নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ১২৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ বরিশাল বিএম কলেজ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। অধ্যক্ষ’র বদলীকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের একাংশের নেতাদের স্বার্থ রক্ষার্থে সত্য, প্রেম ও পবিত্রতার তীর্থ স্থান এ কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা মুথ থুবড়ে পড়েছে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত তার পিতা ব্রজমোহনের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কলেজটি। বিএম কলেজের ইতিহাসে কোনো ছাত্র আন্দোলনের মুখে এ বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তালাবদ্ধ রেখে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার নজির নেই। অথচ গত ১০ দিন যাবত এ কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কলেজের মুল ফটক সহ প্রশাসনিক ভবন ও সকল বিভাগগুলোতে তালাবদ্ধ করে অধ্যক্ষ’র বদলী ঠেকাতে মরিয়া ছাত্রলীগ। কলেজের ক্লাস করতে এসে শিক্ষার্থীদের ফিরতে হচ্ছে শূন্য হাতে। মুল ফটকে তালাবদ্ধ থাকায় সেখান থেকে ফিরে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সবচেয়ে করুন অবস্থায় রয়েছে আবাসিক ছাত্ররা। গত ৩০ জানুয়ারির পর এ কলেজের আবাসিক ছাত্ররা অবরুদ্ধ জীবন-যাপন করছে। অস্থায়ী কর্মপরিষদের ছাত্রলীগের একাংশের নেতারা তাদের জিম্মি করে প্রতিদিন বিক্ষোভ মিছিল সহ নানান কর্মসূচীতে বাধ্য করাচ্ছেন। এতে ফলপ্রসু কোনা কিছু না হওয়ায় সর্বশেষ তারা এসব শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র-সস্ত্র দিয়ে ক্যাম্পাস সহ প্রশাসনিক ভবনে জড়ো করে। দিন যতই যাচ্ছে ততই ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে এসব শিক্ষার্থীদের মাঝে। গত ৩০ জানুয়ারী বিএম কলেজের অধ্যক্ষ ননী গোপাল দাসকে খুলনা বিএল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান করার আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় চাখার সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ শংকর দত্তকে। এপরই ননী গোপাল দাসের বদলী ঠেকাতে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে গিয়ে কলেজের প্রত্যেকটি বিভাগে তালা বদ্ধ করে দেয়। এতেই ক্ষান্ত না হয়ে পরদিন নতুন অধ্যক্ষ’র যোগদান ঠেকাতে কলেজের মুল ফটকে তালাবদ্ধ করে রাখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিহীন বিভাগীয় শহর বরিশালে এখনো উচ্চ শিক্ষা অর্জনের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু সরকারী ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এদেশের মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতেই অশ্বিনী কুমার মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সত্যকে প্রতিষ্ঠা ও দেশকে ভালবাসার জন্য শিক্ষিত মানুষ আপোষহীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। ‘এভাবে কেবল সুন্দর ও পবিত্র জীবন গড়ে তোলা সম্ভব’-এ ছিল তার একান্ত বিশ্বাস। এ কলেজ থেকে শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপি ও সচিবসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় বারবার এ কলেজটি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড থেকে পিছিয়ে পড়লেও বর্তমানে অবস্থা চরম প্রকট আকার ধারণ করছে।
১৯৪৭ সালে ও ১৯৫০ সালের দাঙ্গার সময় বহু প্রবীণ অধ্যাপক দেশ ত্যাগ করায় কলেজটি সংকটের মুখে পড়েছিল। ১৯৫২ সালে আর্থিক সংকট ও অধ্যাপকের অভাবে কলেজের সবক’টি অনার্স কোর্স বন্ধ হয়ে যায়। ষাটের দশকে এ কলেজে মাত্র অর্থনীতিতে অনার্স চালু হয়। স্বাধীনতার পর উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ নীতিমালার অধীনে ১৯৭২ সালে একসঙ্গে ৭টি বিষয়ে অনার্স ও ৪টি বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রী কোর্স চালু করা হয়। বর্তমানে কলেজটিতে ১৯টি বিষয়ে অনার্স ও মাষ্টার্স কোর্সে ২০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করছে। ১২৬ বিঘা জমির উপর সম্প্রসারিত হয়েছে কলেজ ক্যাম্পাস। সকল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় এ কলেজটি আজ মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে। এ নিয়ে প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ মহল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় দিন যতই যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
অধ্যক্ষ’র বদলী ঠেকাতে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে অস্থায়ী কর্মপরিষদের (ছাত্রলীগের একাংশ নিয়ে গঠিত) নেতা-কর্মীরা এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বললেও আন্দোলনের বিরোধীতা করে কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক রফিক সেরনিয়াবাত ইত্তেফকাকে জানান- কলেজে নির্বাচনবিহীন ছাত্র কর্মপরিষদ তিন মাসের জন্য গঠন করে দেড় বছর যাবত অধ্যক্ষ ননী গোপাল ছাত্র সংসদের নামে কলেজের মোট ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে। তিনি জানান এর যাবতীয় তথ্যাদি তার কাছে রয়েছে তিনি বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তথ্যাদি সরবরাহ করবেন। তিনি জানান একাউন্স অফিসার আব্দুস সালাম প্রায় দু’ বছর যাবত এলপিআরে থাকলেও তাকে প্রেষনে এ কলেজে রেখে অধ্যক্ষ ও অস্থায়ী কর্মপরিষদের লোকজন কোটি টাকা লোপাট করেছে। অধ্যক্ষ’র বদলী হলে এসব বিষয় জানাজানির ভয়ে অবৈধ কর্ম পরিষদের নেতারা নিজেদের স্বার্থে আন্দোলন করছে।
ক্যাম্পাস সুত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ৩ মাসের জন্য গঠিত অস্থায়ী কর্মপরিষদ এখনো বহাল থাকায় কলেজের শিক্ষকরাই বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলেন অধ্যক্ষ’র বিরুদ্ধে। ছাত্র সংসদের নামে বিভিন্ন খাতের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রায় দু’ মাস আগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা পরিচালক নোমান-উর-রশীদ তদন্ত করেন। তিনি আর্থিক দুনীর্তির তদন্ত কালে বেশ কিছু অনিয়ম চিহ্নিত করেন। এর কিছুদিন পড়ে সরকারের নিরীক্ষা বিভাগ একই অর্থবছরের হিসাব পুনরায় (দু’বার) নিরীক্ষা করেন। দ্বিতীয়বার নিরীক্ষা করে আর্থিক অনিয়মের সত্যতা পাওয়ায় অনিয়মের সমুদয় টাকা ৭ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন নির্মাণ কাজের টেন্ডার নিয়ে অধ্যক্ষ ও তার অনুসারী ছাত্রলীগের কথিত কর্মপরিষদের একাংশের (বাকসু’র দায়িত্বে থাকা) নেতাদের বিরুদ্ধে শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানান অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এ কারনেই ননী গোপাল দাসকে বদলী করা হয়েছে বলে কলেজের শিক্ষক ও অধিকাংশ শিক্ষার্থী মনে করছেন।