নারী নির্যাতন: প্রেক্ষিত ঝালকাঠি – আহমেদ আবু জাফর

ভূমিকা: নারী এবং পুরুষের যৌথ উদ্যোগের মাঝপথ দিয়ে যে জীবন শুরু হয় সে সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন কোন ধারনা নয়, সেটাই মানব সংস্কৃতির আসল পথ। হাজার বছরের অভিজ্ঞতা একটি জাতির সংস্কৃতি। কালক্রমে নারী-পুরুষের সম্পর্কের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবনার সংমিশ্রন ঘটে। যা সমাজের বহুবিধ চেতনা ও জটিলতার স্রোতে প্রবাহিত হয়। ফলে তা হতে পারে দূর্বল ও অসুস্থ, হতে পারে রুচিশীল। এটি যেমন নির্ভর করে সেই জনগোষ্ঠী কিভাবে নিজেদের গড়ে তুলছে তার মৌল সত্যের ওপর। দেশে মানবিক মূল্যবোধের অভাবে নারীরা বেশী আক্রান্ত হচ্ছে। সমাজ সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে নারী-পুরুষের যৌন অনুশীলন সময়ের দাবী।

মানুষের মাঝে যেমনি সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি কম বেশি নারী নির্যাতন বিরোধী ইস্যুও তৈরী হচ্ছে। যুগের পরিবর্তনে এসব কেবল মানুষের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। নির্যাতন ও বৈষম্যমুক্ত জীবনযাপনের অধিকার নারীকে মৌলিক মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে।

ঝালকাঠি জেলার উপজেলা ও ইউনিয়নের আনাচে কানাচে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রকারহীন ভাবে ঘটছে। সমাজের সকলকে পারিবারিক নির্যাতন ও শিশু নির্যাতন সম্পর্কে অবগত হতে হবে। গুরুতর সমস্যা হিসেবে এ নির্যাতনকে প্রাধান্য দিতে হবে। সুনামহানির ভয়ে পারিবারিক নির্যাতন আড়াল করলে চলবেনা, কথাটি সাধারন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে, স্বোচ্ছার হতে হবে সমাজ সচেতন সকল নাগরিককে। কোন না কোন ভাবেই সমাজে প্রতিনিয়ত নারীরা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। ঘরে-বাইরে, আতœীয়-অনাতœীয়, পরিচিত-আগন্তুক, শক্র-আপনজন দ্বারাও একজন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এর মধ্যে পরিবারের মাঝে স্বামী কিংবা পরিজনের অন্য কারো দ্ধারা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সনদে বলা আছে পরিবার ও পরিবারের বাইরে নির্যাতন ও বৈষম্যমুক্ত জীবনযাপনই নারীর মৌলিক মানবাধিকার। এক্ষেত্রে নারী যেকোন ধরনের নির্যাতনের শিকার আইন ও মানবাধিকারের চোখে বিচার্য। তবে সনদের কোথাও কোথাও বলা আছে নারী-পুরুষ উভয়ই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তবে এদেশের বাস্তবতায় নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতনের একটি মাত্র রুপকে বোঝানো হচ্ছে।

একটি জরিপে দেখাগেছে, বিশেষ করে বিবাহিতা নারীরা পরিবারে অত্যাচারের একটি সাধারন ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের প্রনীত সূত্রমতে, নারী নির্যাতনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের শতকরা হার ৪৭ । এর মধ্যে শহরাঞ্চলে শতকরা ৬৭ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে মারধর খায়, ২০ শতাংশ নারী যৌন হয়রানীর শিকার হয়, ৬৭ শতাংশ নারী মৌখিক যৌন নিপিড়নের শিকার হচ্ছে। তবে পারিবারিক গোপনীয়তার আড়াল ভেঙ্গে খুব কম ঘটনা প্রকাশ পায় এবং বিচারের জন্য আদালতে যায়।

ঝালকাঠি জেলার এ বছরের নারী নির্যাতনের চিত্র অনেকটা ভিন্ন। তবে বিভিন্ন কায়দায় নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। ঝালকাঠি পুলিশ বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, জেলার চারটি উপজেলায় চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৫টি ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। তবে  শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বেশী। সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, জেলায় ৩০টি নারী নির্যাতন ও ২৫টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারীতে ২টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ফেব্র“য়ারীতে ২টি নারী ও ৪টি শিশু নির্যাতন, মার্চ মাসে ৪টি নারী, ২টি শিশু ও একটি ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। এপ্রিলে ৩টি নারী নির্যাতন, ২টি শিশু নির্যাতন ও একটি ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। মে’ মাসে ৪টি নারী নির্যাতন, ২টি শিশু ও একটি ধর্ষনের ঘটনা ঘটে। জুন মাসে ৫টি নারী নির্যাতন, একটি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। জুলাই মাসে ৫টি নারী নির্যাতন, একটি শিশু ও একটি ধর্ষন ঘটনা ঘটে। আগষ্টে ৩টি নারী নির্যাতন, ২টি শিশু ও একটি ধর্ষনের ঘটনা ঘটে। সেপ্টেম্বরে ২টি নারী ৬টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।  অক্টোবরে ২টি নারী নির্যাতন, ৩টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বছরে জেলায় ৫টি অপহরনের ঘটনা ঘটে।

ঝালকাঠি জেলা জজ আদালত সূত্রে জানাগেছে, এ বছর জেলায় নারী নির্যাতন সংক্রান্তে বিভিন্ন ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। এর মধ্যে অপহরনের অভিযোগে ২৭টি , ধর্ষনের অভিযোগে ৪১টি , গণধর্ষনের অভিযোগে ৩টি ও যৌন হয়রানীর অভিযোগে ১৪টি মামলা দায়ের হয়। এছাড়া জেলায় যৌতুকের দাবীতে ৪৬টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে উপজেলাওয়ারী এক হিসেবে দেখা গেছে চলতি বছর ঝালকাঠি সদর উপজেলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া নলছিটিতে ৩৭টি, কাঠালিয়ায় ১৮টি ও রাজাপুরে ১২টি মামলা দায়ের করা হয়।

ব্র্যাক সূত্রমতে, অসহায় দু:স্থ নারীদের মাঝে আইনী ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। ব্র্যাক পারিবারিক দেনমোহর ও ভরনপোষনের আদায়ের দাবীতে এ বছর ১শ ২০টি মামলা, যৌতুকের অভিযোগে ৫টি, ধর্ষনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে নলছিটির চাঞ্চল্যকর স্কুল ছাত্রী রিপা হত্যা মামলাটিও তারা পরিচালনা করছে।

পারিবারিক বিরোধ নিস্পত্তি সেল ঝালকাঠি’র এক তথ্যে জানাগেছে, মোবাইল নেটওয়ার্কিং, সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে সমাজে যৌন হয়রানী, ধর্ষন ও যৌতুকের ঘটনা বাড়ছে।  মধ্যস্থতার মাধ্যমে সামাজিক ও পারিবারিক বিরোধ নিস্পত্তি করে থাকে। এছাড়া কিছু ঘটনা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, মাতুব্বর ও টাউট শ্রেনীর লোকজন শালিসের নামে ঘটনা ধামচাপা দিয়ে থাকে। ফলে নারী নির্যাতন, ধর্ষনের মত ঘটনারও বিচার হয়না। কোথাও ৫-৭ হাজার টাকায় ধর্ষনের শালিস মিমাংসাও করা হচ্ছে।

উপসংহার: তাই আসুন সমাজের দারিদ্র, অশিক্ষা, ব্যাধি এবং সামাজিক অবিচার দূরীভূত করতে দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্যেগ্যের বিস্তার ঘটিয়ে সামাজিক কর্মসূচীর মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে সমাজের নারী-পুরুষের সম্ভাবনা ও সামথ্যকে বিকাশ ঘটিয়ে সক্ষম করে তুলি।

লেখক: গনমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মী
আহবায়ক, ঝালকাঠি নাগরিক ফোরাম