ব্যাংকের সিকিউরিটি অফিসার থেকে কোটিপতি – অবশেষে র‌্যাবের জালে প্রতারক ফারুক

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ একটি ব্যাংকের সিকিউরিটি অফিসার থেকে প্রতারনার মাধ্যমে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শোলক ইউনিয়নের চিহ্নিত অস্ত্র ও জাল টাকার ব্যবসায়ী ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন হাওলাদার (২৭)। দীর্ঘদিন থেকে প্রতারক ফারুক দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মনাম ব্যবহার করে প্রতারনার মাধ্যমে কখনও নিজেকে জ্বিনের বাদশা আবার কখনও কোটিপতি পরিচয় দিয়ে প্রতারনা করে আসছিলো।

অস্ত্র ও জাল টাকার ব্যবসার পাশাপাশি নিজে নারী সেজে অথবা মোবাইল ফোনে নারী কন্ঠে কথা বলে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব কেড়ে নেয়াই ছিলো ফারুকের কাজ। জমি বিক্রির কথা বলে প্রতারনার মাধ্যমে সে হাতিয়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। এমনকি তার অধিনস্থ এক সিকিউরিটির কিডনী পর্যন্ত বিক্রি করতে ফারুক দিদ্ধাবোধ করেনি। এছাড়াও প্রবাসীর স্ত্রীদের ব্লাকমেইল করে তাদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করাসহ সমকামিতার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ফারুকের বিরুদ্ধে। নিষিদ্ধ ঘোষিত সর্বহারা দলের সাথে ফারুকের ছিলো গভীর সখ্যতা। তাই তার ভয়ে এলাকার কেহ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। অবশেষে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বরিশাল র‌্যাব-৮ এর সদস্যদের হাতে আটক হয়েছে দুর্ধর্ষ প্রতারক ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন ও তার এক সহযোগী। এসময় র‌্যাব সদস্যরা তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকার জাল নোট উদ্ধার করে। র‌্যাবের গোয়েন্দা টিমের ১৫ দিনের অভিযানের পর পালিয়ে ঢাকা যাওয়ার সময় সোমবার (১০ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে র‌্যাব -৮’র সিপিসি-১ কমান্ডার মেজর রাশেদুল হক খানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ধামুরা বন্দর থেকে প্রতারক ফারুককে ৫০ হাজার টাকার জালনোটসহ আটক করা হয়। এসময় ফারুকের সাথে আটক করা হয় তার (ফারুকের) ঘনিষ্ঠ সহযোগী রফিকুল ইসলাম হৃদয়কে। র‌্যাবের হাতে ফারুক আটক হওয়ার পর তার অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে ভুক্তভোগীরা।

উজিরপুর সদরের বাসিন্দা ও সাবেক সেনা সদস্য সোহরাব হোসেন জানান, প্রাইম ব্যাংকের টাঙ্গাইল শাখায় ফারুক সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার অধিনস্থ সিকিউরিটি মেহেদীর মাধ্যমে ফারুকের সাথে তার (সোহরাব হোসেনের) পরিচয় হয়। কিছুদিন পর মেহেদীকে প্রতারনার ফাঁদে ফেলে ফারুক ভারতে নিয়ে তার (মেহেদীর) কিডনী বিক্রি করে দেয়। পরবর্তীতে মেহেদী মারা যায়। এরপর ফারুক টার্গেট করে সোহরাবকে। টাঙ্গাইলে গিয়ে সোহরাবের বাসায় কিছুদিন বসবাস করে। তখন নানা অজুহাতে তার কাছ থেকে ফারুক কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর গাজিপুরের কোনাবাড়িতে ফারুক তার জমি বিক্রির কথা বলে সোহরাব হোসেনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ১১ লক্ষ টাকা। সোহরাব হোসেন আরো জানায়, তার সৈনিক জীবনের অর্জিত সকল টাকাসহ পেনশনের টাকা ও স্ত্রীর স্বর্ণালংকার তুলে দেয়া হয়েছে প্রতারক ফারুকের হাতে। তখন সোহরাব জানতেন না ফারুক একজন ইউপি সদস্য। পরবর্তীতে মেহেদীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে সে জানতে পারেন ফারুক নিজ এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
নিহত মেহেদীর খালু ফারুক মৃধা অভিযোগ করেন, ফারুক প্রতারনার মাধ্যমে ভারতে নিয়ে মেহেদীর কিডনী বিক্রি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। পরবর্তীতে মেহেদী মারা গেলেও ফারুকের ভয়ে দারিদ্র মেহেদীর পরিবারের কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক ফারুক নিজ এলাকার এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ব্লাকমেইল করে তার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করে। এছাড়াও সমকামিতার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ফারুকের বিরুদ্ধে। এক ইউপি চেয়ারম্যানের পুত্রের সাথে সমকামিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠায় চেয়ারম্যান ফারুককে শ্বাসিয়ে দেয়া ওই চেয়ারম্যানকে ১০টি মিথ্যে মামলায় আসামি করে কারাগারে পাঠিয়েছে ফারুক। ফারুকের অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই সে থানা পুলিশের সহায়তায় মিথ্যা মামলায় দিয়ে হয়রানি ও ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে হুমকি ও নির্যাতন করে আসছিলো। তার ভয়ে ইউপি চেয়ারম্যানতো দূরের কথা উপজেলা চেয়ারম্যান পর্যন্ত কোনদিন প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি।
উজিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বাদল জানান, থানা পুলিশ থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ ঘোষিত সর্বহারা সদস্য ও সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবে এলাকায় ফারুকের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। নিজে অস্ত্র ও জাল টাকার ব্যবসা করার কারনে তার ভয়ে কেউ কখনো প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। তার বিরুদ্ধে টু-টা শব্দ করলেই মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হতো। ইতিপূর্বে ওই ইউনিয়নের সকল ইউপি সদস্যরা একত্রিত ভাবে ফারুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবরে রেজুলেশনের মাধ্যমে আবেদন করলেও ফারুকের প্রভাবে তা আর দাখিল করতে পারেননি। সূত্রে আরো জানা গেছে, প্রতারনার মাধ্যমে ফারুক রাতারাতি ব্যাংকের সিকিউরিটি অফিসার থেকে কোটি পতি বনে গেছেন।

সোমবার (১০ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে প্রতারক ফারুক হোসেন র‌্যাবের অভিযানে আটক হওয়ার পর মঙ্গলবার দিনভর র‌্যাব কার্যালয়ে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন র‌্যাব-৮’র সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর সাব্বির আহমেদ ওসমানী। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত ফারুক হোসেনের শারিরিক গঠন অনেকটা হিজড়াদের মতো। সে নারী ও পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করলেও সারাদেশে জাল টাকার ব্যবসার সাথে তার বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। কিছুদিন পূর্বে ওই এলাকা (ধামুরা) থেকে মতিন নামের এক ব্যক্তিকে ১৫ হাজার টাকার জাল নোটসহ আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে তার গডফাদার হিসেবে ফারুকের নাম র‌্যাবকে জানিয়েছে। সে অনুযায়ি ১৫ দিন ধরে র‌্যাবের গোয়েন্দা টিম ফারুকের গতিবিধি লক্ষ্য করে আসছিলো। শেষ পর্যন্ত ফারুক ব্যবসা স্থানান্তরের জন্য ঢাকায় বাসা ভাড়া করে। মঙ্গলবার ফারুক তার তল্পিতল্পাসহ ঢাকায় চলে যাওয়ার খবর পেয়ে র‌্যাব আগেরদিন রাতেই (সোমবার) ওই এলাকায় অভিযান চালায়। ওইদিন গভীর রাতে ফারুক ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রফিকুল ইসলাম হৃদয়কে ধামুরা বন্দর থেকে আটক করে তার (ফারুকের) বসত ঘরে র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালায়। এসময় ওই ঘরে র‌্যার সদস্যরা অস্ত্রের সন্ধান না পেলেও নগদ ৫০ হাজার টাকার জালনোট উদ্ধার করে।

এ ব্যাপারে উজিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি আনোয়ার হোসেন জানান, ফারুক হোসেন হাওলাদার আন্তর্জাতিক মানের প্রতারক। মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ও আদালতে একাধিক মামলা পরিচালনা করে সে স্থানীয় ভাবে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। জনপ্রতিনিধি হওয়ার পাশাপাশি অপরাধ জগতের গডফাদার হওয়ায় ফারুক মেম্বরের ভয়ে কখনো কেউ থানায় কোন অভিযোগ না করায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। র‌্যাব-৮ জাল টাকার ঘটনায় বাদি হয়ে মঙ্গলবার রাতে মামলা দায়ের করেছেন। ওসি আরো জানায়, ফারুকের প্রতারনা শিকার টাঙ্গাইলের সোহরাব হোসেন, মেহেদী বা প্রবাসীর স্ত্রী মামলা দায়ের করতে চাইলে পুলিশ মামলা গ্রহন করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের আইনী সহায়তা প্রদান করবে।