আমরা ও আমাদের দেশ – দুর্নীতির বাংলাদেশ

মাহবুবুর রহমান গুঞ্জন ॥ আমাদের দেশের প্রায় কোনো প্রতিষ্ঠানই যথাযথভাবে চলে না। একটা না একটা গণ্ডগোল লেগেই থাকে। সরকারী দপ্তরগুলিতে ফাইলের পাহাড় জমে আছে, দেখার কেউ নেই। বাস্তবের পাহাড়-টিলাগুলিকে কাটার জন্য আমরা উঠে পড়ে লেগে যাই, আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে তোয়াক্কা না করে প্রয়োজনে কনকনে শীত কিংবা ঝড়বৃষ্টির রাতে বুলডোজার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি পাহাড় ধ্বংসে, বাস্তবে একটা কোনো সরকারী দপ্তরেও ফাইলের পাহাড় সরানোয় কারো আগ্রহ নেই। আর অযোগ্যতা কিংবা কর্তব্যে অবহেলার ‘প্রকৃত’ অভিযোগে কোনোদিন কোনো সরকারী কর্মকর্তার বিচার হয়েছে কিংবা তিনি স্বীয় পদ হতে অপসারিত হয়েছেন – এমনটা চোখে পড়ে না।

সরকার বদলের সাথে সাথে নিয়ম করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়। মাস ছয়েকের ভেতরেই ছাত্র-শিক্ষক সবাই বুঝতে পারেন, এই উপাচার্য দিয়ে চলছে না। শুরু হয় আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াও-গাড়ি ভাঙো, ক্লাস বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ, সেশন জট, ভর্তি জট। এই করে বছর খানেক চলে যায়, ভিসির পদত্যাগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এক সময় ক্যাম্পাসে পুলিশ আসে, সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়, দু-একজন মারা যায়, উভয়পক্ষ দাবী করে মৃত ব্যক্তি তাদের দলের কর্মী। ততক্ষণে সরকারে বসে থাকা মানুষগুলি নতুন একটি মেরুদন্ডহীন অধ্যাপক খুঁজে বের করে ফেলেন উপাচার্য পদের জন্য। ফলে উপাচার্যের নাম বদল হয়, চরিত্র একই থেকে যায়। আন্দোলনকারীদের জেহাদী জোশ ততদিনে শেষ হয়ে গেছে, তারা নতুন করে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করার চেয়ে এই এক-দেড় বছরের সেশন জট কী করে সামলে নেয়া যায়, তা নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন।

মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, কেউ তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। দেশের মানুষের এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে। তারা জানে, বটি’র উপর লাউ কিংবা লাউয়ের উপর বটি – যেভাবেই রাখা হোক, শেষ পর্যন্ত লাউটাই কাটা যাবে। ফলে এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্চ করে না। এবার বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলিও যখন ধাক্কাধাক্কি শুরু করে, তখন পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেন না, বরং অভিযুক্তদের বাঁচাতে, অভিযোগ ব্যর্থ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যান। তাতেও যখন শেষরক্ষা হয় না, তখন বড় জোর তাঁদের বলা হয় পদত্যাগ করতে এবং তাঁরা পদত্যাগ করার পরও সেই পদত্যাগপত্র মন্ত্রণালয় থেকে বঙ্গভবন যেতে এক মাসের বেশি লেগে যায়। বঙ্গভবনে সেটা গৃহীত হলেও তাঁরা কেবল সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অপসারিত হন, মন্ত্রীসভায় ঠিকই তাঁদের দাপট চলতে থাকে, সরকারী বেতন ভাতাও ঠিকঠাকমতো ব্যাংক একাউন্টে জমা হতে থাকে।

পুলিশ সন্ত্রাসী ধরতে গিয়ে নিরীহ জনগণকে আটক করছে, পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে পা কেটে ফেলতে বাধ্য করছে, চোখে আঙুল দিয়ে ভুল দেখিয়ে দেবার পরও দোষ স্বীকার না করে উল্টো ভিকটিমের পুরো পরিবারকে দাগী সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে মামলা করছে, ভরা বাজারে আসামীকে আটক করে থানায় নেয়ার পথে প্রতিপক্ষের খুনীদের কাছে মোটা টাকার বিনিময়ে ‘বেচে দিচ্ছে’, থানা হাজত থেকে আসামীকে ধরে নিয়ে দাগী সন্ত্রাসী পরিচয় দিয়ে ভরা বাজারে ছেড়ে দিয়ে মারমুখী জনতাকে লেলিয়ে দিচ্ছে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলার জন্য… কোনো অভিযোগেরই কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তাকে কখনো বরখাস্ত করা হচ্ছে না, শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। কেউ পদত্যাগও করছে না।

দায়িত্বে অবহেলা, দায়িত্ব সম্পাদনে ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, বরখাস্ত, অপসারণ, পদত্যাগ এসব বিষয় আমাদের দেশে সরকারী বেসরকারী কোনো পর্যায়েই দৃশ্যমান নয়।

ব্যাতিক্রম কেবল একটা জায়গায়। জাতীয় ক্রিকেট দল। এই দলের নেতৃত্বের পদটিতে কত সহজেই পরিবর্তন করা যায়! দল বিদেশে গেল খেলতে, ম্যাচ হেরে আসলো, দাও অধিনায়ককে সরিয়ে। অমুক ব্যাটসম্যান পর পর দু ম্যাচে পঞ্চাশের কম রান করলো, দাও তাকে বসিয়ে। তমুক বোলার সফরকারী দলের সদস্য (কী ভূমিকায়, তা আল্লাহ মালুম) মন্ত্রী সাহেবের চাচাতো শ্যালকের সাথে নাইট ক্লাবে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে? এই সরকারের আমলে এই ‘ক্ষ্যাত’ বোলার যেন আর দলে না ঢুকতে পারে! … বাংলাদেশ দল কোনো ম্যাচ খেলতে নামলেই খেলোয়াড়দের চেয়েও টানটান অবস্থায় চলে যান সমর্থকরা। সবাই আতঙ্কে থাকেন, কার ভুলে কখন যে কাকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়! প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আমাদের বোর্ড কর্তাদের মাথায় কোনো এক অজ্ঞাত উপায়ে ঢুকে গেছে যে, অধিনায়ক পাল্টালেই দল বদলে যাবে, দলের পারফর্মেন্স বদলে যাবে, দলটা খুব শাদামাটা অবস্থা থেকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে।

সুখের কথা, এই অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। বছর খানেক (নাকি তারও বেশি?) ধরে একজন অধিনায়কের অধীনেই মোটামুটি একটা নিয়মিত একাদশ দেখা যাচ্ছে। এবং তার ফলও পাওয়া যাচ্ছে হাতে নাতেই, আমাদের এই দলটা এখন এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা ওয়ানডে দল, সেরাদের সাথে যে দলের কোনোই পার্থক্য নেই, তাদের চেয়ে মোটেই পিছিয়ে নেই। নেহায়েত ক্রিকেটিয় অনিশ্চয়তার কারণেই আমাদেরকে রানার্স আপের আসনে বসতে হচ্ছে। আর শুধু এশিয়াতেই কেন, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলগুলিও এখন আমাদেরকে হারানোর জন্য হোম কন্ডিশন কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে পড়েছে! বিশ্বসেরা হতেই বা আমাদের দেরি কী? এই দলের একজন অপরিহার্য খেলোয়াড় তো প্রায় তিন বছর ধরেই বিশ্বসেরার আসনে বসে থেকে রেকর্ড করে ফেলেছেন! এত দীর্ঘ সময় ধরে সেরা অলরাউন্ডার নির্বাচিত হবার কথা এমনকি ইমরান, কপিল, বোথামরাও ভাবতে পারতেন কিনা সন্দেহ! এই সব কিছুই সম্ভব হচ্ছে কিন্তু ওই একটা কারণেই, দলটার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আছে, তারা যোগ্য নেতৃত্বে, সঠিক পথেই চলেছে। এখানে কেউ এক ম্যাচের জন্য একাদশের বাইরে যাওয়া মানে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং নিজেকে ঝালিয়ে নিয়ে নতুন চেহারায় ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া।

আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না এশিয়া কাপের ফাইনালের শেষ বলটি হয়ে যাবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ক্যাপ্টেন মুশফিকুর রহিমের সেই ঐতিহাসিক কান্না। এটা পরাজয়ের কান্না নয়। এটা খুব কাছে গিয়ে ট্রফিটা না ছুঁয়েই ফিরে আসার কান্না নয়। এই কান্না ক্রিকেটের প্রতি বাংলাদেশের কমিটমেন্টের জ্বলজ্বলে প্রমাণ। এই কান্না ক্রিকেটকে বাংলাদেশের উদাত্ত হয়ে, উজাড় করে ঢেলে দিতে চাওয়ার নমুনা। বাংলাদেশ কোনো দিন ক্রিকেটকে বেচবে না, সারা জীবন ক্রিকেট আমাদের প্যাশন হয়ে থাকবে – এ কান্না তারই পরিচয়। যে অধিনায়ক স্বপ্ন থেকে বাস্তবের কাছাকাছি গিয়েও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় এভাবে মূহ্যমান হতে পারেন, এবং সেই কষ্টকে লুকিয়ে রাখার মতো ভণ্ডামী করেন না, বাংলাদেশের ক্রিকেট তাঁর হাতেই সবচেয়ে নিরাপদ, সবচেয়ে আস্থাবান, সবচেয়ে নিশ্চিন্ত এবং সবচেয়ে লক্ষ্যাভিমুখী।

সামনে আরেকটা বিশ্বকাপ আসন্ন। সবচেয়ে গোলমেলে জাতের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ। হচ্ছেও এমন একটি দেশে, যে দেশের চার দিকে সমুদ্র, চার দিকেই পানি। জোয়ার-ভাটার দেশ। ক্রিকেটে জোয়ার-ভাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন স্টেডিয়ামের পিচ জোয়ারের সময় এক রকম, ভাটার সময় আরেক রকম। কখনও বোলারকে সাহায্য করছে, তো কখনও ব্যাটসম্যানকে। পিচ ছাড়াও আছে বৃষ্টি। হোম কন্ডিশনের সুবিধা-অসুবিধা। নানান হিসাব-নিকাশের বিষয়। মাত্র বিশটা ওভারের ইনিংসে এত হিসাব মিলিয়ে খেলা এমনকি অসি সিংহদের পক্ষেও সম্ভব হয় না। তাই তারা খোলাখুলিই বলে ফেলেছে, ক্রিকেটের এই ধারাটা তারা এখনো ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না। অসি’রা যা বোঝে না, আমরাও যে তা বুঝবো না, তাও না। তবে যদি না বুঝি, সেটা দোষের না। তাই সামর্থ অনুযায়ী টি-টুয়েন্টিতে ফলাফল আসবেই এমনটা দাবী করা আদৌ উচিত হবে না। সেটা মনে করিয়ে দিতেই এত দীর্ঘ একটা লেখা ফেঁদে বসলাম। আমাদের ক্রিকেট কর্তারা তো আবার অন্যগ্রহের এক্সপার্টিজ নিয়ে চলেন। ফলে ক্রিকেট নামক খেলাটার প্রশাসক হতে তাঁদের ক্রিকেটীয় হিসাব-নিকাশের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। দেশের কোনো দপ্তরে কারুর অযোগ্যতা-ব্যর্থতা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না, শুধু ক্রিকেট দলের ব্যর্থতাই হল অমার্জনীয় অপরাধ! যেন ক্রিকেট হলো দুইয়ের ঘরের নামতা, দুই দু’গুণে অবশ্যই চার হতে হবে, তিন দু’গুণে ছয়। দুটো বল খেললে একটা চার মারতেই হবে, ছটা বল করলে তিনটা উইকেট কেন নিতে পারবে না?

আমি আশায় বুক বেঁধে আছি, আসন্ন টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে আমরা ভালো করবো। প্রথম রাউন্ড পার হবো, এমনকি ফাইনালেরও একটা পক্ষ হয়ে গেলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। কিন্তু যদি কোনো কারণে তা না’ই হয়, তার পরও এই দলটির প্রতিই আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে। আমি জানি, কেবল আমি নই, আমার মতো বাংলাদেশের সমস্ত ক্রিকেট ভক্ত জনগণেরই তা থাকবে। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, টপ অর্ডার-মিডল অর্ডার-লোয়ার অর্ডার-টেল এন্ড, ফার্স্ট বোলার-থার্ড সিমার-লেগ ব্রেক-অফ ব্রেক-বাঁহাতি স্পিনার, শর্ট-লং-সিলি-মিড অন-মিড অফ-স্লিপ-গালি-কাভার, উইকেট কিপিং, ক্যাপ্টেন্সি … সব কিছু পার্ফেক্ট। একদম পার্ফেক্ট। ম্যাচ জিতলে তো বটেই, ম্যাচ না জিতলেও পার্ফেক্ট। এর চেয়ে ভালো দল এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের ভেতর থেকে খুঁজে বের করে আনা সম্ভব নয়। তাই বিশ্বকাপে আমাদের দলের ফলাফল যা-ই হোক, অন্তত দলটিকে ভাংচুর করে নষ্ট করবেন না – এই আমাদের আঁকূল আবেদন।

রাষ্ট্রযন্ত্রে যাঁরা বসে থাকেন, তাঁরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন। অসাধারণ মানুষ বলেই খুব সাধারণ বিষয়গুলি তাঁদের মাথায় ঢোকে না। অন্তত এই বিষয়টি তাঁরা বুঝতে পারলে সেটিই হবে অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়া। আর কিছু না।

লেখক : www.FB.com/chowdhryg