দেড় শতাধিক শহীদের নূন্যতম স্মৃতি চিহ্নটুকু সংরক্ষণ করা হয়নি আজও – ৪০ বছরেও অনাবিস্কৃত, উপেক্ষিত রয়ে গেছে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি আগৈলঝাড়ার কেতনার বিল

তপন বসু, আগৈলঝাড়া ॥ স্বাধীনতার ৪০ বছর পেড়িয়ে গেলেও হাজার হাজার শহীদের গন কবরের খোঁজ নেয়নি আজও কেউ। নূন্যতম স্মৃতি চিহ্নটুকু সংরক্ষণ করা হয়নি আজও। অনাবিস্কৃত ও উপেক্ষিত রয়ে গেছে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি কেতনার বিল। প্রজন্ম ভুলতে বসেছে তাদের হারানো প্রিয়জনদের। আগামী প্রজন্মর কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও সরকার কি জবাব দেবেন ? এমন প্রশ্নই রেখেছেন প্রিয় স্বজন হারানো শহীদের বংশধররা।

দেশে মুক্তি যুদ্ধ চলছে। গৌরনদী সরকারী কলেজে ছিল পাক সেনাদের ক্যাম্প। এখান থেকেই পরিচালিত হত পাক সেনাদের মুক্তিযোদ্ধা নিধন, লুটপাট,ধর্ষণ ও হিন্দু নিধনের অভিযান। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার হিন্দু অধ্যষিত “বাকাই” গ্রাম সহ টরকী বন্দরে পাক সেনারা হত্যা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট চালায়। ঘটনার দিন শনিবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয় ৭ জন পাক সেনা। খবর যায় পাক সেনা ক্যাম্পে। তারা পরদিন ওই এলাকায় অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয়। এদিকে ওই এলাকার লোকজন প্রান বাচাতে সকাল থেকেই তাদের শেষ সম্বল নিয়ে বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার বিলাঞ্চল বাকাল, কোদালধোয়া গ্রামের দিকে খোলা মাঠ কেতনার বিল দিয়ে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে। ইংরেজিতে বাকাই (ইধশধর) এর স্থলে আই’র উপর বিন্দু না পড়ায় পাকসেনারা বাকাইকে “বাকাল” হিসেবে চিহ্নিত করে। বাকাল গ্রামটি ছিল তৎকালীন অখন্ড গৌরনদী উপজেলার অন্তর্ভক্ত বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার একটি গ্রাম। গৌরনদী থেকে ওই গ্রামে রাস্তা দিয়ে যেতে হলে রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা নামক গ্রামের উপর দিয়ে যেতে হয়। ১৯৭১ সন মোতাবেক বাংলা ১৩৭৮ সাল এর ১ লা জৈষ্ঠ রোববার। পাক সেনারা “বাকাল” গ্রামে যাবার পথে সকাল দশটা বা সাড়ে দশটার সময় পাক সেনারা রাংতা নামক স্থানে এসে কেতনার বিলের দিকে তাকিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটতে দেখে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। প্রানের আশায় বাচতে দৌড়ে ছুটে চলা মানুষগুলো পাখির মত গুলি খেয়ে তাৎক্ষনিক ওই মাঠেই শহীদ হয় কয়েক হাজার শিশু ও নারী পুরুষ। পাক সেনাদের গুলির আঘাতে আশ পাশের গাছের সকল পাতা সহ ঝোঁপ, জঙ্গল পর্যন্ত ঝরে পড়ে। যারা আশ পাশের গ্রামে লুকিয়ে ছিল তারা সন্ধ্যার দিকে এসে শুধু লাশের স্তুপই দেখতে পায়। স্বজন হারানো বেদনায় কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তারা।

কেতনার বিলের মধ্যের একমাত্র “পাত্র” বংশের কাশী নাথ পাত্র, বিনোদ পাত্র, বিনোদের স্ত্রী সোনেকা পাত্র, মেয়ে গীতা পাত্র, কানন পাত্র, মঙ্গল পাত্র, মঙ্গলের মা হরিদাসি পাত্র, মেয়ে অঞ্জলী পাত্র, দেবু পাত্রর স্ত্রী গীতা পাত্র, মোহন পাত্র, মেয়ে ক্ষেন্তি পাত্র, কার্তিত পাত্রর স্ত্রী শ্যামলী পাত্র, ১২ দিনের শিশু  অমৃত পাত্র, মেয়ে মঞ্জু পাত্র, মতি পাত্র,  লক্ষ্মি কান্তর স্ত্রী সুমালা পাত্র, নিবারন বিশ্বাস সহ একই বাড়ির ১৯ জন প্রান হারায় এদিন। এর মধ্যে ১২ দিনের শিশু অমৃতকে বুটে পৃষ্ঠ করে ও নিবারনকে ব্যানোয়েট দিয়ে খুঁটিয়ে হত্যা করে পাক সেনারা। গৌরনদীর জমিদার মোহনের লাশ খুজে পায়নি তার স্বজনরা। টরকী- গৌরনদী সহ আশ পাশের এলাকার ক’য়েক হাজার লোকের লাশ পড়ে থাকে কেতনার বিলে। প্রবাদের মতই “এক জনের ঘর পোড়ে, অন্য জন খৈ খায় অবস্থা। কেতনার বিলের পাশ্ববর্তি চেঙ্গুটিয়া গ্রামের কাদের হাওলাদার, রাংতা গ্রামের ইসমাইল মুন্সির ছেলে আউয়াল মুন্সি (বর্তমানে মৃত) সহ কয়েক ব্যক্তি লাশের সাথে থাকা টাকা পয়সা, সোনা দানা ও মুল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। তখন প্রান বাচাঁতে পালানো মানুষের ভীড়ে লাশ সৎকার বা কবর দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার পরেও মৃত কুপ নামে খ্যাত ওই পাত্র বাড়ীর  বেচে যাওয়া হরলাল পাত্র ও অমূল্য পাত্রর নেতৃত্বে হরলালের ছেলে শুশীল পাত্র, কেষ্ট পাত্র, রাধা কান্ত পাত্র সহ কয়েক জন পরদিন তাদের হারানো স্বজন সহ দেড় শতাধিক লোকের লাশ এনে তাদের পাত্র বাড়ির কয়েকটি স্থানে বড় গর্ত করে মাটি চাপা দেয়। যার গর্তের সংখ্যা ৫ থেকে ৬ টি।  বাকি লাশগুলো কেতনার বিলে শিয়াল কুকুরে খাবার হয়ে যায়। বেশীরভাগ লাশ পচে গলে পড়ে থাকে বিলের মধ্যেই। এর বেশী কিছু তাদের ওই সময় করার ছিলনা বলে ওই দিনের প্রত্যক্ষদর্শী কাশিনাথ পাত্রর ছেলে অমূল্য পাত্র (৮০) জানান।

কাশীনাথ পাত্রর আরেক ছেলে জগদিশ পাত্র জানান, সেও জীবন বাচাতে বাবার সাথে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা পালাতে পারেনি। তার বাবার গায়ে ৫টি গুলি লেগেছিল। এত লাশ এ বাড়িতে মাটি দেয়ার পর থেকে এবাড়িতে তাদের থাকতে কোন ভয় করে কি না? জানতে চাইলে অমূল্য পাত্রর স্ত্রী বিল্ব পাত্র স্মৃতি চারণ করে বলেন দুধের এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম বাশাইল ও রামানন্দেরআঁক গ্রামে ১০ দিন পালিয়ে থাকার পর বাড়ি ফিরে তাদের কোন ভয়ই আজ পর্যন্ত লাগেনি। তিনি আরও বলেন,“ মানুষের হাতে মরলে তারা ভুত হয়না, তাদের গোলকে (স্বর্গ/বেহেস্ত) বাস হয়”।

স্থানীয় মনোহর পাত্রর ছেলে ধীরেন পাত্র (৬০) জানান, তিনি মুক্তি যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের বিহারে ট্রেনিং করেন। তার প্লাটুন কমান্ডা ছিলেন যশোরের কুদ্দুস, উইন্স কমান্ডার ছিলেন টরকীর গোপাল বনিক। দেশে ফিরে তিনি যুদ্ধ পাননি। তার বর্ডার পাশ সার্টিফিকেট থাকলেও তিনি মুক্তি যোদ্ধার তালিকায় আজও নাম লেখাতে পারেননি। এদিকে কাশীনাথ পাত্রর ছেলে জগদীশ পাত্র (৫০) আক্ষেপ করে বলেন, তার স্বজন ও বংশের লোকজন সহ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি অর্থাভাবে একটি স্মিৃতি চিহ্ন নির্মান করতে পারেছেননা। এজন্য স্থানীয় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে নেতৃবৃন্দের কাছে তিনি স্মৃতি ফলক নির্মানের জন্য জায়গা দেয়ার আকুতি জানালেও ৪০ বছরেও স্মৃতি ফলক নির্মান না হওয়ায় সাংবাদিকদেরও প্রথমে কোন তথ্য দিতে রাজি হয়নি। তিনি ক্ষোভের সাথে আরও জানান, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতা আ. রইচ সেরনিয়াবাত সহ আগৈলঝাড়া থানার সাকেব ওসি, মুক্তিযোদ্ধা অশোক কুমার নন্দি বধ্যভূমি ঘুরে গেলেও আজও সেখানে কিছুই হয়নি। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের দাবিদার সরকারের কাছে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বদ্ধভূমি আগৈলঝাড়ার অনাবিস্কৃত কেতনার বিল সংরক্ষণ ও হাজারো শহীদের শেষ স্মৃতিটুকু ধরে রেখে পরবর্তি প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মানের দাবি জানান।

দেড় শতাধিক শহীদের নূন্যতম স্মৃতি চিহ্নটুকু সংরক্ষণ করা হয়নি আজও - ৪০ বছরেও অনাবিস্কৃত, উপেক্ষিত রয়ে গেছে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি আগৈলঝাড়ার কেতনার বিল