স্টাফ রিপোর্টার ॥ নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর ও বয়ো-বৃদ্ধরা সবাই মেতে উঠেছে মারবেল খেলা প্রতিযোগীতায়। আর তাইতো মাঠ-ঘাট, রাস্তার ওপর, বাড়ির আঙ্গিনায়, অনাবাদি জমি, বাগানসহ প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসেছে মারবেল মেলা। সর্বত্রই মারবেল খেলার আমেজ বইছে। আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাচীণ ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে দু’শ বছরের পুরনো দু’দিনব্যাপী এ মারবেল মেলার আজ মঙ্গলবার শেষদিন। এ উপলক্ষে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের প্রত্যন্ত রামানন্দেরআঁক গ্রামে বসেছে এক মিলন মেলা। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। (গতকাল সোমবার ১৪ জানুয়ারি ছিলো মেলার প্রথমদিন) মেলায় বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ, পাশ্ববর্তী গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া, কালকিনি, ফরিদপুরের রাজবাড়িসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে সকল বয়সের হাজার-হাজার নারী-পুরুষের ঢল নামে। খেলায় নারী পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রামানন্দেরআঁক গ্রামে আড়াই’শ বছর পূর্বে জনৈক সোনাই চাঁদ নামের এক নারীর বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই তার স্বামী মারা যায়। নিঃসন্তান বিধবা সোনাই চাঁদ ওই বাড়ির একটি নিম গাছের নিচে স্বামীর নামে পূজা-অর্চনা ও ধ্যান করতো। তার (সোনাই চাঁদের) মৃত্যুর পর ওই বাড়িটি সোনাই আউলিয়ার বাড়ি হিসেবে এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রতিবছর এই দিনে ওই বাড়িতে বৈষ্ণব সেবা, সংকৃতন, কবিগানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানকে ব্যাপক প্রসার ঘটাতে প্রতিবছরের পৌষ সংক্রান্তিতে সোনাই চাঁদ আউলিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী ও বাস্ত পূজা উপলক্ষ্যে প্রায় দু’শ বছরের অধিক সময় ধরে ওই গ্রামে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মারবেল খেলা মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি হরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস (৮৫), হরবিলাস মিস্ত্রী (৮০) ও বুদ্ধি হালদার (৭৫) বলেন, দু’শ বছরের অধিক সময় ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাপ-দাদারা এ মারবেল খেলার মেলার আয়োজন করে আসছিলো, তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রতিবছর সোনাই চাঁদ আউলিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী ও বাস্তপূজা উপলক্ষ্যে এ মারবেল মেলার আয়োজন করা হয়। এদিনটিকে ঘিরে রামানন্দের আঁক গ্রামে মহাউৎসবের আমেজ বিরাজ করে। স্থানীয়রা তাদের মেয়ে-জামাতাকে পর্যন্ত এ মেলায় মারবেল খেলার জন্য আমন্ত্রন জানিয়ে থাকে। মেলা উপলক্ষে চিড়া, মুড়ি, খেজুর রসের গুড়ের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে ওই এলাকায়। এ বছরও মেলার প্রধান আকর্ষন হচ্ছে মেয়েদের মারবেল খেলার প্রতিযোগীতা।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছে প্রদীপ দাস (৩৫)। তিনি জানান, মারবেল খেলার কথা শুনে মেলায় এসেছি। সব বয়সের নারী-পুরুষ একসাথে মারবেল খেলতে দেখে আনন্দ উপভোগ করছি। রাজবাড়ি জেলার বালিয়কান্দীর বাসিন্দা রবীন্দ্র নাথ রায় (৮২)। তার মেয়ের জামাই মিহির বিশ্বাসের বাড়ি আগৈলঝাড়া উপজেলার রামানন্দের আঁক গ্রামে। মেলার একদিন পূর্বেই (গত ১৩ জানুয়ারি) মেলা উপভোগ করার জন্য তিনি মেয়ে জামাতার বাড়িতে এসেছেন। তিনি বলেন, গ্রাম বাংলার ব্যতিক্রম ধর্মী এ মেলাটি উপভোগ করতে ভালো লাগছে।
মারবেল খেলায় অংশগ্রহন করা তরুনী কল্পনা বিশ্বাস, মিতু রায়, সাথী মজুমদারসহ অনেকেই বলেন, ছেলেরা শুধু মারবেল খেলে, সামাজিক কারনে মেয়েদের ইচ্ছে থাকলেও তারা খেলতে পারেনা। এই দিনটি উপলক্ষে মেয়েদের মনের ইচ্ছাটি পুরন করা সম্ভব। তাই এ গ্রামসহ পাশ্ববর্তী গ্রামের মেয়েরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে মেলায় আগত সমীর বিশ্বাস (৩০), পলাশ রায় (২৫), জুয়েল সমদ্দার (২৩), মিলন বিশ্বাস (২৪), টিটু সমাদ্দার (১৯) ও মনতোষ সমদ্দার (২০) বলেন, আমরা মারবেল খেলার মেলার কথা ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। তাই এ বছর এ মেলায় আসার জন্য গত ছয়মাস পূর্বেই আমরা বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মেলায় আসার। তাই এবছরই প্রথম এ মেলায় এসেছি। ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলা দেখতে আমাদের অনেক ভাল লেগেছে। এছাড়াও বাস্ত পূজার প্রসাদ খেতে পেরেও আমরা খুবই আনন্দিত।
মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। কয়েক হাজার টাকার মারবেল বিক্রি হয় এ মেলায়। শিশু থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা মেলার প্রধান আকর্ষণ মারবেল খেলায় অংশগ্রহন করেন। মেলাটি একদিনের জন্য হলেও খেলার আয়োজন থাকে দু’দিন। এছাড়া বাস্তপূজা উপলক্ষে স্থানীয় মন্দিরে পূর্জা-অর্চনার আয়োজন করা হয়। সেখানে অনেকেই মানত নিয়ে আসেন। মেলা উপলক্ষে গত ১৩ জানুয়ারি থেকে ওই গ্রামের নিকট আত্মীয়-স্বজনসহ দুর দুরান্তের হাজার-হাজার লোকজনের সমাগম ঘটে। মেলা পরিচালনার জন্য শিক্ষক যতীশ চন্দ্র বাড়ৈকে আহবায়ক করে ৩৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি মেলা উদ্যাপন কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি যতীশ বাড়ৈ জানান, মেলায় মারবেল খেলার জন্য অনেকেই দুর-দুরান্ত থেকে এসেছেন। তাদের জন্য পূর্ব থেকেই ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য মেলায় ব্যাপক পুলিশ ও শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী সার্বক্ষণিক কাজ করছে।
মেলায় উপস্থিত রাজিহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ইলিয়াস তালুকদার ও পার্শ্ববর্তী গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কৃষ্ণ কান্ত দে সার্বক্ষণিক মেলায় ছিলেন। তারা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মারবেল মেলাকে জনপ্রিয় করার জন্য মেলাস্থলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতীসহ মাঠ সম্প্রসারিত করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।