বরিশালের রাক্ষুসি সন্ধ্যা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন – বীরশ্রেষ্ঠ লঞ্চ ঘাটের দশটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন

খোকন আহম্মেদ হীরা, রহিমগঞ্জ থেকে ফিরে ॥ রাক্ষুসি সন্ধ্যা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (রহিমগঞ্জ) লঞ্চ ঘাটের দশটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও একটি মসজিদ শুক্রবার সন্ধ্যায় আকস্মিক ভাবে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া নদী ভাঙ্গনের হুমকির মুখে রয়েছে একই এলাকার ৯টি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও একটি যাত্রী ছাউনি। গ্রাস করে নেয়া ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান রক্ষা করতে গিয়ে কমপক্ষে ১০জন আহত হয়েছে। এতে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সরেজমিনে জানা গেছে, বাবুগঞ্জ উপজেলার সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গন ভয়াবহ রুপ ধারন করায় গত শুক্রবার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সন্ধ্যা নদীর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (রহিমগঞ্জ) লঞ্চ ঘাটের কামাল সরদারের মুদি-মনোহরী, স্বাধীন সরদারের চায়ের দোকান, ছিদ্দিক খান, ছালাম হাওলাদার, মামুন হাওলাদার, সেকান্দার আলী সরদার, মান্নান সিকদারের মুদি, জামাল মোল্লার মিষ্টির দোকান, দুলাল হাওলাদারের ঔষধের ফার্মেসী ও মিল্টন বেপারীর কসমেটিক্সের দোকান, লঞ্চ ঘাটের একটি মসজিদসহ স্থানীয় ব্যবসায়ী অহিদুজ্জামান মিরনের ব্যবসার জন্য রাখা ইট-বালু মুহুর্তের মধ্যে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এছাড়াও পুরো লঞ্চ ঘাট এলাকায় বড় ধরনের ফাঁটল দেখা দেয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে লঞ্চ ঘাট এলাকার রিয়াদ রহমান কাজলের পোল্টি ফিড, সাহাবুদ্দিন হাওলাদারের সার ও কীটনাশক, মিরনের স্ব-মিল, নুর আলম চৌকিদারের চায়ের দোকান, জব্বার চৌকিদারের মুদি, দুলাল চৌকিদারের মাছের আড়ৎ, সুলতান সিকদারের কাঁচামালের দোকানসহ লঞ্চ ঘাটের যাত্রীদের একমাত্র যাত্রীছাউনীটি। পুরো লঞ্চ ঘাট এলাকায় বড় ধরনের ফাঁটল দেখা দেয়ার পর গতকাল শনিবার সকাল থেকে লঞ্চ ঘাট এলাকার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা স্থানীয়দের সহায়তায় দোকান ঘর ভেঙ্গে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
 
অপরদিকে সন্ধ্যা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনের খবর পেয়ে গতকাল শনিবার সকালে বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (সাবেক আগরপুর) ইউনিয়নের সাবেক চেয়াম্যান সরদার খালেদ হোসেন স্বপন, ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারন সম্পাদক উপেন চন্দ্র মন্ডলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিকদলের নেতা-কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেন। তারা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের সাধ্যমতো সহযোগীতা করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী ও রহিমগঞ্জ গ্রামের রতন সরদারের পুত্র কামাল সরদার (৪২) বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোন ও স্থানীয় ভাবে প্রায় দু’লক্ষাধিক টাকা ঋণ নিয়ে একটি মুদি এবং একটি চায়ের দোকান করেছিলাম। মোর ছয় সদস্যর পরিবারে এই দোকানই ছিলো একমাত্র আয়ের উৎস।  রাক্ষুসী সন্ধ্যা নদী শুক্রবার রাতে মোর সব শেষ করে দিয়ে গেছে। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরেন কামাল সরদার। অপর ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী জামাল মোল্লা, সেকান্দার সরদার, ছিদ্দিক খানসহ অনেকেই বলেন, রাক্ষুসী এ সন্ধ্যা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে গত কয়েক বছরে নিঃস্ব হয়েছেন এ উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার। প্রতি বছরই সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী, এমপি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনে এসে শুধু সাধারন মানুষদের কাছে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধের আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু এ আশ্বাস শুধু মুখেই থেকে যায় বাস্তবে এর কিছুই হচ্ছেনা।
সূত্রমতে, বাবুগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আড়িয়াল খাঁ, সুগন্ধা ও সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনের ফলে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নই নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হচ্ছে। বিগত ৮০ দশক থেকে নদী ভাঙ্গনের ফলে উপজেলার মানচিত্র ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের রফিয়াদী, কুমারিয়ার পিট, কোলচর, নমরহাট, রহমতপুর ইউনিয়নের, মীরগঞ্জ বাজার, লোহালিয়া, রাজগুরু, নুতনচর রাজগুরু, ক্ষুদ্রকাঠী, মানিককাঠী, দোয়ারিকা, বাহেরচর, ঘোষকাঠী, রাকুদিয়া, রাহুতকাঠী, ছানি কেদারপুর, কেদারপুর, মোল্লারহাট, ভাঙ্গার মুখ, লাশঘাটা, রহিমগঞ্জ এলাকার হাজার-হাজার মানুষ নদী ভাঙ্গনের ফলে গৃহহীন হয়ে পরেছে। অনেকেই ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকে আবার সড়কের পাশে পলিথিনের চালা দিয়ে খুঁপরি ঘর বানিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। একইসাথে বসতবাড়ির পাশাপাশি কয়েক হাজার আবাদি জমি, গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে গেছে কয়েক হাজার পরিবার। রাক্ষুসি তিনটি নদী শুধু ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি, কেড়ে নিয়েছে এ উপজেলার কয়েক শতাধিক মানুষের প্রান।

বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক সরদার খালিদ হাসান স্বপন জানান, রাক্ষুসি নদীগুলোর তান্ডবে মীরগঞ্জ বাজার, ফেরিঘাট, বরিশাল বিমান বন্দর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (দোয়ারিকা) সেতু, আবুল কালাম ডিগ্রী কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগার এখন চরম হুমকির মুখে রয়েছে। যেকোন মুহুর্তে এসব সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলো রাক্ষুসি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সূত্রে আরো জানা গেছে, ২০১১ সনে বর্তমান সরকারের পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব মাহাবুবুল হক তালুকদার স্প্রীড বোর্ডযোগে সুগন্ধা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। ওইসময় তিনি জরুরি ভিত্তিতে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধের ব্যবস্তা নেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্বাসের বানী আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছর তিনটি নদীর ভাঙ্গনের তীব্রতা বিগত বছরের তুলনায় অনেকাংশে বেড়ে গেছে। এরইমধ্যে গত ৬ জুলাই ভোরে আকস্মিক ভাবে আড়িয়াল খাঁ নদীর মীরগঞ্জ বাজার সংলগ্ন এলাকার চারটি বসতঘর নদী গর্ভে বিলিনসহ আনোয়ার হোসেন নামের এক যুবকের মৃত্যুতে নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার সাধারন মানুষের মধ্যে চরম আতংক বিরাজ করছে। ফলে বর্তমানে তাদের দিন-রাত কাটছে নির্ঘুম ও চরম আতংকে। নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার লোকজনেরা ইতোমধ্যে বসত বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে শুরু করেছে।

বরিশালের রাক্ষুসি সন্ধ্যা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন - বীরশ্রেষ্ঠ লঞ্চ ঘাটের দশটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন