সৈকত গুহ পিকলু ॥ “হে মহান, মহাবীর/গর্ব তুমি বাঙালী জাতির/তুমিই তো জাতির পিতা/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।/ তুমি রবে ততদিন/বাঙালী জাতির হৃদয়ে/যতদিন তোমার অর্জিত বাংলার পতাকার/সেই লাল রক্তিম সূর্য উদ্দীপ্ত হবে/বাংলার পূর্ব আকাশে। “শেষ হোক তাদের বেঁচে থাকার দিন/ যারা অবেলায় জাতিকে করেছে পিতৃহীন।” কাঁদো, বাঙালী কাঁদো। ১৫ আগস্ট যে কাঁদারই দিন। সেদিন আকাশ কেঁদেছিল। সেদিন বাতাস কেঁদেছিল। শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখেও ছিল জল। গাছের পাতারা শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল। এসেছিল সেই ভয়াবহ দিন! চারদিকে ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন। মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তের চিহ্নসহ জনকের লাশ। ভয়ার্ত বাংলায় ছিল ঘরে ঘরে চাপা দীর্ঘশ্বাস… সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙ্গা ওই পতাকায়, সেই শোক অনির্বাণ এখনও বাংলায়। নদীর স্রোতের মতো চির বহমান, কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। ১৫ আগস্ট সেই অনত্মিম শোকার্ত বাণী পাঠের দিন। রক্তঝরা ১৫ আগস্ট। বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন। বিভিন্ন কবির অসংখ্য কবিতার লেখায় উঠে আসা সেই ধন্যপুরুষ স্বাধীন বাংলার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩৭তম শাহাদাতবার্ষিকী। বাংলাদেশ ও বাঙালীর জন্য গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। কলঙ্কমুক্ত বাঙালী জাতি ১৫ আগস্ট গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করবে। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ তিনি, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকেই আগস্ট আর শ্রাবণ যেন মিলেমিশে শোকে একাকার। এদের রোদ-বৃষ্টি, আলো-বাতাস নিসর্গ প্রকৃতিও যেন বিনম্র শ্রদ্ধায় তার নামের ওপর ঢেলে দেয় রৌদ্র-জ্যোৎস্না, আকাশের চোখে জল ঝরে তারই বিয়োগব্যাথায়। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনদিন ছিন্ন হবার নয়। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দরিদ্র নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা বিরল। একজন প্রকৃত নেতার যে গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, তার সব গুণ নিয়েই জন্মেছিলেন এ মহাপুরুষ। যার রাজনৈতিক জীবন ছিল বহু বর্ণিল, যার কণ্ঠে ছিল জাদু। যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস। এতকিছুর পরও শেষ পর্যন্ত তাকে জীবন দিতে হয়েছে ঘাতকের হাতে।
৩৭ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালিমাময় দিনে জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানকে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য সর্বনাশা চক্রান্তে একদল ঘাতকের পৈশাচিকতার বলি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজন। রচিত হয় ইতিহাসের কলঙ্কিত একটি অধ্যায়। কিন্তু তাতে তো এমন একজন রাষ্ট্রনায়ককে একটি জাতির হৃদয় থেকে চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন প্রতিটি উৎসবে, আনন্দ-বেদনায়। তিনি যে মৃত্যুঞ্জয়ী। রাজনীতির সঙ্গে সামান্যতম সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও নারী-শিশুরাও সেদিন রেহাই পায়নি ঘৃণ্য কাপুরুষ ঘাতকচক্রের হাত থেকে। বিদেশে থাকার জন্য প্রাণে বেঁচে যান কেবল বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৫ আগস্টের দিনটি তাই বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত। জাতীয় শোক দিবসে বাঙালী গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী। এ বছর ১৫ আগস্ট এসেছে একটি ভিন্ন আবহে, ভিন্ন অবয়বে। বাংলাদেশের স্থপতির নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার পেতে বাঙালী জাতিকে ৩৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রতি পদে খুনীদের দোসর ও মদদদানকারী সরকারের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালে আটকে থেকেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাযজ্ঞের বিচার। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে মানবতার শত্র“ নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বাঙালী জাতি পিতৃহত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়। যারা এক সময় নিজেদের বিচারের উর্ধ্বে ভেবেছিল এবং তাদের কেউ স্পর্শ করতে পারবে না বলে দম্ভ করেছিল; এ বিচার ও দন্ডাদেশ কার্যকর করার ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে বাংলার মাটিতে কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়। আর বিচারের দীর্ঘতম প্রক্রিয়া শেষে রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের অত্যন্ত মর্মস্পর্শী করুণ এক অধ্যায়ের। কিন্তু এখনও বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনী বিদেশে পলাতক রয়েছে। ওই পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর এবং যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার নিয়ে কলঙ্কমুক্ত বাঙালী জাতি এবার শোক দিবস পালন করবে। এ বছর অন্যরকম পরিবেশে শোক দিবস পালনে এবারের প্রস্তুতিও ব্যাপক। হাজার হাজার শোকের তোরণ, কালো ব্যানার, পতাকা, ফেস্টুন, পোস্টারে ছেয়ে যাবে দেশের পথ-প্রান্তর। পঁচাত্তর পরবর্তী সারাদেশেই প্রতিটি মোড়ে মোড়ে, গ্রাম-মহল্লায়, হাটে-বাজারে কৃতজ্ঞ বাঙালীর শোক পালনের ব্যাপক আয়োজন করা হবে। শুধু আওয়ামীলীগই নয়, সারাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ, সংগঠন এবার বিস্তারিত কর্মসূচীর মাধ্যমে স্মরণ করবেন স্বাধীনতার এ মহান স্থপতিকে।
লেখক : চেয়ারম্যান-মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদ, আহবায়ক-বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড গৌরনদী উপজেলা শাখা ও উপজেলা যুবলীগ নেতা, গৌরনদী, বরিশাল।
(চলবে)