বর্ষা মৌসুমেই কদর – দক্ষিণাঞ্চলে জমে উঠেছে চাই ও নৌকার হাট – কয়েক হাজার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ বর্ষা মৌসুমে চলাচল ও পণ্য পরিবহনের জন্য দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নির্ভরযোগ্য বাহন নৌকা। এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের মৎস্য শিকারের কাজেও অন্যতম ভূমিকা রাখে নৌকা। এ মৌসুমে নৌকায় জাল, চাই (মাছ ধরার ফাঁদ) অথবা বড়শি নিয়ে মৎস্য শিকারে ছুটে চলেন জেলেরা। তাই প্রতি বছর বর্ষা এলেই বেড়ে যায় চাই ও নৌকার কদর। আর এই মৌসুমে চাই ও নৌকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এ অঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার।

জমে উঠেছে নৌকার হাট: নৌকার জন্য বিখ্যাত বরিশালের স্বরূপকাঠী উপজেলা। এছাড়া বরিশাল ও ঝালকাঠীর বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগঞ্জে নৌকা তৈরি করা হয়। জৈষ্ঠ্য থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত স্বরূপকাঠীর আটঘর, কুড়িয়ানা, ইন্দেরহাট, আগৈলঝাড়ার সাহেবেরহাট ও গৌরনদী মাহিলাড়া হাটে বসে নৌকার হাট। এসব উপজেলায় বিভিন্ন প্রজাতির শাক সবজি ও তরকারিসহ পেয়ারা এবং লেবুর ব্যাপক ফলন হয়। এসব কৃষিপণ্য বাজারে আনার জন্য ছোট যেসব খাল-বিল পার হতে হয়ে তাতে নৌকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই এসব উপজেলায় জমে উঠেছে নৌকা হাট। কুরিয়ানা বাজারে প্রতিদিন গড়ে ৫ শতাধিক নৌকা বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই বিভিন্নস্থানে চলছে নৌকা বানানোর ধুম। আগৈলঝাড়া, স্বরূপকাঠী, বানারীপাড়া উপজেলার ইন্দেরহাট, ইলুহার, আতাকোঠালী ও বৈঠাকাটা গ্রামের অসংখ্য পরিবার নৌকা তৈরির পেশায় নিয়োজিত। তারা স্বরূপকাঠী থেকে কাঠ কিনে এনে নৌকা তৈরি করে থাকেন। চাম্বল কাঠ দিয়ে ডিঙ্গি ও ছোট আকারের পিনিশ নৌকা তৈরি করা হয়। আর রেইন্ট্রি কাঠ দিয়ে তৈরি হয় কমদামি নৌকা। নৌকার ক্রেতা প্রেমানন্দ বালা জানান, শুধু বর্ষা মৌসুমে ব্যবহারের জন্য কমদামি নৌকা বেশি বিক্রি হয়ে থাকে।

ব্যস্ত চাই পল্লীর শ্রমিকেরা : মাছ ধরার চাই তৈরির জন্য বিখ্যাত আগৈলঝাড়া উপজেলার মোহনকাঠী গ্রাম। এ গ্রামে কবে কখন কে চাই তৈরি করার কাজ শুরু করেছেন তা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও প্রবীণরা জানিয়েছেন, প্রায় দু’শ বছর ধরেই এ গ্রামে চাই তৈরি ও বিক্রি চলছে। বংশ পরম্পরায় এ গ্রামের চার’শ পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে চাই তৈরি করে। গ্রামের পুরুষেরা বর্ষা মৌসুমের ছয় মাস চাই তৈরি ও শুষ্ক মৌসুমে দিনমজুরের কাজ করেন। মোহনকাঠী গ্রামের তৈরি করা চাই বিক্রি হয় দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার হাট-বাজারে। গ্রামটির নাম মোহনকাঠী হলেও চাই তৈরি করতে গিয়ে গ্রামের নাম হয়েছে ‘আগৈলঝাড়ার চাই পল্লী’। নানাবিধ সমস্যার মধ্যে বংশ পরম্পরায় এ গ্রামের বাসিন্দারা চাই তৈরির পেশাকে ধরে রেখেছেন। চাই তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ, বেত ও লতার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই অর্থাভাবে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন ও বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে টাকা এনে চাই বানাচ্ছেন। গ্রামের মাখন বৈরাগীর পুত্র দুলাল বৈরাগী বর্তমানে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। হরলাল বৈদ্ধর পুত্র প্রশান্ত বৈদ্যও স্নাতক শ্রেণীতে পড়ছেন। তারা জানান, লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের সাথে চাই বুনতে তারা সহযোগীতা করে থাকেন। শুধু দুলাল ও প্রশান্তই নয় গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনার পাশাপাশি চাই তৈরির কাজে পিতা-মাতাকে সাহায্য করে থাকে। বর্ষা মৌসুম আসলেই পরিবারের সকলের ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়।

ওই গ্রামের হরলাল বৈদ্ধ (৬৬), নলিনী বৈরাগী (৭০) সহ অনেকেই জানান, দু’শ টাকার তল্লা বাঁশ, দু’শ টাকার কৈয়া লতা দিয়ে একেকজন শ্রমিক ৫ দিনে এককুড়ি (২০টি) চাই তৈরি করতে পারেন। মহাজনদের কাছ থেকে দাদন আনার ফলে তাদের কাছে প্রতি কুড়ি চাই পাইকারি হিসেবে বিক্রি করা হয় ১২ থেকে ১৬শ’ টাকায়। বাজারে যার দাম ২ হাজার থেকে ২৫’শ টাকা। ওই গ্রামের লক্ষন বৈরাগী জানান, তাদের গ্রামের তৈরি চাই স্থানীয় মাহিলাড়া, পয়সারহাট, সাহেবেরহাট, ধামুরাসহ বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠী, ভোলা, ঘাঘর, শশীকর, নবগ্রাম, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার হাট-বাজারে বিক্রি করা হয়।

 বর্ষা মৌসুমেই কদর - দক্ষিণাঞ্চলে জমে উঠেছে চাই ও নৌকার হাট - কয়েক হাজার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ