স্তন ক্যান্সার – চাই সচেতনতা

তাসমিয়া তাহমীদ : নারী হয়ে জন্ম নেওয়াই স্তন ক্যানসারের একটি ঝুঁকি। তাই প্রত্যেক নারীই স্তন ক্যানসারের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করেন। বিশ্বে প্রতি ১৬ জন নারীর একজনের জীবনের যেকোনো সময় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। উন্নত বিশ্বে তো বটেই, বাংলাদেশের নারীরাও এই ঝুঁকির বাইরে Brest Cancerনন। তাই এখনই সময় সচেতন হওয়ার ও রোগ প্রতিরোধের। আর অন্য সব রোগের মতোই এখানেও সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো, দেরিতে রোগ শনাক্ত হওয়া এবং এ কারণে চিকিৎসা গ্রহণে পিছিয়ে পড়া। তাই বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক স্ক্রিনিং সিস্টেম। গড়ে উঠছে একই সেন্টারে একাধিক সেবা মেলে এমন মাল্টিডিসিপ্লিনারি ডায়াগনস্টিক টিম, যেখানে একাত্ম হবেন রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, ব্রেস্ট অনকোলজিস্ট, ব্রেস্ট সার্জন, রেডিওথেরাপিস্ট—সবাই। গড়ে উঠেছে নারীদের জন্য ভয়ানক এই ঘাতককে রোখার ও এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, গাইডলাইন ও সরকারি আইনকানুন। আর যথারীতি এখানেও আমরা যথেষ্ট পরিমাণেই পিছিয়ে।

চাই দ্রুত ও সঠিক রোগনির্ণয়
দ্রুত ও সময়ানুগ রোগনির্ণয়ে সফলতাই স্তন ক্যানসার চিকিৎসার মূল চাবিকাঠি। এ জন্য সবার আগে চাই নারীর সচেতনতা। ৩৫ বছর পার হয়ে গেলেই নিজের স্তন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে প্রত্যেক নারীকে। নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা এবং স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকা হচ্ছে এই সচেতনতার প্রথম ধাপ। জেনে নেওয়া দরকার স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কেও। পরিবারে কারও স্তন ক্যানসারের ইতিহাস, অত্যধিক ওজন, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, হরমোন ট্যাবলেট সেবনের ইতিহাস, মাসিকের ইতিহাস—এগুলো জানা জরুরি। এর আগে স্তনে কোনো সমস্যা হয়েছিল কি না বা কোনো পরীক্ষা, যেমন—ম্যামোগ্রাফি করা হয়েছিল কি না। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। এরপর দরকার একটি সার্বিক ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট। স্তনে যেকোনো সমস্যা বা সন্দেহজনক পরিবর্তনে প্রথমেই শরণাপন্ন হতে হবে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের। তিনি পূর্ণ ইতিহাস জানার পাশাপাশি আপনাকে বসিয়ে এবং শুইয়ে দুবার পরিপূর্ণভাবে দুটি স্তন ও দুটি বগল পরীক্ষা করবেন। যেকোনো সন্দেহজনক পরিবর্তন দেখলে তিনি শরণাপন্ন হবেন ল্যাবরেটরি পরীক্ষার।

এক. প্রথমেই আসে ব্রেস্ট ইমেজিং। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ম্যামোগ্রাফি ও আলট্রাসাউন্ড—এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ। ম্যামোগ্রাফি হচ্ছে স্তনের এক ধরনের বিশেষ এক্স-রে, যাতে সচরাচর ব্যবহূত এক্স-রের তুলনায় কম তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে ম্যামোগ্রাফি স্তন ক্যানসারের জন্য একটি শক্তিশালী ও বহুল ব্যবহূত স্ক্রিনিং পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। ৪০-পরবর্তী নারীদের নিয়মিত বার্ষিক ম্যামোগ্রাফির আওতায় আনা হয়েছে অনেক দেশে। তবে কম বয়সী নারী, যাঁদের স্তনগ্রন্থি আঁটোসাঁটো থাকে এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা, যাঁদের তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আছে, তাঁদের জন্য ম্যামোগ্রাফির বদলে আলট্রাসাউন্ড শ্রেয়তর। কেননা, এতে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয় না। তবে সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে ৩৫-ঊর্ধ্ব নারীদের জন্য একই সঙ্গে ম্যামোগ্রাফি ও আলট্রাসাউন্ড সবচেয়ে ভালো ধারণা দিতে সক্ষম। তবে লক্ষ রাখবেন, দুটি পরীক্ষাই যেন একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে করা হয়, যা তুলনাযোগ্য হতে পারে। স্তনের জন্য হাই ফ্রিকোয়েন্সি লিনিয়ার প্রোব আলট্রাসাউন্ড রোগনির্ণয়ে বেশি কার্যকর।
দুই. বায়োপসি বিভিন্ন ধরনের হয়। চাকা বা পিণ্ড কত বড় ও কোথায় অবস্থিত, তার ওপর নির্ভর করে কোনটি ব্যবহার করা হবে। যেমন—কোর বায়োপসি হচ্ছে এমন একটি আধুনিক পদ্ধতি, যেখানে একটি সূক্ষ্ম সুচের (নিডল গান) মাধ্যমে চাকা বা পিণ্ড থেকে খানিকটা টিস্যু এনে দেখা হয় তার অস্বাভাবিকতা। সময় লাগে ১৫ মিনিট। এ সময় নির্ভুল জায়গায় পৌঁছাতে আলট্রাসাউন্ডের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অপরদিকে কোনো চাকা চামড়ার বা স্তনবৃন্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আটকে থাকলে বা চামড়ায় কোনো ক্ষত বা ঘা থাকলে পাঞ্চ বায়োপসি করতে হয়। একজন দক্ষ প্যাথলজিস্ট এই বায়োপসি রিপোর্টটি করার সময় এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত মাত্রা বা স্কেল ব্যবহার করেন। রেডিওলজিস্টও একই সঙ্গে তাঁর ম্যামোগ্রাফি ও আলট্রাসাউন্ডের রিপোর্টের ক্ষেত্রে মাত্রা বা স্কেল ব্যবহার করবেন। আর যে চিকিৎসক রোগীকে দেখেছেন, তাঁর তো নিজস্ব ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট আছেই। এই ত্রয়ী বিশেষজ্ঞ অবশেষে সামগ্রিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবেন রোগটি আসলে কী, তা কোন পর্যায়ে আছে এবং কোন ধরনের চিকিৎসা রোগীর প্রয়োজন। চিকিৎসকদের মতামতে গরমিল থাকলে প্রয়োজনে তাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো পরীক্ষার পুনরাবৃত্তিও করতে পারেন বা আরও আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্য নিতে পারেন। বিশ্বে স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের এই যুগপৎ প্রচেষ্টার নাম ট্রিপল অ্যাসেসমেন্ট বা ত্রয়ী পর্যবেক্ষণ নীতিমালা।

স্তনের সার্জারি: নতুন দিগন্ত
যদি ক্যানসার ধরা পড়ে, তবে তা স্তনের কতটুকু দখল করে আছে, অন্য স্তন বা আশেপাশের গ্রন্থিগুলোর অবস্থা কী, কতটুকু ক্ষতি হয়েছে এবং টিউমারের নিরাপদ সীমানা কতটুকু—এসব জটিল বিষয় বিবেচনায় এনে সার্জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। এত দিন স্তনের সার্জারি বলতে মাসটেকটমি (সম্পূর্ণ স্তন অপসারণ), র‌্যাডিকাল মাসটেকটমি (স্তনসহ গ্রন্থিগুলোর অপসারণ), ব্রেস্ট কনসার্ভি সার্জারি (স্তন সংরক্ষণ সার্জারি) প্রভৃতিকেই বোঝাত। কিন্তু এখন আধুনিক বিশ্বে চলে এসেছে অনকোপ্লাস্টিক টেকনিক, যার মাধ্যমে অকারণ বিকৃতি না করে, এমনকি তিন থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার আকারের টিউমারও নিরাপদে স্তন সংরক্ষণ করেই অপসারণ করা সম্ভব। এ ছাড়া সার্জারি ও রেডিওথেরাপির পর বিকৃতি রোধ করতে বলিউম রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির সাহায্য নেওয়া হয়। তবে আধুনিক অনকোপ্লাস্টিক টেকনিক একই সঙ্গে ক্যানসার অপসারণ ও রিকনস্ট্রাকশন বা বিকৃতি রোধের সুযোগ এনে দিয়েছে।

চাই পদক্ষেপ
সংকোচ ও অবহেলা নারীকে নিজের স্তন বিষয়ে কুণ্ঠিত করে রাখে। নিজের সমস্যাগুলো গোপন করা, প্রকাশ করতে দেরি করা বা প্রকাশ করলেও তা পরিবার ও পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থায় আমলে না আসার চক্র নারীকে ঠেলে দেয় নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। যে রোগের চিকিৎসা আশাপ্রদ ও সহজলভ্য, সে রোগটি ভয়ংকর ঘাতকরূপে দেখা দেয়। তাই স্তন ক্যানসার ঠেকানোর প্রথম পদক্ষেপই হলো সচেতনতা। নারীরা নিজের সম্পর্কে নিজে সচেতন হোন, পরিবারের নারী সম্পর্কে অন্য সবাই সচেতন হোন, সর্বোপরি দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নারীর সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন হোক—এটাই আমাদের আশা।

জেনে নিন কখন সাবধান হবেন

  • স্তনে কোনো চাকা বা পিণ্ড দেখা দিলে:
  • গোসলের সময় মাসে অন্তত একবার হাত দিয়ে স্তন ও বগল পরীক্ষা করার সময় যদি হাতে কোনো চাকা অনুভব করা যায়, যা আগে কখনো ছিল না।
  • এর আগে স্তনে টিউমারের চিকিৎসা হয়েছে—এমন কারও নতুন করে আবার কোথাও চাকা দেখা দিলে।
  • চাকাটি খুব দ্রুত বড় হতে থাকলে।
  • চাকাটি যদি স্তনের চামড়া বা স্তনবৃন্তের সঙ্গে ঘনভাবে সন্নিবেশিত থাকে।
  • দুই স্তনের আকার ও আকৃতিতে অস্বাভাবিক গরমিল দেখা দিলে।
  • পর পর দুটি মাসিকের পরও স্তনের চাকা চাকা ভাব অনুভূত হতে থাকলে।
  • স্তনের সিস্ট ঘন ঘন দেখা দিলে।
  • ফোঁড়া বারবার হতে থাকলে।
  • স্তনে ব্যথা
  • শুধু ব্যথা কোনো দুশ্চিন্তার বিষয় নয়, কিন্তু এর সঙ্গে চাকা, বিকৃতি বা যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
  • মেনোপজের পর কোনো নারীর এক পাশে অস্বাভাবিক ও স্থায়ী ব্যথা।
  • যে তীব্র ব্যথা সাপোর্টিভ ব্রা বা ব্যথানাশক খেলেও দূর হচ্ছে না।
  • স্তনবৃন্তের অস্বাভাবিকতা
  • স্তনবৃন্ত থেকে রক্তক্ষরণ।
  • দীর্ঘস্থায়ী অ্যাকজিমা বা ক্ষত।
  • স্তনবৃন্ত ভেতর দিকে ঢুকে যাওয়া, দেবে যাওয়া বা এক পাশে সরে যাওয়া।
  • যেকোনো বয়সে বৃন্ত থেকে নিঃসৃত ক্ষরণ সর্বদা কাপড়ে লেগে থাকা।
  • বগলের অস্বাভাবিকতা
  • বগলে কোনো চাকা বা পিণ্ড অনুভূত হওয়া।

তাসমিয়া তাহমীদ
বিভাগীয় প্রধান ও ব্রেস্ট সার্জন, ব্রেস্ট কেয়ার সেন্টার, ডিফাম হাসপাতাল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৬, ২০১১