শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা – সন্ত্রাস মুক্ত সমাজ গঠনে দেবী দুর্গার আদর্শ

সৈকত গুহ পিকলু ॥ দুর্গাপূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এর রয়েছে বিশ্বজনীন আবেদন এবং সকল সমাজে অশুভকে পরাজিত করে শুভর জয় নিশ্চিত করার সুমহান আদর্শ। দেবী দুর্গা আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বর্গের ক্ষমতাচ্যুত ও নিষ্পেষিত সুর দেবতাদের সুরক্ষা, শান্তি ও মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। অসুর শক্তি শুভ শক্তিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলে নিয়ে অত্যাচার, ত্রাস, বিভীষিকা, আতঙ্ক ও হুমকির রাজত্ব কায়েম করেছিল। এ অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন ও সন্ত্রাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য শান্তি প্রত্যাশী সুর দেবতাগণ সর্বশক্তি দিয়ে এমন এক মহাশক্তির প্রার্থনা ও হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন যার মাধ্যমে অশুভ-অকল্যাণ ও অশান্তির অবসান ঘটে। অবশেষে দেবী দুর্গা মহাশক্তি ধারণ করে অসুর বধ করেন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি, অনৈক্য-বিভেদ-অশান্তি থেকে আত্মরক্ষা, সন্ত্রাস-হুমকি ও নৈরাজ্য দূরে করে শক্তি-সাহস-অভয়-শান্তি-আনন্দ প্রতিষ্ঠার মানবীয় আদর্শ ও প্রেরণা হলেন দেবী দুর্গা। তাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী, দশভুজা, মঙ্গলময়ী, শক্তিদায়িনী, পরমাপ্রকৃতি, আদ্যশক্তি ও স্নেহময়ী মা। জীবসমূহের দুর্গতি দূর করার জন্য আবির্ভূত হন দুর্গা। দেবী দুর্গা কৈলাশ থেকে মর্ত্যলোকে আসেন তিন ঋতুতে। এজন্য তাকে তিনি নামে অভিহিত করা হয়। শরৎকালে তার আবির্ভাব ঘটে বলে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। একে অকালবোধনও বলা হয়। বসন্তকালে তার আগমন ঘটে বলে অনুষ্ঠিত হয় বাসন্তী পূজা। আবার ক্যাত্যায়নী নামেও তিনি অভিহিত হন। দেবী দুর্গার সঙ্গে থাকে দশপ্রহরণধারিণী সিংহবাহিনী। ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী, দেব সেনানায়ক কার্তিক ও সিদ্ধিদাতা গণেশ। তারা সকলেই দেবীর সঙ্গে পূজিত। দেবী দুর্গার পায়ের তলায় থাকে অশুভ শক্তির প্রতীক পরাজিত অসুর। সর্বোচ্চ অবস্থানে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর পূর্ণাঙ্গ রূপের সঙ্গে তুলনা করা হয় দুর্গার এ বিশিষ্ট রূপ ও অবস্থানকে। দুর্গাপূজার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। জাতীয় জীবনে এর রয়েছে সর্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির মিলনোৎসব হিসেবে গুরুত্ব। ভক্ত ও পূজারিগণ এরথেকে পান আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা। মহামিলনের আনন্দ-পরিসরে আমরা মেতে উঠি মন্দিরাঙ্গনে। মার্কন্ডেয় পুরানের চণ্ডীগ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। চণ্ডীগ্রন্থের প্রথমাংশে আছে মধু কৈটব বধ, মধ্যমাংশে আছে মহিষাসুর বধ আর শেষাংশে আছে শম্ভু নিশম্ভ বধের বিস্তৃত কাহিনি। এসব অসুর বধের কাহিনীই বর্তমানে সন্ত্রাসীদের তথা অপশক্তিকে পরাজিত করার প্রেরণা। সত্যযুগে রাজা সুরথ রাজ্যচ্যুত হয়ে মহাসঙ্কটে পড়েন। এ সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য তিনি বিপদনাশিনী দুর্গা দেবীর পূজা করেন। দেবরাজ ইন্দ্র দুর্বাসা মুনীর অভিশাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য দুর্গা মায়ের অরাধনা করেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য দেবী দুর্গার স্তব করেছিলেন। সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রামচন্দ্র ত্রেতাযুগে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনেই শারদীয় দুর্গাপূজার প্রবর্তন। সর্বজীবের মাতৃরূপে বিরাজমান সর্বশক্তির আধার দেবী দুর্গা দশভুজা। তার দশহাতে দশরকম অস্ত্র সুশোভিত। তার ডানহাতে ত্রিশূল, খড়গ ও চক্র; বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার, ঘণ্টা। তিনি মর্ত্যলোকে এসেছেন জ্ঞানের প্রতীক, ঐশ্বর্যের প্রতীক, বলবীর্যের প্রতীক ও সিদ্ধিদাতাকে সঙ্গে নিয়ে। রামচন্দ্রের অকালবোধনে প্রত্যেক শক্তির সামাজিক রূপ নিয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন বসুন্ধরায়। যাবতীয় হিংসা, অন্যায়, অত্যাচার, ত্রাস, অবিচার ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আবির্ভূত হয়ে দেবী দুর্গা সেগুলোকে দূর করেন এবং পৃথিবীতে আনেন শান্তি, আনন্দ ও কল্যাণ। সন্ত্রাসের সকল শক্তিকে, অন্যায় ও অশুভ শক্তির প্রতিভূকে বিনাশ ঘটিয়ে দেবী দুর্গা সন্ত্রাসমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের আদর্শস্থাপন করেন। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয় ও কল্যাণপ্রয়াসী। তারা অশুভ শক্তিকে বারবার পরাজিত করে। নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগ করে গণতন্ত্রকে বিজয়ী করতে চায়। জনপ্রতিনিধিরা বিশ্বাসঘাতকতা করে অপশক্তির বিকাশে লিপ্ত হয়। অন্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ সরকার বদল করে। প্রয়োজনে সন্ত্রাসের স্বপক্ষীয় শক্তিকে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে পরাজিত করার আদর্শ অবলম্বন করে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দুঃশাসন দমন করার জন্য জনগণ বারবার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে। অসুরদের অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, দুঃশাসন ও সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করে সুর দেবতাদের শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে দেবী দুর্গার যে আধ্যাত্মিক আদর্শ লক্ষ্য করা যায়, তার প্রতিফলন ঘটেছে মানবসমাজের বাস্তবভিত্তিক জীবনাচারে। সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে দেবী দুর্গার আদর্শ মানবসমাজের প্রেরণাস্বরূপ। জনগণ রাজনৈতিক সন্ত্রাস, সহিংস আন্দোলন ও ক্ষমতাধর তৎপরতা চায় না। তারা চায় দুনীর্তিমুক্ত প্রশাসন, সামাজিক ন্যায় বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। যাবতীয় শুভবোধ, কল্যাণকর, তৎপরতা আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে রয়েছে জনগণ। দেশবাসী শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছায় মানুষের এসব আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা পূরণের পথ প্রশস্ত হোক “জয় মা দূর্গা”।

লেখক: চেয়ারম্যান-মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদ, আহবায়ক-বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, গৌরনদী উপজেলা শাখা।