ওই গ্রামের হরলাল বৈদ্ধ (৬৬), নলিনী বৈরাগী (৭০), মাখন বৈরাগী (৬৫), রাম লাল বৈরাগী (৬০) সহ অনেকেই জানান, চাই তৈরির প্রধান উপকরন হচ্ছে তল্লা বাঁশ, বেঁত ও কৈয়া লতা। বতর্মানে বেঁত দুস্পাপ্র হওয়ায় বাঁশ ও লতা দিয়েই চাই তৈরি করা হয়। কুয়াকাটা, চট্টগ্রাম, কাপ্তাইসহ পাহারী অঞ্চল থেকে পাইকাররা কৈয়া লতা ক্রয় করে আনেন। তারা আরো জানান, পানি বৃদ্ধি হলেই চাইয়ের কদর বেড়ে যায়। দুই’শ টাকার তল্লা বাঁশ, দুই’শ টাকার কৈয়া লতা দিয়ে একেকজন শ্রমিক ৫দিনে এককুড়ি (২০টি) চাই তৈরি করতে পারেন। মহাজনদের কাছ থেকে দাদন আনার ফলে তাদের কাছে প্রতি কুড়ি চাই পাইকারী হিসেবে বিক্রি করা হয় ১২ থেকে ১৬’শ টাকায়। বাজারে যার দাম ১৮ থেকে ২২’শ টাকা। মোহনকাঠী গ্রামের লক্ষন বৈরাগী, গৌরাঙ্গ বৈরাগী, দুলাল ঢালী প্রতি সপ্তাহের শনি ও বুধবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাইকারী হিসেবে তৈরিকৃত চাই ক্রয় করে নিয়ে যান।

লক্ষন বৈরাগী জানান, মোহনকাঠী গ্রামের তৈরিকৃত চাই স্থানীয় মাহিলাড়া, পয়সারহাট, সাহেবেরহাট, ধামুরাসহ বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠী, ভোলা, ঘাঘর, শশীকর, নবগ্রাম, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, খুলনা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার হাট-বাজারে বিক্রি করা হয়। রতœপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সরদার জানান, মোহনকাঠীর চাই পল্লী আগৈলঝাড়ার মডেল। তিনি চাই পল্লীর এ হস্তশিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ভাবে সহজ শর্তে ঋণ বিতরনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

চাই বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে তিন’শ পরিবার