ধান-নদী-খাল এই তিনে মোগো বরিশাল – দু’শ এগারো বছরের পথপরিক্রমা

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ ধান-নদী-খাল এই তিনে মোগো বরিশাল। গাঙ্গের (নদীর) অববাহিকার এ জেলার বয়স দু’শ বছর পেরিয়ে গেছে। প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র পলি জমে সৃষ্ট কয়েকটি দ্বীপের একটি হল বরিশাল। ১৭৯৬ সন পর্যন্ত বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামেই পরিচিত ছিলো বরিশাল। প্রাচীনকাল থেকেই নদী ভাঙ্গন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা এ অঞ্চলের মানুষের পেশা কৃষি ও মৎস্য শিকার। গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত চন্দ্রদ্বীপে লোকবসতি কবে শুরু হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাচীন পুঁথি থেকে ধারণা পাওয়া যায় বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের জন্ম ৪ হাজার বছর পূর্বে। প্রাচীনকালে এই দ্বীপে ছিল অসংখ্য নদী-নালা। এখনো মেঘনা, তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, কালাবদর, ঝুনাহার, কীর্তনখোলা নদ-নদীতে ঘিরে আছে এ জেলা। প্রমত্তা নদীগুলো অসংখ্যবার এ অঞ্চলের ভৌগোলিক মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এই প্রথম বারের মতো বরিশাল নগরীকে আধুনিক ও ডিজিটাল নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছেন বর্তমান বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন হিরন।

বরিশালের বালাম চাল : এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ায় নদী ও খালের সাথে যুক্ত করেই প্রবাদ রচিত হয় ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে মোগো বরিশাল’। বালাম চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এ জেলা। অতীতে বরিশালের বালাম চালের যেমন কদর ছিলো তেমনি এখনো সারাদেশের মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে আছে স্বরূপকাঠীর পেয়ারা। বর্তমানে ওই উপজেলায় বিপুল পরিমাণ লেবুও উৎপন্ন হয়। শাক-সবজি ও কাঠের পাশাপাশি আটঘর-কুরিয়ানায় বড় জাতের কৈ মাছ পাওয়া যায়। বালাম চালের উৎপাদন হ্রাস পেলেও নতুন ফসলের মধ্যে ফুট-তরমুজ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দু’শ এগারো বছর পেরিয়ে : ১৭৯৭ সনে বাকেরগঞ্জে প্রথম জেলা স্থাপিত হয় । ১৮০১ সনে বাকেরগঞ্জ থেকে জেলার সদর দপ্তর আনা হয় বরিশালে। ১৯৬০ সন পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ও ১৯৬১ সন থেকে ১৯৯৩ সন পর্যন্ত ছিলো খুলনা বিভাগের অন্তর্গত। এককালের বরিশাল জেলা শহর রূপ নিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় শহরে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরিশালের রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে নাম দিয়েছিলেন প্রাচ্যের ভেনিস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এ শহরের আত্মীয়তার ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো।

প্রাচ্যের ভেনিস থেকে রত্মগর্ভা : এখানে জন্ম নিয়েছেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত, বাংলার বাঘ বলেখ্যাত শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, সাংবাদিকতার পথিকৃত্ নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কবি সুফিয়া কামাল, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, কমরেড নলিনী দাস, মনোরমা মাসিমা অমৃত লাল দে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, কৃষক কুলের নয়নমনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেক ক্ষণজন্মা নারী-পুরুষ। একুশে ফেব্র“য়ারি ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে বরিশালের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি-আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের রচয়িতা ও বিশিষ্ট কলামিষ্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং গানটির সুরকার ও শিল্পী আলতাফ মাহমুদ জন্ম নিয়েছেন এ জেলায়। আলতাফ মাহমুদের নামে নগরীতে রয়েছে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়। এছাড়াও স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, বীরোত্তম আব্দুস সত্তার ও মেজর জলিলকে নিয়ে এখানকার মানুষ এখনো গর্ববোধ করেন। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের শৈশব-কৈশোর ও শিক্ষকতা জীবন কেটেছে বরিশাল শহরে। একইভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অপর নেতা চারণ কবি মুকুন্দ দাসের শৈশব-কৈশোর কেটেছে এই শহরে।

ঐতিহাসিক দুর্গা সাগর : ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ পরগনার তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সংকট নিরসনে মাধবপাশায় একটি বৃহৎ দীঘি খনন করেছিলেন। তার মা দুর্গা দেবীর নামে দীঘিটির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। প্রতœতত্ত্ব সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিবর্তে দুর্গাসাগর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে জেলা প্রশাসন। দুর্গাসাগরের তিনদিকে তিনটি ঘাটলা ও দীঘির ঠিক মাঝখানে ৬০ শতক ভূমির ওপর টিলা রয়েছে। দুর্গাসাগরের অদূরেই রয়েছে অত্যাধুনিক বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক জাদুঘর। এ জাদুঘরটি বানারীপাড়ার চাখারে শেরেবাংলার জন্ম ভিটায় অবস্থিত। দুর্গাসাগরে এক সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির সমাগম হতো। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সর্বশেষ ২০০৭ সনের ১৫ নবেম্বর সুপার সাইক্লোন ‘সিডরে’র পর দুর্গাসাগরে আর অতিথি পাখির দেখা মিলছে না। আড়াই’শ বছর আগে খনন করা ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর ও তার অদূরেই লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটিও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি প্রায় তিন’শ বছরের পুরনো।

চারণ কবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি : যে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে বলে গেছেন, আমার জন্মস্থান বিক্রমপুর। এটা শোনা কথার স্মৃতি ব্যতীত আর কিছুই নয়। যে আবেষ্টনকে মানুষ জন্মভূমি নামে ভালবাসে ও শ্রদ্ধাভক্তি করে-তা আমার কাছে বরিশাল। সেই বরিশালেই চারণ কবি মুকুন্দ দাসের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি এখন কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিত। নগরীর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সংলগ্ন এলাকায় ১৯ শতক জমির ওপর একপাশে কালীপূজার মন্ডপ ও অপর ঘরগুলোতে রয়েছে লাইব্রেরি ও ললিতকলা পাঠাগার। একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও রয়েছে। প্রতি মাসের অমাবস্যায় এখানে কালী পূজায় ভক্তদের ভিড় জমে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তসহ কংগ্রেসের নেতারা মুকুন্দ দাসের এ বাড়িতেই আন্দোলন-সংগ্রামের কৌশল নির্ধারণের জন্য গোপন  বৈঠক করতেন। জীবনানন্দ দাসের বাড়ি : নগরীর বগুড়া রোডের মুন্সীর গ্যারেজ হয়ে শীতলাখোলার দিকে রওয়ানা হলেই চোখে পড়ে ‘ধানসিঁড়ি’ নামের একটি বাড়ি। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের বিখ্যাত কবিতার নাম অনুসারে এ বাড়িটির নামকরণ করা হলেও বাড়ির মালিকানা অন্যের হাতে। বাড়ির ভেতর আগের আমলের সেই শাল, শিরিষ, আম, জাম, কেওড়া গাছের খোঁজ এখন আর পাওয়া যায় না। জীবনানন্দ দাসের সাধের গোলাপ বাগানও কালের বির্বতনে শেষ হয়ে গেছে। প্রায় ছয় বিঘা জমির ওপর এ বাড়িটিতে এখন কবির বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঘরের দু’টি খুঁটি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারপরও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন এ বাড়িতে। জেলা পরিষদ জীবনানন্দ দাসের বসত বাড়ির একপাশে একটি পাঠাগার তৈরি করে দিয়েছে। জীবনানন্দ দাসের পিতা সর্বানান্দ দাস গুপ্ত ১৯০৭ সনে বগুড়া রোডে এ বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। তখন বাড়িটির নাম ছিলো ‘সর্বানান্দ ভবন’। এ বাড়িটির বর্ণনা দিতে গিয়ে কবির ছোট ভাই অশোকানন্দ দাস লিখেছেন, বাড়ির ভিতর ঝোঁপের মধ্যে কোথায় আনারসের গায়ে হলুদ ছোপ এসেছে, কাঁঠাল গাছের কাঁঠাল কত বড় হোল, কত আম ধরেছে সবকিছুই থাকত জীবনানন্দের নখদর্পণে। এসব দেখতে তিনি কখনো ভুল করতেন না। বাড়ির ভেতর জীবনানন্দ দাসের গোলাপের বাগান না থাকলেও ফুলের বাগান রয়েছে। নগরীর জনবহুল এলাকায় ওই বাড়িটি এখনো গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ।

শিক্ষা : বরিশাল জেলার সদর দপ্তর স্থাপনের পূর্বে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো ২ হাজার ২৮৫টি। ১৯৪২ সনের জুলাই মাসে বাকেরগঞ্জ প্রাইমারি স্কুল বোর্ড গঠন করা হয়। তখন পর্যন্ত নারী শিক্ষায় মাধ্যমিক স্কুল খুঁজে পাওয়া ছিল দুরূহ ব্যাপার। অথচ তার অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নগরীর সদর গার্লস স্কুল। ১৮৬৮ সনে ব্রাহ্মসমাজ নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করে। এখনো পর্যন্ত মেয়েদের পড়াশোনার জন্য এই একটিমাত্র সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আরো কয়েকটি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হলেও তা জাতীয়করণ করা হয়নি। ১৯০১ সন পর্যন্ত বাকেরগঞ্জ জেলায় ২টি কলেজ ও ১৬টি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় ছিলো। সে আমলে কলকাতার বাইরে আর কোনো জেলা শহরে দু’টি কলেজ ছিলো না। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮৯ সনে বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সত্য-প্রেম-পবিত্রতার মহান ব্রত নিয়ে বিএম কলেজের পাশাপাশি বিএম স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

সাহিত্য সংস্কৃতি : উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এ জেলায় বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা শুরু হয়। নাটক, সংগীত, নৃত্য, চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পে এক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। জাতীয় মঙ্গলের কবি মোজাম্মেল হক, কবি সুফিয়া কামাল, হীরা লাল দাস গুপ্ত এখানকার শিল্প সাহিত্য চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৮৯৫ সনে কলকাতার বাইরে প্রথম প্রকাশিত হয় হিতৈষী পত্রিকা। উনিশ শতকের শেষভাগে বরিশালে নাটক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে গৈলা, কীর্তিপাশা, রহমতপুর, গাভা, পোনাবালিয়া ও রায়েরকাঠীসহ বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হতো। বর্তমানে শুধু বরিশাল নগরীতেই রয়েছে প্রায় ৩০টি সাংস্কৃতিক সংগঠন। খেলাধুলা : বিশ শতকের প্রথমদিকে ফুটবল খেলার মধ্যদিয়ে বরিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪০ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় মোহামেডান ক্লাব। এছাড়াও পুলিশ ক্লাব ও টাউন ক্লাব তখন শক্তিশালী ফুটবল টিম হিসেবে পরিচিত ছিলো। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা নলিনী দাস বরিশালের বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন।

যাতায়াত : খাল-বিলে ভরা এ জেলার মানুষের এক সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম ছিলো একমাত্র নৌকা। গয়নার নৌকা থেকে শুরু করে এখন যাত্রীসেবায় যুক্ত হয়েছে বিলাসবহুল দোতলা-তিনতলা লঞ্চ। যোগাযোগের মাধ্যম নৌ-পথের পাশাপাশি আজ সড়ক পথে উন্নতী হয়েছে।

ধান-নদী-খাল এই তিনে মোগো বরিশাল - দু’শ এগারো বছরের পথপরিক্রমা