দেশের জন্য পদ্মা সেতু : দল বা ব্যক্তির জন্য নয়

গত ২৩ জুলাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের সময় তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলেও তিনি আলোচিত হয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে। এর আগে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরও তিনি রেহাই পাননি, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুতে ঋণ বাতিল করে। এতে আবার নতুন করে আলোচনায় আসেন আবুল হোসেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ করেন তিনি। গত ২৩ জুলাই কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে আবুল হোসেনের একটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়। কেন তিনি এই খোলা চিঠিটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করলেন বোঝা গেল না। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে কিংবা সকল মিডিয়াতেই আগের দিন তা প্রচারের জন্য প্রেরণ করতে পারতেন। তাতে পত্রিকাগুলো গুরুত্ব দিয়ে চিঠিটি প্রকাশ করলে ব্যাপক পাঠক তা পড়ার সুযোগ পেত। তাতে এতদিন তার সম্পর্কে গণমাধ্যমগুলো এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব বক্তব্য একতরফাভাবে প্রচারিত হচ্ছিল সেগুলো সম্পর্কে তার বক্তব্য ও অবস্থান আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়ার বা উপস্থাপিত হওয়ার সুযোগ হতো। পত্র-পত্রিকায় তার দেয়া একটি খোলা চিঠির সংবাদের কথা শুধু বলা হয়েছে। তাতে কি লেখা হয়েছে তা জানা, খুঁজে পাওয়া, খুঁজে নেয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। অথচ যে অবস্থানে থেকে তিনি এমন একটি খোলা চিঠি দেশবাসীর জানার জন্য দিয়েছিলেন তা প্রচারের জন্য তখন গণমাধ্যমগুলো উন্মুখই ছিল। তিনি সেই সুযোগ কাজে লাগাননি। কেন লাগাননি তা তিনিই জানেন। তবে, এতদিন একতরফা নানান কথা শুনেছি, অনেকে হয়ত সেগুলোকেই বিশ্বাস করেছেন, তিলকে তাল বানিয়েও হয়ত কেউ কেউ বেচাকেনা করেছেন,

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য, ভেতরের নানা ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত, চিঠিপত্র-এগুলোর অনেক কিছুই আমাদের দেখা হয়নি, জানা হয়নি, এই প্রথম যাকে নিয়ে এত অভিযোগ, পদ্মাসেতু হবে কি হবে না, সেদিকে অনেকেরই দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার তাগিদ বোঝা যায়নি। মন্ত্রী ও সচিব দুর্নীতি করেছেন, বিশ্বব্যাংক নাকি তেমন অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ পাঠিয়েছে। সেভাবেই প্রচার-প্রচারণা, রাজনীতির মাঠ উত্তপ্তকরণ, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, টিভি চ্যানেলের সংবাদ, টকশো, চায়ের দোকানের আলাপচারিতা ইত্যাদি শুনেছি। জানি না, এসব শুনতে গিয়ে কেউ কখনও ক্লান্তি অনুভব করেছেন কিনা। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য শোনার দাবি কোনো মহল থেকেই উত্থাপিত হয়নি, তার পদত্যাগের দাবিই কেবল চারদিক থেকে করা হচ্ছিল। গণতন্ত্রে নাকি কারও বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তারপর দেখা যাবে সত্য কি মিথ্যা, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় তার বক্তব্য শোনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই তেমন কোনো নিয়মও বাংলাদেশে দেখি না, শুনি না, দাবিও করা হয় না। বেচারা সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো জবাবই এ পর্যন্ত আমাদের জানানো হলো না। এই প্রথম তিনি একটি লিখিত জবাব দিলেন। তার বক্তব্য আমার বিশ্বাস করা না করা প্রসঙ্গে এখানে কিছু বলছি না। সেটি অনেক পরের বিষয়। বলছি সৈয়দ আবুল হোসেন তার লিখিত চিঠিতে যে সব বক্তব্য দিয়েছেন তা তো গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। এটিকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তদন্তে তাকে প্রমাণ করতে হবে তার দাবি সঠিক। তিনি সেই দায়িত্ব নিয়েই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন নিশ্চয়ই। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে দেশ এবং জাতিগতভাবে আমরা কলঙ্কের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারি। তিনি তা না হতে পারলে নিজেও ডুববেন, আমাদেরও জাতিগতভাবে ডোবাবেন। কেননা, বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো প্রকল্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নয়, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়। সে কারণেই তিনি যখন এতটাই আস্থার সঙ্গে বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন, দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন তখন বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাববার যথেষ্ট অবকাশ হয়ত আছে। আমরা সেটিই দেখতে চাই। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন একটি ভাব-আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে শুধু এককভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনই অভিযুক্ত হবেন। আমরা দেশ ও জাতিগতভাবে কিছু হব না, বিষয়টি মোটেও তা নয়।

আমাদের সমালোচকদের একপেশে চিন্তাভাবনা দেখে আমি দারুণভাবে হতাশ হচ্ছি। কেননা, এই দায়টা গোটা দেশের ওপরও পড়বে। সেদিক থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পুরো ঘটনা সম্পর্কে কি বলেছেন, তিনি দুর্নীতি না হওয়া সম্পর্কে আমাদের কোনো আশার আলো ওই খোলা চিঠিতে দেখিয়েছেন কিনা সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশার কথা হচ্ছে তার চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির আশঙ্কা, পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি বাতিল ইত্যাদি বিষয় একদিন ভুল প্রমাণিত হবে। আমরাও প্রার্থনা করব তার এ দাবি শতভাগ সত্যে পরিণত হোক, জাতি হিসেবে আমরা দুর্নীতির কলঙ্ক থেকে মুক্ত হই। তার এই চিঠি একটি মস্তবড় দলিল। যেটি ঘরে ঘরে যতœ করে রাখা প্রয়োজন। সৈয়দ আবুল হোসেন পারতেন কোনো বক্তব্য না দিয়েই বিদায় নিতে, তাতে তিনি দোষী প্রমাণিত হলেও কেউ এ সবের জন্য কৈফিয়ত চাইতে পারত না। কিন্তু পদত্যাগের আগে তিনি যে খোলা চিঠি দিয়েছেন তাতে তার দায়িত্ব কিন্তু বেড়ে গেছে। তার এই অবস্থান নেয়ার ভিত্তি তিনিই ভাল বলতে পারবেন। তবে আমরা এটিকে সাধুবাদ দিতে চাই, এর প্রতিটি বাক্য যেন সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়; সেই প্রতীক্ষায় থাকব। আমাদের জন্য পদ্মাসেতুর কোনো বিকল্প নেই। সৈয়দ আবুল হোসেন বিদায় নিয়েছেন। আমরা চাইব তার খোলা চিঠির প্রতিটি বক্তব্য সত্য হোক, পদ্মাসেতু তৈরির কাজ শুরু হোক।  আর বিএনপিকে বলব, তথ্যপ্রমাণ থাকলে প্রকাশ করুন, নতুবা এ বিষয়ে চুপ থাকুন। বিএনপি নেতাদের ভাবা উচিত, আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রী বা কোনো মন্ত্রী না থাকলেও কারো কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু পদ্মা সেতু দেশের সব মানুষের জন্য দরকারি।