পাঁচদিন পর লাশ উদ্ধার – আসামিদের বাড়ি ভাংচুর – বরিশালে পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরনের পর স্কুল ছাত্রকে হত্যা – পাচারকারী দলের সন্ধান লাভ

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরনের পাঁচদিন পর শুক্রবার রাতে পুলিশ অপহৃতা স্কুল ছাত্র রানা দাসের (১৪) লাশ উদ্ধার করেছে। গ্রেফতারকৃত তিন আসামির দু’জনের দু’দিনের রিমান্ডের প্রথমদিনেই (শুক্রবার রাত এগারোটার দিকে) তাদের স্বীকারোক্তিমতে টরকীরচর মহল্লার একটি পান বরজের পার্শ্বের ডোবার কচুরিপানার নিচ থেকে রানার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় শনিবার সকালে ফের উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসি ও রানার সহপাঠীরা হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে আসামিদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করেছে। পুলিশ ও আ’লীগের সিনিয়র নেতারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন। ঘটনাটি বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার সুন্দরদী মহল্লার।

গৌরনদী থানার চৌকস অফিসার ইনচার্জ ওসি আবুল কালাম জানান, সুন্দরদী মহল্লার বাসিন্দা দিনমজুর কৃষ্ণ দাসের পুত্র ও উপজেলার টরকী বন্দর ভিক্টোরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র রানা দাস। গত ১৩ জানুয়ারি বিকেলে কৌশলে স্থানীয় মথুরা ভক্তর পুত্র কার্তিক ভক্ত (২৫), মৃত কালা চাঁন ভক্তর পুত্র সুলতান শরীফ (৪৮) ও তার স্ত্রী হেনা বেগম পাচারের উদ্দেশ্যে রানা দাসকে টরকী আনোয়ারা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের পাশ্ববর্তী ক্রিকেট খেলার মাঠ থেকে অপহরন করে। মুহুর্তের মধ্যে অপহরনকারীদের নাম এলাকায় প্রকাশ পেয়ে যায়। এ ঘটনায় গত ১৪ জানুয়ারি অপহৃতার পিতা কৃষ্ণ দাস বাদি হয়ে কার্তিক ভক্ত, সুলতান শরীফ ও তার স্ত্রী হেনা বেগমকে আসামি করে গৌরনদী থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশ তাৎক্ষনিক অভিযান চালিয়ে তিনজনকেই গ্রেফতার করে। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোর্পদ করে। বরিশাল জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের বিচারক মোসাদ্দেক মিনহাজ কার্তিক ও সুলতানের দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শুক্রবার আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা পাচারের উদ্দেশ্যে রানাকে অপহরনের পর হত্যা করে লাশ গুম করার কথা অকপটে স্বীকার করে। আসামিদের উদ্বৃতি দিয়ে ওসি আবুল কালাম আরো জানান, রানা দাসকে পাচারের জন্য আসামিরা অপহরন করেছিলো। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে অপহরনকারীদের নাম পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পরায় এলাকায় চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। এহেন পরিস্থিতিতে নিজেদের আড়াল করতে অপহরনের দিন রাতেই আসামি সুলতান শরীফের ঘরে বসে অপহৃতা স্কুল ছাত্র রানা দাসকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। আসামিদের স্বীকারোক্তিমতে ও কড়া পুলিশ প্রহরায় তাদের নিয়ে শুক্রবার রাত এগারোটার দিকে পুলিশ টরকীর চর নিখিল সরকারের বাড়ির পার্শ্বের পান বরজের পাশে পরিত্যক্ত ডোবার কচুরিপানার নিচ থেকে অপহৃতা স্কুল ছাত্র রানা দাসের লাশ উদ্ধার করে। এ খবর মুহুর্তের মধ্যে এলাকায় ছড়িয়ে পরলে পুরো এলাকা ফের উত্যপ্ত হয়ে ওঠে। তাৎক্ষনিক বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী স্কুল ছাত্র রানা দাসের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। শনিবার নিহত রানা দাসের বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও হাজার-হাজার বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসি হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে আসামি কার্তিক ভক্ত ও সুলতান শরীফের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। খবর পেয়ে পুলিশ, আ’লীগের সিনিয়র নেতারা ও পৌর মেয়র মোঃ হারিছুর রহমান হারিছ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিক্ষুব্ধদের সাথে একত্বতা প্রকাশ করে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন। অপরদিকে পুলিশ গতকাল শনিবার রানা দাসের লাশের ময়নাতদন্তের জন্য বরিশাল মর্গে প্রেরন করেছে।

বাকরুদ্ধ রানার পরিবার
শুক্রবার রাতে স্কুল ছাত্র রানা দাসের লাশ উদ্ধারের পর থেকে বাকরুদ্ধ হয়ে পরে হতভাগ্য রানার বাবা কৃষ্ণ দাস ও মা ঝর্ণা দাস। পুত্র শোকে তারা পাথর হয়ে গেছেন। লোকজন দেখলে তারা শুধু হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কৃষ্ণ দাসের দু’পুত্রের মধ্যে রানা ছিলো ছোট। পরিবারের সবার আদরের রানার লাশ দেখে আহাজারি করার একপর্যায়ে তারা বাকরুদ্ধ হয়ে পরেন। গতকাল শনিবার সকালে শোকার্ত পরিবারকে শান্তনা দিতে ওই বাড়িতে ছুটে গেছেন উপজেলা আ’লীগের সভাপতি এইচ.এম জয়নাল আবেদীন, সাধারন সম্পাদক হারিছুর রহমান, আ’লীগ নেতা রাজু আহম্মেদ হারুন, উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক আলহাজ্ব আবুল হোসেন মিয়া সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দরা। তারা সকলেই স্কুল ছাত্র রানা দাসের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

স্কুলে শোকের ছায়া
অস্টম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র রানার লাশ উদ্ধারের খবর গতকাল শনিবার সকালে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পরলে শোকের ছায়া নেমে আসে। সকাল দশটায় স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। শিক্ষক ও সহপাঠীরা নিহত রানার বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের করুন আহাজারি দেখে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা ঘটে। স্কুলের শিক্ষক আব্দুল ওহাব জানান, আজ রবিবার সকাল এগারোটায় স্কুলের পক্ষ থেকে হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মৌণ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।

কেন এই হত্যাকান্ড
গত ১৪ জানুয়ারি থানা কম্পাউন্ডে বসে গ্রেফতারকৃত কার্তিক ভক্তের দেয়া স্বীকারোক্তিমতে, আসামি সুলতান শরীফের পুত্র রাজিব শরীফ দীর্ঘদিন থেকে নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত। রাজিব ঢাকায় কতিথ মাইক্রোবাস চালক। সুলতান ঢাকার রায়ের বাজারের একটি মার্কেটের নৈশ প্রহরী। সুলতান ও তার স্ত্রী হেনা বেগম বিভিন্নস্থান থেকে কৌশলে নারী ও শিশুদের এনে তাদের বাড়িতে রেখে পরে তাদের পুত্র রাজিব ও তার লোকজনদের মাধ্যমে কৌশলে দেশের বাইরে পাচার করে দিতো। সেও (কার্তিক) দীর্ঘদিন থেকে তাদের সাথে পাচারের কাজে সহযোগীতা করে আসছিলো। থানা কম্পাউন্ডে বসে এ কথা অকপটে স্বীকার করে সুলতানের বড় মেয়ের দশ বছরের শিশু পুত্র হৃদয়। সে জানায়, তার নানা রানার মুখ বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছে। হৃদয় একই কথা গত ১৫ জানুয়ারি বরিশাল জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।

লাশ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল
স্কুল ছাত্র রানা দাসের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সুন্দরদীর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এসময় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা রানার হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে লাশ নিয়ে ওই এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে। শেষে নিহত রানা দাসের লাশ পারিবারিক শ্মশানে ওইদিন রাতেই অন্তেষ্টিক্রীয়া সম্পন্ন করা হয়।  

পাঁচদিন পর লাশ উদ্ধার - আসামিদের বাড়ি ভাংচুর - বরিশালে পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরনের পর স্কুল ছাত্রকে হত্যা - পাচারকারী দলের সন্ধান লাভ