অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে গেলেন : হুমায়ুন আহমেদ

বিংশ শতাব্দীর বাঙালীর জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম নাম হুমায়ুন আহমেদ। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং নাট্যকার। বলা হয়, বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীর জনক। অতুলনীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি অন্তরাল জীবনযাপন করেন এবং লেখলেখি ও চিত্রনির্মাণের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। হুমায়ুন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নবেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে গেলেন : হুমায়ুন আহমেদতৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। তার পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। তার বাবা লেখালিখি করতেন ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। বগুড়ায় থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থের নাম ‘দ্বীপ নেভা যার ঘরে’।

শিক্ষা এবং কর্মজীবন: তার বাবা চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্নস্থানে অবস্থান করেছেন। বিধায় হুমায়ুন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সব গ্র“পে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি, নাটক নির্মাণ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন।

সাহিত্যকৃতি: ছাত্র জীবনে একটি ‘ নন্দিত নরকে’ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। শঙ্খনীল কারাগার তার ২য় গ্রন্থ। এ পর্যন্ত (২০০৯) তিনি দু’শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস প্রকাশনা করেছেন। তার রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো ‘গল্প-সমৃদ্ধি।’ এছাড়া তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেন যাকে একরূপ জাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায়। তার গল্প ও উপন্যাস সংলাপপ্রধান। তার বর্ণনা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা তার রয়েছে। যদিও সমাজসচেতনতার অভাব নেই তবু লক্ষণীয় যে তার রচনায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত। সকল রচনাতেই একটি প্রগাঢ় শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে; ফলে ‘ভিলেইন’ চরিত্রও তার লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ। অনেক রচনার মধ্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির প্রচ্ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আরেকটি বড় মাপের রচনা যা কিনা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত।

উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, রজনী, এপিটাফ, পাখি আমার একলা পাখি, ফেরা, নিষাদ, দারুচিনি দ্বীপ, নির্বাসন, অমানুষ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, দূরে কোথাও, মন্দ্রসপ্তক, বাদশাহ নামদার, সাজঘর, বাসর, কবি, শ্রাবণ মেঘের দিনে, তিথির নীল তোয়ালে, নৃপতির ইস্টিশন, অচিনপুর ইত্যাদি। এছাড়া তিনি জনপ্রিয় হিমু ও মিসির আলীর স্রষ্টা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, ১৯৭১, সূর্যের দিনের মতো উপন্যাস। অনন্ত নক্ষত্র বীথি, ইরিনার মতো কয়েকটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীও লিখেছেন তিনি।

চলচ্চিত্র: টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ুন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তার পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সনে। ২০০০ সনে শ্রাবণ মেঘের দিন ও দুই দুয়ারী চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেণীর দর্শকদের কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন চন্দ্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সনে ‘সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমী পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিল। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। তার সব চলচ্চিত্রে তিনি নিজে গান রচনা করেন। ২০০৮-এ আমার আছে জল চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন। ২০১২ সনে তার পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা (চলচ্চিত্র)। এছাড়াও হুমায়ুন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এরমধ্যে ২০০৬ সনে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত দূরত্ব, বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে এবং আবু সাইদ পরিচালিত নিরন্তর। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র দারুচিনি দ্বীপ।

নাটক: ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা শুরু করেন তিনি। এটি তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। তার অন্যতম ধারাবাহিক নাটক-এইসব দিন রাত্রি, বহুবীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার। এসব বেশিরভাগই ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে নির্মিত। সম্প্রতি তিনি বহু প্যাকেজ নাটক নির্মাণ করেছেন। পুরস্কার: বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৮১, শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক ১৯৯৪, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৩, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), লেখক শিবির পুরস্কার ১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পদক (১৯৮৭), বাকশাস পুরস্কার (১৯৮৮), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক।

{loadposition AD108}

শেষ জীবনে হুমায়ুন: ঢাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত দখিন হাওয়া এ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করতেন। আর ঢাকার অদূরে গাজীপুরের গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত বাগানবাড়ি নুহাশ পল্লীতে কাটত তার বেশির ভাগ সময়। তিনি বিবরবাসী মানুষ; তবে মজলিসী ছিলেন। রসিকতা তার প্রিয়। তিনি ভণিতাবিহীন। নীরবে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করা তার শখ ছিল। তবে সাহিত্য পরিমণ্ডলের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি বা দলাদলিতে তিনি কখনও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেননি। তিনি স্বল্পবাক, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তিনি ছবি এঁকেও অবসর সময় কাটাতে ভালবাসতেন। ভালবাসতেন মানুষ। নিজের গহীন গোপনে সকল ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করে হতে চাইতেন মহাপুরুষ। যার রূপায়ন ঘটেছে তার সৃষ্ট কিংবদন্তি চরিত্র হিমুর প্রতিটি পদক্ষেপে।

এই মহাপুরুষের মহাপ্রনয় ঘটে গত ১৯ জুলাই। সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিদারুণ এক কষ্টের রজনী ছিল ১৯ জুলাই। কারণ, এ রাতেই জীবনের দীর্ঘ পথচলার ইতি টানেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ। প্রযুক্তির কল্যাণে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতাল থেকে খুব দ্রুতই হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর চলে আসে দেশে। ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত ১১টা ২০ মিনিট, তখনই নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের দেশে থাকা স্বজনরা জেনে যান তার মৃত্যুর খবর। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, পত্রিকা অফিস থেকে শুরু করে সংবাদ সংস্থাগুলো পেয়ে যায় নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের প্রস্থানের সংবাদ। দেশে পাঠক সৃষ্টির এই কারিগরের বিদায় নেয়ার সংবাদে সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। পাঠক থেকে শুরু করে একেবারেই সাধারণ মানুষ এ নন্দিত কথাসাহিত্যিকের চলে যাওয়ায় ভেসে যায় শোকের সাগরে। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্যের মানুষের হৃদয়ে বেঁজে ওঠে চরম বেদনার সুর। চারপাশে বয়ে যায় শুধুই শোকের স্তব্ধতা। তবে সবার শোককে ছাঁপিয়ে যায় দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা লেখকের অগণিত পাঠকের বেদনার চাঁপা আর্তনাদ। হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুতে দেশের প্রকাশনা শিল্প বড় একটা ধাক্কা খেতে পারে। কারণ দেশে প্রকাশিত গল্প- উপন্যাসের যত বই বিক্রি হয় তার ৭৫ শতাংশই হুমায়ুন আহমেদের। তার মরদেহের সাথে দেশে ফিরেছেন ভাই জাফর ইকবাল, স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন এবং অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম।