তারেক রহমান

আবদুল হাই শিকদার : যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৩৯৯ বছর আগে এথেন্সে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মহামনীষী সক্রেটিস বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি অপরাপর লোকের মতো সাধারণ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাইনি। আমি আমার নীতির দৃঢ়তা নিয়ে বেঁচেছিলাম। যে জীবনে আমি নিজের বা অপরের মঙ্গল সাধন করতে পারব না তা গ্রহণ করিনি। আপনাদের সব সময়ই এ কথা বোঝাতে চেয়েছি, ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে নিজের আবার উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেয়াই শ্রেয়। এরূপ জ্ঞানদানের পরও আজ আমি কী পাচ্ছি? এই কি আমার প্রাপ্য ছিল? … আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আপনারা ণস্থায়ী খ্যাতি হয়তো পাবেন, কিন্তু কিছুদিন পরই জ্ঞানী সক্রেটিসকে হত্যার দায়ে আজকের নিন্দুকরা আপনাদেরই দোষারোপ করবে। … তোমরা যদি ভাব তোমাদের পাপকাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠকে হত্যার মাধ্যমে রুদ্ধ করতে পারবে, তাহলে তা ভুল ধারণা। কারণ অব্যাহতি লাভের এই উপায় সম্ভবত বিশ্বাসযোগ্যও নয়। শ্রেষ্ঠ ও সহজতম উপায় হচ্ছে কাউকে দমিয়ে রাখা নয়, বরং নিজেকে উন্নত মানুষরূপে গড়ে তোলা।’
সক্রেটিসের এই অমোঘবাণী উচ্চারণের ২৩৩৪ বছর পর প্রকাশিত শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে অসহায় বন্দি শেষ নবাব প্রায় কাছাকাছির ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলার প্রজাকুল যাতে সর্বহারা না হয়, তোমাদের সুখের সংসার যাতে ভাস্কর পণ্ডিতের রোষানলে ভস্মীভূত না হয়, তোমাদের সন্তান-সন্ততিরা যাতে না পতঙ্গের মতো প্রাণবলি দিতে বাধ্য হয়, তারই জন্য বিশ্বাস করো ভাইসব, শুধু তারই জন্য যৌবনের দুর্বার আকর্ষণ উপো করে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার পথে-প্রান্তরে সংগ্রামস্থলে উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছি। তারই পুরস্কার কি ওই কণ্ঠক আসন? তারই পুরস্কার কি ছিল পাদুকা? তারই পুরস্কার কি এই তস্করলব্ধ লাঞ্ছনা?’
জ্ঞানী সক্রেটিস কিংবা শহীদ সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা বা প্রতিতুলনা নয়। অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি ও সাযুজ্য দেখলে অনেক ধরনের মিল খুঁজে বের করতে পারবেন যে কেউ। সত্য প্রচারে অকুতোভয় ছিলেন সক্রেটিস। তাই তার বিরুদ্ধে দায়ের করা এক ঝুড়ি মিথ্যা অভিযোগ : সক্রেটিস নাস্তিক, তিনি এথেন্সের দেবদেবীদের স্বীকার করেন না। তিনি কল্পিত নতুন দেবদেবী প্রতিষ্ঠা করতে চান। তরুণদের তিনি নৈতিকভাবে বিপথগামী করেছেন।
আর সিরাজউদ্দৌলার অপরাধ ছিল তিনি চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এ জন্য যেমন তাকে প্রাণ দিতে হয়, তেমনি তার বিরুদ্ধে রচিত হয় ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা অভিযোগ। তিনি অত্যাচারী, তিনি ইন্দ্রিয়াসক্ত, তিনি নারীলোলুপ। আরও কত কী? সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীরা ছিলেন সেই সময়কার এথেন্সের ফালতু ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। আর সিরাজের বিরোধিতায় সবাই ছিলেন মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী।

দুই.
বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করার প্রবক্তারা সেদিনের মতো শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করায় মীর জাফরের মতো মইন উকে। পরে মইন উর দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয় হাসিনার হাতে। যেভাবে মীর জাফরের কাছ থেকে মতা চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। এরা তাদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখতে পায় তিনটি জিনিস। এক. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন ও তার ইমেজ, দুই. জিয়া পরিবার, তিন. জাতীয়তাবাদী দর্শনের চর্চাকারী দল বিএনপিকে। বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কাছ থেকে রা করার এই তিন স্তম্ভকে ধ্বংসের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ওই চক্র এবং অনুধাবন করে বেগম খালেদা জিয়ার পর জাতীয়তাবাদী শক্তির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি মাত্র একজন। তিনি তারেক রহমান। তারেক রহমানকে অত রেখে তাদের উচ্চাভিলাষ সফল করা সম্ভব নয়। তারা এও অনুধাবন করে, তারেক রহমান বাংলাদেশের তারুণ্যের প্রতীক। এই প্রতীক অপসারণ করা না গেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকেও শূন্য করা সম্ভব হবে না। তারেক রহমান আধিপত্যবাদের বিরোধিতার পথে যেতে বাধ্য, তারেক রহমান বাংলাদেশের তারুণ্যকে সংগঠিত করেছিলেন, তিনি তার মহান বাবার মতোই ষড়যন্ত্রের অতীতমুখী রাজনীতি উচ্ছেদ করে ভবিষ্যৎমুখী, উন্নয়নের রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে এনেছিলেন। তিনি একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আর এই কাজগুলো যদি করতে পারতেন নির্বিঘেœ, তাহলে এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার বাংলাদেশকে পঙ্গু করে রাখা সত্যিকার অর্থেই মুশকিল হতো শত্রুদের। আর কে না জানে যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে বগল বাজায় বর্তমান শাসকরা, আসলে তারও স্থপতি ছিলেন তারেক রহমান।
তারেক রহমান বিএনপিকে যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রেও গ্রহণ করেছিলেন কিছু পদক্ষেপ, যা তৃণমূল পর্যন্ত আলোড়ন তুলেছিল। আর প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েছিল কোণঠাসা। মোট কথা তারা পড়েছিল অস্তিত্বের সঙ্কটে। ফলে মরিয়া হয়ে ওঠে বাংলাদেশের শত্রুরা। তারা তাদের ষড়যন্ত্রের প্রধান টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করে তারেক রহমানকে। তারা তাদের অনুগ্রহভাজন মিডিয়ার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সব ধরনের হিংসা ও হিংস্রতাকে একত্রিত করে অপপ্রচারের এক ঝড় বইয়ে দেয় দেশজুড়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই মিডিয়া যেগুলোকে শেখ মুজিব পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কবরে, আর নতুনভাবে তাদের উদ্ধার করে মুক্তি এনে দিয়েছিলেন তারেক রহমানের বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
ইংরেজি প্রবাদের ‘কুকুরটিকে একটি খারাপ নাম দাও’ এর মতো আধিপত্যবাদের নীল নকশাা অনুযায়ী সবকিছু গুছিয়ে আনার পর জাতির ঘাড়ের ওপর হামলে পড়ে মইন উ ও ফখরুদ্দীনের ১/১১। তাদের হাতে বয়েত গ্রহণ করে আসে শেখ হাসিনার বাংলাদেশবিমুখ সরকার। এরা সম্মিলিতভাবে তারেক রহমানের ওপর একে একে চাপিয়ে দেয় জঘন্য অপবাদ সমৃদ্ধ মিথ্যা মামলার বহর। একে একে ১৩টি মামলা। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা তার একটি।

তিন.
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়টি বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির ইতিহাসে খুবই আলোচিত একটি ঘটনা। তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় অনেকেই এই ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা করেছিলেন।
বিএনপি সরকারের সময় এই গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। মতাসীন বিএনপি এ মামলার তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনসহ নানাভাবে তদন্তের ব্যবস্থা করে। সে সময় চার্জশিটও দেয়া হয়। ধরে নিলাম যেহেতু বিএনপি তদন্ত করে সেহেতু তারা তাদের কেউ জড়িত থাকলেও তার নাম জড়ায়নি। কিন্তু মইন উ ও ফখরুদ্দীনের যে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর পরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের মূল এজেন্ডাই তো ছিল জিয়া পরিবার, বিএনপি ও তারেক রহমানকে ধ্বংস করা। সেই হিংস্র এজেন্ডা বাস্তবায়নে ওই সরকারটি এই তিন স্তম্ভের বিরুদ্ধে করেনি এহেন কোনো অপকর্ম নেই। সেই সরকারও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ওপর নতুন করে তদন্ত করে ফের একটি চার্জশিট দায়ের করে। কিন্তু দেখার বিষয়, তারা শত চেষ্টা করেও সেই চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম জড়াতে পারেনি। তাদের দেয়া চার্জশিটেও তারেক রহমানের নাম ছিল না।

চার.
কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপ যেহেতু তারেক রহমান, সেহেতু তাকে না জড়ালে গায়ের জ্বালা মেটে কীভাবে। সে জন্য শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের নানাস্তরের নেতা, পাতি নেতারা তারেক রহমান জড়িত বলে তারস্বরে চিৎকার শুরু করে।
স্বয়ং শেখ হাসিনা যখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী তখন থেকেই কোনো প্রমাণ ছাড়াই তদন্ত রিপোর্টগুলোকে পাশকাটিয়ে দাবি করেন, শুধু ২১ আগস্ট নয়, সব গ্রেনেড হামলা ও সন্ত্রাসের মূল হোতা তারেক রহমান।
ব্যক্তিগতভাবেও তারেক রহমান সম্পর্কে অনেক অশ্লীল ও শিষ্টাচারবর্জিত কটূক্তি করেছেন শেখ হাসিনা। জবাবে তারেক রহমান বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন, তিনি আমার মাতৃস্থানীয়। তিনি যা বলছেন, তার দায়দায়িত্ব তার। কিন্তু আমি তার সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা বলতে পারব না। এটা অশোভন হবে। এরপরও থামেনি শেখ হাসিনার অযৌক্তিক অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক, রুচিহীন বাক্য বর্ষণের ধারা। যা অদ্যাবধি তিনি সমানে চালিয়ে যাচ্ছেন।
সঙ্গত কারণেই ধারণা করা গিয়েছিল যেহেতু সততা, ন্যায়নীতি, আইন-কানুনের ধার এ সরকার ধারে না, সে জন্য তারা হয়তো তারেক রহমানের প্রতি তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য আবার একটি লোক দেখানো তদন্ত করে, নতুন করে চার্জশিট দেবে, হলোও তাই।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার মতাসীন হয়েই চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া সিআইডির এএসপি নিন্দিত ও বিতর্কিত আবদুল কাহার আখন্দকে পুলিশের প্রচলিত নীতি-নিয়ম ভেঙে ফের চাকরিতে ফিরিয়ে আনে। তার হাতে ন্যস্ত করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ও চার্জশিট দেয়ার ভার।
কাহার আখন্দ চাকরিজীবনে ছিলেন তুমুল বিতর্কিত। তাকে সবাই আওয়ামী লীগের একজন কঠোর মনোভাবাপন্ন কর্মী হিসেবে জানত। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদের সদস্য পদে নির্বাচন করার জন্য সব রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। তিনি তার স্বভাবসুলভ উগ্র ও নিষ্ঠুর আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটান কিশোরগঞ্জের নির্বাচনী এলাকায়। ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিলের জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তার সমর্থকরা অন্য একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর (যিনি বিএনপি করতেন) সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। দুই পরে মারামারিতে আহত হয় ৮ জন। পত্রিকায় শিরোনাম ছিল, ‘কিশোরগঞ্জে মেজর আখতার ও আবদুল কাহার সমর্থক সংঘর্ষ : আহত ৮।’
একই বছরের ১৪ মে তারিখে প্রকাশিত জনকণ্ঠের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায় কাহার আখন্দের সমর্থকরা আবারও প্রতিপরে সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। ১৬ মে তারিখে কাহার আখন্দের লোকজন প্রতিপরে বাড়িঘর ভাঙচুর করে।
জনকণ্ঠকে সবাই জানেন আওয়ামী লীগের কড়া সমর্থক। সে জন্য জনকণ্ঠ থেকেই উদ্ধৃতি ব্যবহার করছি।
এই জনকণ্ঠে ৪ মে ২০০১ তারিখে এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে (কটিয়াদি) কাহার আখন্দের মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ।
১ জুন তারিখে আবারও সংঘর্ষ হয়। এবার কাহার আখন্দের সমর্থকদের হাতে আহত হয় ২ শতাধিক মানুষ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে কাহার আখন্দ সে সময় পোস্টার ছাপিয়ে নিজের নির্বাচনী প্রচারণাও চালিয়েছিলেন।
কাহার আখন্দ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী প্যানেল থেকেও নির্বাচন করেন এর আগে। এরপরও সরকারি ভাষ্য মোতাবেক তিনি নিরপে নির্দলীয় লোক! তাকেই আবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ও চার্জশিট দেয়ার জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে অবাক করে দিয়ে তাকে এএসপি র‌্যাংক থেকে প্রমোশন দিয়ে এসপি পদে উন্নীত করা হয়। ঘটনা পর্যালোচনা করে এ কথা পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে এএসপি পদে তাকে কারও না কারও তত্ত্বাবধানে কাজ করতে হবে। সেটা তার এসাইনমেন্ট বাস্তবায়নের পথে বাধা হতে পারে। এ কারণে তদন্তের সর্বময় কর্তা বানানোর জন্য কাহার আখন্দকে জবাবদিহিতা মুক্ত রাখার জন্যই এসপি পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
এহেন কাহার আখন্দের কাছ থেকে কী রকম নিরপে তদন্ত পাওয়া যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
তারেক রহমানকে ফাঁসানোর সব নীল নকশা চূড়ান্ত করে এবার মাঠে নামেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
তাদের ভাষাও যদি ধরি, তাহলেও বলতে হবে, যে ঘটনা তদন্তাধীন, সেই বিষয় সম্পর্কে আগ বাড়িয়ে কথা বলা কখনোই সঙ্গত নয়। তারপরও পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করার জন্য আইন প্রতিমন্ত্রী ১৩ জুন নিউইয়র্কে ধুম করে ঘোষণা দিয়ে বসলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হবে। যে বিষয় তখনও তদন্তাধীন, সেই তদন্ত প্রতিবেদনে কে কে অভিযুক্ত হবেন, সে কথা তো কারোরই জানার কথা নয়। আইন প্রতিমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে বলে বসলেন তারেক রহমানের নাম। এর অর্থ কী?
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাড়িয়ে গেলেন সবাইকে। তিনি ৫ জুলাই ২০১১ তারিখে ঘোষণা করলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তারেক রহমান এবং এ সরকারের আমলেই গ্রেনেড হামলার রায় কার্যকর হবে।
ওপারে কাহার আখন্দ, এপারে সৈয়দ আশরাফ এবং কামরুলের মতো বাঁচাল লোকজন। ফলে গজব নেমে আসল মুফতি হান্নানের ওপর। মধ্যযুগীয় পৈশাচিক অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে ২০০ দিন রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার নির্যাতনের পাশাপাশি নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা চলে। বলতে হবে তারেক রহমান গ্রেনেড হামলায় জড়িত। ০৭.০৪.২০১১ তারিখে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় তার কাছ থেকে আদায় করে তাদেরই রচিত জবানবন্দি। আওয়ামী মহল উল্লাসে ফেটে পড়ে। দেখ, এই যে তারেক রহমান এ হামলায় জড়িত।
কিন্তু ধর্মের কল নড়ে বাতাসে। ২৭.০৯.২০১১ তারিখে মুফতি আবদুল হান্নান তার আইনজীবীর মাধ্যমে ১৬৪ ধারায় রেকর্ডকৃত কথিত জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন। সেখানে তিনি কী বলেছেন তার নিজের বক্তব্য থেকেই দেখা যাক : ‘এই মামলায় দ্বিতীয় জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে অর্থাৎ ৪.৪.১১ তারিখ রাত আনুমানিক ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে নেওয়া হয়। জেলগেটে পৌঁছানোর পর সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুর রহমান লিখিত একটি কাগজে স্বার করিতে বলিলে আমি অস্বীকার করায় আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে বিষ প্রয়োগে হত্যার হুমকি দেয়। পরের দিন সকালে অর্থাৎ ০৫/৪/১১ ইং তারিখে ৬ সেল বনফুল ৬নং রুমে আমার অবস্থানে আনুমানিক সকাল ৭.৩০ মিনিটে সুপার ও তার সঙ্গে জেলার, ডেপুটি জেলার সেই কাগজটা দিয়ে স্বার করতে বললে আমি আবারও অস্বীকার করি। ইহাতে সুপার গালাগাল দিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়।
ঐদিন সন্ধ্যায় অর্থাৎ ০৫/৪/১১ তারিখ সন্ধ্যায় ৬/৪/১১ তারিখে সিলেটে আমার কোর্ট থাকার দরুন চালান পাঠায়। সিলেটে কোর্ট শেষে আবার পরের দিন অর্থাৎ ০৭/৪/১১ ইং তারিখ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় জেলগেটে পৌঁছানোর সাথে সাথে জেলগেট থেকে সিআইডি ফজলুল কবীর ও আরো কয়েকজন সিআইডি অফিসার তাদের গাড়িতে করে ঢাকা কোর্টে নিয়ে আসে। সে সময় জেলের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল না। কোর্টে পৌঁছিয়ে আমাকে কোর্টের একটি রুমে রাখে। যেখানে আইনজীবীরা বসে। পরে আমাকে ম্যাজিস্ট্রেট রুমে ফজলুল কবির নিয়ে যায়। আমি সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটকে এখানে আনার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, আপনার দরখাস্ত মোতাবেক ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য এখানে আনা হয়েছে। শুনে আমি হকচকিত হয়ে বিচলিত হয়ে পড়ি। তখন ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ফজলুল কবীর এবং পূর্বের ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে বসে থাকা আব্দুল কাহার আকন্দ (সিআইডি) আমার হাতে একটি কাগজ দেয়, যেখানে বর্তমান আমার কথিত জবানবন্দিতে উল্লিখিত নামÑযেমন : তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী, পিন্টু, বাবরসহ অনেকের নাম রয়েছে। আমি উক্ত রেকর্ডকৃত ও প্রস্তুতকৃত জবানবন্দিতে স্বার করতে অস্বীকার করলে আমাকে জেলের ভেতরে হত্যা করাসহ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার হুমকি দেওয়া হয়। রাত ১১টায় প্রায় এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট, আব্দুল কাহার আকন্দ ও ফজলুল কবীরের উপস্থিতিতে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বার করতে বললে আমি সাদা কাগজে স্বার করিনি। স্বার না করার দরুন আমাকে পুলিশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত করার পূর্বে আমাকে বিভিন্ন মামলা দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করত। ফজলুল কবীর ও আব্দুল কাহার আকন্দ মাঝেমধ্যে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে র‌্যাবের নিকট নিয়ে যেত। র‌্যাব আমাকে নিয়ে শহরের বাহিরে নিয়ে যেত। আর বলত তুমি ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, আব্দুস সালাম পিন্টু, বাবরÑএদের সঙ্গে হাওয়া ভবনে মিটিং করেছ, স্বীকার করতে হবে। আরও স্বীকার করতে হবে যে, বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টু গ্রেনেড ও টাকা দিয়েছে। তা নাহলে তোমাকে হত্যা করা হবে। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে র‌্যাব, ডিজিএফআই ও সিআইডিসহ প্রায় ৪১০ দিন আমাকে রিমান্ডে নিয়ে অমানষিক নির্যাতন চালিয়েছে, ফলে আমার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেয়েছে, স্মৃতিশক্তিও হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে আমার ডান হাত ও ডান পা অবশ হয়ে গেছে। আমি ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাথে কোনোভাবেই জড়িত নই। আমি তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী ও বাবরের সাথে হাওয়া ভবনে কোনো সময়ই দেখা করিনি। পিন্টু সাহেবের বাসায় কখনও যাইনি ও চিনি না। অন্যান্য আসামীদেরও আমি চিনি না। পূর্বেও কোনো পরিচয় ছিল না।
অদ্য ২৭/৯/১১ ইং তারিখ আদালতে উপস্থিত হয়ে নিয়োজিত আইনজীবীর মাধ্যমে আমার বক্তব্য লিখিয়ে পাঠ করত : সঠিক পেয়ে স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে অন্যের বিনা প্ররোচনায় অত্র প্রত্যাহারমূলক জবানবন্দির প্রতি পাতায় নিজ নাম স্বার করিলাম। আব্দুল হান্নান।’

পাঁচ.
মুফতি আবদুল হান্নানকে ধন্যবাদ জানাই মৃত্যু ও নির্যাতনের মধ্যে থেকেও তিনি যে সাহস ও সততার পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য। তার এই বক্তব্য একদিকে যেমন শাসকদের চরিত্র উšে§াচন করে দিয়েছে, তেমনি বহুদিন বহু নির্যাতিত মানুষকে সত্য বলার জন্য জোগাবে অনুপ্রেরণা। চিন্তাবিদ চার্লস ব্যাডেন যথার্থই বলেছিলেন, কোনো কারাবাসই কোনো সত্যকে ধ্বংস করতে পারে না। হয়তো সাময়িক বাধা সৃষ্টি করে মাত্র।
এ জন্যই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেনÑ

সত্য পথের তীর্থ পথিক! ভয় নাই নাহি ভয়,
শান্তি যাদের ল্য, তাদের নাই নাই পরাজয়।
অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে
অবশেষে চির লাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে।

পথের ঊর্ধ্বে ওঠে ঝড়ো বায়ে পথের আবর্জনা
তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে ওঠেছে কেহ কভু ভাবিও না!
ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরই পথে হয় এরা বাধা,
পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় নাক কাদা।

অতএব দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির ভয় নেই।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, তারেক রহমান দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বের কোনো মানুষ নন। তাই বলে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চের খলনায়কও নন। কিন্তু তাকে খলনায়ক বানানোর প্রাণান্ত প্রয়াস চারদিকে। যারা এই প্রয়াস চালাচ্ছে তারা আর যা-ই হোক বাংলাদেশের বন্ধু নন। বন্ধু নন বলেই তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা জরুরি। এই কাজটি করতে পারলেই বাংলাদেশ অধীনতামুক্ত হবে। সেই কাজে অংশগ্রহণ করাই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় দাবি। আশা করি, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি সময়ের এই আহ্বান শুনতে পাবেন।